সম্পাদকীয় ১

আত্মনির্ভর

এই প্রয়োজনের তাগিদই অন্য একটি ঘটনাকে মনে করায়। বিহারেরই ‘মাউন্টেন ম্যান’-এর কাহিনি। গয়া জেলার দশরথ মাঝি মাত্র একটি হাতুড়ি আর ছেনি লইয়া একার প্রচেষ্টায় পাহাড় কাটিয়া রাস্তা নির্মাণ করিয়াছিলেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৩ জুন ২০১৮ ০১:১৭
Share:

অভিধান বলে, ‘আত্মনির্ভর’ কথাটির অর্থ নিজ ক্ষমতার উপরে ভরসা। অন্যের দয়ার উপর নির্ভর না করিয়া মানুষ যখন নিজ প্রয়োজনটি নিজ ক্ষমতার জোরে মিটাইতে চাহে, তাহাকেই আত্মনির্ভরতা বলে। এই শব্দটির অর্থ কোনও বই পড়িয়া জানিতে হয় না, সময় এবং প্রয়োজনই মানুষকে আত্মনির্ভরতার মন্ত্র শিখাইয়া দেয়। যেমন শিখাইয়াছে বিহারের একটি প্রত্যন্ত গ্রামের মহিলাদের। উপর-নিমা নামক গ্রামটির হাসপাতালে যাইবার উপযুক্ত রাস্তা ছিল না। ফলে সঙ্কটাপন্ন রোগী বিপদে পড়িতেন। অনেক সময়ই আসন্নপ্রসবা হাসপাতালের দরজা অবধি পৌঁছাইবার পূর্বে পথেই প্রসব হইয়া যাইত। প্রাণহানির ঘটনাও বিরল ছিল না। অনেক অনুরোধেও কাজ না হওয়ায় রাস্তা নির্মাণে শেষ অবধি গ্রামের মহিলারাই হাতে কোদাল-বেলচা তুলিয়া ধরেন। এবং যে রাস্তাটি সহস্র তদবিরেও ‘সম্ভব’ হয় নাই, আইনি অজুহাত দেখাইয়া ফেলিয়া রাখা হইয়াছিল, প্রয়োজনের তাড়না এবং মেয়েদের একরোখা মনোভাবের যোগফলে তাহা অবশেষে সম্ভব হয়।

Advertisement

এই প্রয়োজনের তাগিদই অন্য একটি ঘটনাকে মনে করায়। বিহারেরই ‘মাউন্টেন ম্যান’-এর কাহিনি। গয়া জেলার দশরথ মাঝি মাত্র একটি হাতুড়ি আর ছেনি লইয়া একার প্রচেষ্টায় পাহাড় কাটিয়া রাস্তা নির্মাণ করিয়াছিলেন। সেই রাস্তাও হাসপাতালে যাইবারই রাস্তা। দশরথ মাঝিকে লইয়া পরবর্তী কালে চলচ্চিত্রও নির্মিত হইয়াছে। কিন্তু পাহাড়-সমান বাধাকে অতিক্রম করিবার এই কাহিনি শুধু দশরথ মাঝিরই নিজস্ব নহে, তাহা প্রত্যন্ত অঞ্চলের বাসিন্দাদের প্রতি দিনের সংগ্রাম। কখনও কোমর-সমান জল ঠেলিবার হাত হইতে বাঁচিতে সেতুনির্মাণে, কখনও পানীয় জল সমস্যার সমাধানে কূপ খননে, কখনও রাস্তা নির্মাণের মধ্য দিয়া তাঁহারা রোজই পাহাড় ভাঙিতেছেন। সেই ভাঙায় অপরিসীম শ্রম আছে, কষ্টও আছে, কিন্তু পরিশ্রমান্তে সুখও আছে। অন্যের দয়ার ভরসায় না বাঁচিবার সুখ। নিজের পায়ে দাঁড়াইবার সুখ।

তবে এই সুখ নিজে নিজে পাওয়াই ভাল। প্রশাসন সেই সুখ এলাকাবাসীর উপর চাপাইয়া দিতে পারে না। হাসপাতালের মতো একটি অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা যাহাতে সেই অঞ্চলের প্রতিটি মানুষ ভোগ করিতে পারেন, তাহা নিশ্চিত করিবার দায়টি আসলে প্রশাসনেরই। কিন্তু প্রশাসনের কর্তারা যদি সেই দায় এড়াইয়া গিয়া ভাবেন— স্থানীয় মানুষ নিজের প্রয়োজন নিজেই মিটাইয়া স্বনির্ভর হইবার সুখটি ভোগ করুন, তাহা ভয়ানক অন্যায়। অথচ বাস্তবে দেখা যায়, প্রায়শই তেমনটা হইতেছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষদের প্রয়োজনে অনেক সময়ই প্রশাসন উদাসীন বসিয়া থাকে। সর্বশিক্ষা অভিযানের ঢালাও প্রচার চলিতেছে, অথচ দেখা যায়, শিশুদের এলাকার একমাত্র বিদ্যালয়ে পৌঁছাইবার পথটি একেবারেই চলাচলের অনুপযুক্ত, কিংবা জরাজীর্ণ স্কুলবাড়িটিতে বসিয়া ক্লাস করা দুষ্কর। বাড়িতে প্রসবের বিভিন্ন ক্ষতিকর সম্ভাবনার কথা বলিয়া প্রসূতিকে হাসপাতালে লইয়া যাইবার সুপরামর্শ দেওয়া হইতেছে, অথচ ভরা বর্ষায় গ্রামের রাস্তা দিয়া আসন্নপ্রসবা কী ভাবে হাসপাতাল পৌঁছাইতে পারিবে সেই বিষয়ে প্রশাসনের ভাবনা নাই। কর্তারা যখন সকলের ভাল করিতে চাহেন, তখনও সেই ভাল করিবার সমগ্র আয়োজন লইয়া ভাবেন না। এই কারণেই বহু ভাল কাজের সুফল যথাস্থানে পৌঁছয় না। যেমন, স্থানীয় রাস্তার অভাবে প্রসূতিদের দুর্ভোগ চলিতেই থাকে। উপর-নিমার দৃষ্টান্ত হইতে শিক্ষা লইয়া দেশের বিভিন্ন এলাকার বিভিন্ন স্তরের প্রশাসন যদি নিজ হাতে শাবল গাঁইতি তুলিয়া লয়, তবে কাজের কাজ হইবে। প্রশাসনের কর্তারা তখন অকৃত্রিম সুখ লাভ করিবেন। দায়িত্ব পালনের সুখ।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement