আনারকলি, সেলিম কি মহাব্বত তুমে মরনে নেহি দেঙ্গে অর হাম তুমে জিনে নেহি দেঙ্গে’। মুঘল-এ-আজম সিনেমায় এ ছিল বাবার হুঁশিয়ারি। জীবনে এক আধ বার হয়তো এমন চরম আদেশ মেলে। তখন উভয় সঙ্কটের সামনে নতজানু হয় নিরুপায় মানুষ। কিন্তু আম-আদমির জীবনটাই চলে মুর্হুর্মুহু সতর্কবার্তার সুতোয়। মানলে বিপদ, না মানলে অত্যাচার। সভ্য সমাজের উত্তরণের স্বার্থে চালু হতে থাকে নিয়ম। আসন্ন প্রতিকূলতা রুখতে অসহায় নিয়মের নিয়ত অদলবদল। সব বিশৃঙ্খলা রুখতে চায় একটা ‘সিস্টেম’। সেখানে থরে থরে সাজানো নিয়মের সম্ভার। নিয়ম আমাদের বাঁচতে দেয় না। নিয়ম ভাঙলে শো-কজ। ছাড় দেয় না বিবেকও।
জাতীয় সড়ক জুড়ে মাথার উপরে চলন্ত নির্দেশ, ‘মোবাইল কানে গাড়ি চালাবেন না।’ পেট্রল পাম্পে বড় বড় হরফে লেখা, ‘হেলমেট ছাড়া পেট্রল নয়।’ ক্লিনিকের সামনে লেখা, ‘সরকারি বিধি মেনে এখানে লিঙ্গ নির্ধারণ হয় না।’ জনপরিসরে ‘ধূমপান করবেন না’, বিদ্যালয় ও হাসপাতালের সামনে, ‘আস্তে মাইক বাজান’— এমন হাজারো বিধিনিষেধ আর জরিমানা চলছে। মানুষ সতর্কবার্তা দেখছে। উপেক্ষাও করছে অভ্যাসে। এক অনবদ্য ‘না’-এর সহজ অভ্যাস মেরুদণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে ফলাফল দ্রুত আসে না। চরম পরিণতি জানে সবাই। এক আশ্চর্য বিপন্নতা গ্রাস করে অবশেষে। ঠিক তখনই প্রয়োজন হয় ফিরে দেখার।
মানুষ সিস্টেমের দাস। বিধির সঙ্গে মানিয়ে চলা তার কাজ। পরিবর্তন করে নিজের মতো করে গড়ে নেওয়া নয়। অথচ কর্তব্য পালন আজকের দিনে ঐচ্ছিক বিষয়। অধিকার আদায় করার বিষয়ে তবুও কিছুটা সচেতন মানুষ। কিন্তু নিয়ম ধারাবাহিক ভাবে অনুসরণ করা এখন প্রায় বাতিলের খাতায়। নিয়মের ফাঁসে যদিও সে অক্টোপাশের মত বাঁধা। তবুও তার মনে হয়, নিয়ম না মানলে কিছু হয় না। বিধি ভাঙলে খুব দোষের কিছু নেই। আটপৌরে মানুষ জানে, সরকারি অফিসে এক দিনে কাজ হয় না। রকে বসা ছেলে জানে, মেয়েদের উত্ত্যক্ত করলে তেমন কিছু হয় না। চালক জানে, দুর্ঘটনা না ঘটা পর্যন্ত কানে মোবাইল ধরা দোষের নয়। ডাক্তার জানে, ক্লিনিকে সরকারি লোকের ছানবিন হবে না। তাই যেমন চলে এসেছে, তেমনই চলবে। সকলে না হলেও অনেকে এমনটাই ভাবেন!
বিদ্যালয় সমাজেরই এক ক্ষুদ্র সংস্করণ। সব শ্রেণির মানুষ প্রাথমিক ভাবে শিখতে আসে বিদ্যালয়ে। সেখানে সদ্য শেষ হয়েছে মাধ্যমিক পরীক্ষা। শুরু হল আরও একটি বড় পরীক্ষা, উচ্চ মাধ্যমিক। অন্য অনেক জরুরি নির্দেশিকার সঙ্গে মোবাইল নিয়ে নির্দেশিকাও অব্যাহত। মাধ্যমিক পরীক্ষার আগেই খুব স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, পরীক্ষার্থীদের কোনও ‘অ্যাকাডেমিক অ্যাডভান্টেজ’ দেওয়া যাবে না। লিখিত নির্দেশিকায় বলা হয়েছিল, মোবাইল আনলে তা বাজেয়াপ্ত করা হবে। সেই সঙ্গে বাতিল করা হবে পরীক্ষার খাতাও। শিক্ষকেরা মোবাইল রাখতে পারবেন না। সেই আদেশ অনুসারে, নিয়মভাঙা শিক্ষক শাস্তি পেলেন। কর্তৃপক্ষ যথাযথ কর্তব্য পালন করলেন। কিন্তু বাকিটা সেই ‘অশ্বত্থামা হত ইতি গজঃ’ হয়ে রইল। জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষা দিতে এসে পরীক্ষার্থীরা জেনে গেল, নিয়ম ভাঙলে কিস্যু হয় না।
যারা বোর্ডের পরীক্ষায় পকেট ভর্তি কাগজ নিয়ে আসছে তাদের এই অনৈতিক সাহসের মূলে কে? প্রশ্নের সামনে বিবশ সবাই। কবে থেকে এই সাদা মনের পড়ুয়ারা জানতে শিখল, না পড়ে, নকল করেও পাশ করা যায়। আর এই পাশ-এ কোনও গ্লানি নেই। আছে অধিকার। এই অধিকারের শিকড় কোথায়?
বেশ কিছু এলাকা আছে যেখানে নাকি মেয়েদের বিয়ের জন্য পাশ জরুরি। পাল্টা যুক্তিও আছে। চাকরি নেই, কাজ নেই। ছেলেরা যদি নকল করেই পাশ করে তবে ক্ষতি কী! কন্যাদায়ের তাগিদে কোথাও কোথাও অতি সক্রিয় হয়ে ঘরে ঘরে চলে উত্তর বলে দেওয়ার কাজ। আবার ছাত্ররা দাবি করে বসে, ‘পরীক্ষার হলে শর্ট প্রশ্নগুলো বলে দিন।’
এই ভাবে কিছু না পড়েই, না জেনেই, না শিখে উত্তীর্ণ হওয়া এই যুবসমাজের দায় কে নেবে? এত এত সরকারি চেষ্টার পরেও কেন কমছে না এই প্রবণতা? শিক্ষিত লোকজনের দাবি, অভিভাবক তেমন শিক্ষিত ও সচেতন নন। তাঁরা শুধু রেজাল্ট চান। তাই যেনতেন প্রকারে সন্তান তা
অর্জন করুক। যে ছেলে বাড়িতে পড়ে না, বিদ্যালয়ে পড়ে না, সে কি না প্রাইভেট টিউশনে গিয়ে পড়বে? বাবা–মায়েরা সেখানে সন্তানকে দিয়ে নিশ্চিত। নিজের চোখের উপরে ভরসা হারিয়ে তাঁরা টিউটরকেই জিজ্ঞাসা করেন, ‘‘কেমন পড়ছে ছেলে?’’
তার পরে ‘ভাল কিন্তু একটু অমনোযোগী’ গোছের উত্তর জেনেই সন্তুষ্ট অভিভাবক। এ দিকে সন্তান নিজের মতো করে অবাধে ছকে ফেলছে পরিকল্পনা। বিদ্যালয়ে বছরে তিনটি পরীক্ষায় অবাধে সে যা করেছে তার শাস্তি হয়নি। বোর্ডের পরীক্ষাতেও সেই ধারাবাহিকতা থাকছে। টুকতে না দিলে পাশ করবে কী করে— এই নির্বোধ প্রশ্নের উত্তর কী? আর পাশ করেই বা কী করবে যদি পড়তেই না জানে, যদি কিছু না শেখে? তার পরেও সেই এক গোঁ, ‘কিছু না শিখলেও ক্ষতি নেই কিন্তু পাশ করতেই হবে!’
কিন্তু এ ভাবে পাশ দেওয়া পড়ুয়ার ভবিষ্যৎ কী?
শিক্ষিকা, রঘুনাথগঞ্জ হাই স্কুল