হি ন্দু না ওরা মুসলিম ওই জিজ্ঞাসে কোন জন? প্রশ্নটি কেবল অর্থহীন অলংকার নয়, একটি ভয়ানক সমস্যা। সওয়া শত বৎসর ধরিয়া ইহা লইয়া কম চর্চা, কম বিতর্ক হয় নাই। তবু ঘুরে ফিরে এই প্রশ্ন বার বার ভারতকে বিপন্ন করে। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের একটি প্যানেলের প্রস্তাব প্রশ্নটিকে আবার সামনে আনিল। প্রস্তাব: আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি এবং বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটির নাম হইতে ‘মুসলিম’ এবং ‘হিন্দু’ শব্দ দুইটি উঠাইয়া দেওয়া হউক। প্রতিক্রিয়া হইল নেতিবাচক। দেশ জুড়িয়া সমালোচনার ঝড় বহিল। দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ ছাত্রছাত্রীরাও সেকুলার পরিচিতির উদ্বোধনের প্রস্তাবে সমর্থন বা উৎসাহ দেখাইলেন না। মনে হইল, হিন্দু বা মুসলিম হিসাবে প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত হওয়ায় অস্বস্তির অপেক্ষা তাঁহাদের গর্বই বেশি। শেষ অবধি কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের তরফে উত্তর আসিল, নেতিবাচক। বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে বদল হইবে না। এক দিক দিয়া ইহা হয়তো আশ্বাসজনক। ইউজিসি একটি নিয়ামক বিভাগ, হিসাবপত্র রীতিনীতি লইয়া তাহার কারবার, নাম পাল্টাইবার সক্রিয়তা তাহার সাজে না। নাম পাল্টাইতে হইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতর হইতেই সে দাবি উঠিয়া আসা উচিত। বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটিতে বেশ বড় সংখ্যাক মুসলিম ছাত্রছাত্রী আছে, হিন্দু ছাত্রছাত্রী আলিগড়েও খুঁজিয়া পাওয়া সম্ভব। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম স্নাতকই ছিলেন হিন্দু। নাম পাল্টাইলে ক্ষতি না লাভ, তাহা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব বৃত্তকেই ভাবিতে হইবে।
প্রসঙ্গত, একটি সতর্কবার্তা। নাম পাল্টাইয়া সমস্যা সমাধান কিংবা সংকট নিরসনের আশা যদি কেহ করিয়া থাকেন, তিনি বা তাঁহারা ঠিক ভাবিতেছেন না। বিএইচইউ দীর্ঘ কাল তাহার নাম শিরোধার্য করিয়াই দেশের অগ্রণী বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অন্যতম ছিল, এএমইউ-ও। দুইটি প্রতিষ্ঠানেরই নামকরণের হেতু ইতিহাসে নিহিত, দীর্ঘ কাল ধরিয়া পড়াশোনা গবেষণার জন্য এই দুই বিশ্ববিদ্যালয় স্বনামধন্য। ক্যাম্পাসের মধ্যেও শান্তিময় সারস্বত পরিবেশই তাহারা এত কাল ধরিয়া রাখিয়াছিল। বর্তমান পরিস্থিতি কিন্তু অনেক আলাদা। বিএইচইউ-তে এখন সরকারি হিন্দুত্ববাদের পরাক্রম প্রবল, কিছু দিন আগের সংবাদ শিরোনামই তাহার প্রমাণ। নাম পরিবর্তিত হইলে কি এই সংকীর্ণ রাজনীতির দাপট হইতে বিএইচইউ রক্ষা পাইবে? মনে হয় না। নামে শেষ অবধি কিছু আসে যায় না, পরিচালনের নিরপেক্ষতাই আসল কথা। হিন্দু বা মুসলিম অভিধা লইয়াও প্রতিষ্ঠান সেই নিরপেক্ষতা বজায় রাখিতে পারে। রাখিতে চাহে কি না, তাহাই আসল প্রশ্ন।
উল্টা বিপত্তিও আছে। নামবদলের সপক্ষে বিশেষ যুক্তি না থাকিলেও এই প্রস্তাবের উত্তরে কেন্দ্রীয় মন্ত্রকের এমন চটজলদি ‘না’ রীতিমত সন্দেহের উদ্রেক করে। যে সরকার রাস্তাঘাট হইতে রেলওয়ে স্টেশন, সব কিছুরই নাম পাল্টাইতে অত্যাগ্রহী, এ ক্ষেত্রে তাহাদের আপত্তির কারণ কী? তবে কি এই নামবিভাজিকা তাহাদের সাহায্যই করিতেছে? বুঝাইয়া দিতেছে, কোনটি সংখ্যাগুরুর ‘গৌরব’, কোনটি সংখ্যালঘুর ‘আস্তানা’? মন্ত্রিবর জাভদেকড় এই সন্দেহ ভঞ্জনের উপযোগী যুক্তি দিতে পারেন নাই। তাই নামবদলে রাজি না হইলেও ধর্মনিরপেক্ষ বিদ্যাচর্চায় এই সরকার রাজি কি না, সেই বড় প্রশ্নচিহ্নটি থাকিয়া গেল।