রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে পঞ্চায়েত নির্বাচনের মনোনয়ন ঘিরে অশান্তি। নিজস্ব চিত্র।
বিশ্বাসযোগ্য ভাবে দায়বদ্ধ আমাদের রাজনীতিকরা— এমনটা ভাবতে আমরা প্রায় ভুলেই গিয়েছি। সকলের ক্ষেত্রে না হলেও, অধিকাংশ রাজনীতিকের ক্ষেত্রেই ভুলে গিয়েছি। কিন্তু জনসাধারণের প্রতি বা গণতন্ত্রের প্রতি দায়বদ্ধতা থাক বা না থাক, নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতার প্রতি নিজেদের দায়বদ্ধতাটা থাকা অত্যন্ত জরুরি। রাজনীতিকদের অনেকেই বোধ হয় সেটুকুও আর মনে রাখতে পারছেন না।
পঞ্চায়েত নির্বাচনকে ঘিরে প্রত্যেক বারই উত্তাল হয়ে ওঠে গোটা বাংলা, দুঃসহ রক্তস্রোতে অসহায় হয়ে পড়ে গণতন্ত্র। বাংলার সাম্প্রতিক রাজনীতির গতিপ্রকৃতিটা যে রকম, রাজ্যে শাসক-বিরোধীর সম্পর্কটা যে পর্যায়ে আজ, তাতে রাজনৈতিক হানাহানির অঢেল আশঙ্কা এ বারের পঞ্চায়েত নির্বাচনকে ঘিরেও।
বিরোধী দলগুলি পুলিশে ভরসা রাখতে পারছে না। বছরভরই বিরোধীরা অভিযোগ করেন যে, শাসক দল আর পুলিশ-প্রশাসন মিলে-মিশে একাকার হয়ে গিয়েছে এ রাজ্যে। সে অভিযোগ যে নিতান্তই অমূলক, এমন কথা বলা অত্যন্ত কঠিন। বিরোধীর কোনও শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির সামনে পুলিশের ব্যাঘ্রবৎ উল্লম্ফন আর শাসকের উন্মত্ত তাণ্ডব দেখেও পুলিশের মৃগবৎ পেলবতা মাঝেমধ্যেই রাজ্যবাসীর অপার বিস্ময়ের কারণ হয়ে ওঠে। নির্বাচনী মরসুমে যে পুলিশের আচরণে ওই জাতীয় বিস্ময়কর উপাদান আরও বেশি পরিমাণে খুঁজে পাওয়া যেতে পারে, সে নিয়ে সংশয় নেই বিরোধীদের। সেই কারণেই ভরসার অভাব তথা কেন্দ্রীয় বাহিনীর নজরদারিতে নির্বাচনের দাবি।
কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের দাবি অবশ্য মানা হচ্ছে না। প্রথমে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই জানিয়েছিলেন যে, তাঁর আস্থা পুলিশে। পরে রাজ্য নির্বাচন কমিশনার জানিয়ে দেন যে, তিনি পুলিশে আস্থাশীল। আর তার পর থেকে রাজ্যের মন্ত্রী তথা তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় অকাতরে বলে চলেছেন, পুলিশই সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন উপহার দিতে পারবে।
সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
মনোনয়ন পত্র জমা দেওয়া শুরু হতেই দিনের আলোর চেয়েও স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে, পুলিশ কতটা শান্তিপূর্ণ ভাবে নির্বাচন সামলাবে। কোথাও ম্যাজিস্ট্রেটের সামনেই আক্রান্ত হচ্ছে বিজেপি, কোথাও জেলাশাসকের কার্যালয় প্রাঙ্গনে বিজেপি নেতার উপর সশস্ত্র হামলা হচ্ছে, কোথাও বিজেপি-র জেলা সভাপতিকে বেধড়ক মারধর করা হচ্ছে। ‘শান্তিপ্রিয়’ পুলিশ কোথাওই কোনও অশান্তিতে নিজেদের ‘জড়াচ্ছে’ না।
ঠিক কোন ‘শান্তি’তে ভোট হওয়ার আশ্বাস দিচ্ছেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়রা? বার বার বলা হচ্ছে, পুলিশের তত্ত্বাবধানে শান্তিতে ভোট হবে। আর বাস্তবে মনোনয়ন জমার পর্ব থেকেই রক্তপাত শুরু হয়ে যাচ্ছে!
আরও পড়ুন: বাড়ছে হামলা, পাল্টা মার বিজেপিরও
আরও পড়ুন: প্রতিরোধ জোট বেঁধে, সঙ্কেত বিরোধী ঘরে
পার্থ চট্টোপাধ্যায়রা পরবর্তী কালে বিভিন্ন বিষয়ে যে সব কথা বলবেন, সেগুলি আদৌ আর বিশ্বাসযোগ্য হবে তো? পঞ্চায়েত নির্বাচনকে ঘিরে এখনও পর্যন্ত হিংসার যে ছবি এবং তার প্রেক্ষিতে পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার যে সঙ্গত অভিযোগ, পার্থ চট্টোপাধ্যায়রা সে সব দেখতে পাচ্ছেন না, এমনটা আশা করা যায় কেউ দাবি করবেন না। তা সত্ত্বেও যে ভাবে ‘শান্তিপূর্ণ নির্বাচন’ সংক্রান্ত বয়ানে পার্থবাবুরা অনড় থাকছেন, তাতে তাঁদের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সাংঘাতিক প্রশ্নচিহ্ন উঠে যাচ্ছে। গণতন্ত্রের প্রতি দায়বদ্ধ থাকুন, বা না থাকুন, নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতার প্রতি তো পার্থ চট্টোপাধ্যায়দের দায়বদ্ধ থাকতেই হবে। বিবৃতি দেওয়ার আগে সেই কথাটা অন্তত মাথায় রাখুন।
আরও পড়ুন: মনোনয়নে অস্ত্রের খোঁচা, জখম বিজেপি নেতা
কোন ‘শান্তি’র কথা বলছে রাজ্যের শাসক দল? শ্মশানের ‘শান্তি’? পঞ্চায়েত নির্বাচন ঘিরে যা শুরু হয়েছে, তাতে শুধুমাত্র ওই ধরনের শান্তির দিকেই অগ্রসর হওয়া যায়।
বাংলার মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল চেয়ারপার্সন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিরন্তর সরব হচ্ছেন কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে। নিরন্তর তিনি অভিযোগ তুলছেন যে, কেন্দ্রের শাসক দল গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। বাংলার শাসক দলের বিরুদ্ধেও বাংলার বিরোধী দলগুলি একই অভিযোগ তোলে। কিন্তু পঞ্চায়েত নির্বাচনের দিকে যে ভাবে অগ্রসর হচ্ছে বাংলা, সে ভাবেই চলতে থাকলে অন্য কারও বিরুদ্ধে গণতন্ত্রকে হত্যার অভিযোগ তোলার বিন্দুমাত্র নৈতিক অধিকার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের থাকবে তো?