ডুবন্ত জাহাজ ছেড়ে একে একে পালাতে শুরু করেছেন সবাই, এমনটা বলার সময় এখনও আসেনি। কারণ জাহাজটা ডুবন্ত নয় মোটেই। সব যাত্রীই জাহাজ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, এমনটাও নয়। কিন্তু অসন্তোষ যে ক্রমশ বাড়ছে, তা স্পষ্ট। ক্ষোভ এতটাই যে, কেউ বিচ্ছেদ ঘোষণা করে দিচ্ছেন, কেউ বিচ্ছেদের হুঁশিয়ারি দিয়ে রাখছেন। পরিস্থিতি কেন এমন, এখনই তলিয়ে ভাবতে হবে প্রধান নাবিককে। না হলে অনেক দেরি হয়ে যেতে পারে।
বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ এই মুহূর্তে সাফল্যের তুঙ্গে। ভারতের যতগুলি রাজ্য এখন বিজেপি তথা এনডিএ-র শাসনে, এর আগে কখনও ততগুলি রাজ্যে একসঙ্গে ক্ষমতায় আসেনি এই জোট। সংসদেও রয়েছে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা, এনডিএ-র ইতিহাসে বেনজির। এত সচ্ছল যে সংসার, সেখানে পর পর কেন মাথাচাড়া দেবে সমস্যা? কেনই বা কোনও সমস্যাই মিটবে না সহজে? কেনই বা ফাটলগুলো মিলিয়ে যাওয়ার বদলে প্রতিটি ক্ষেত্রে শুধু প্রশস্তই হতে থাকবে? এনডিএ নেতৃত্বকে তথা বৃহত্তম শরিক বিজেপি-কে কিন্তু এখন তলিয়ে ভাবতেই হবে এ বিষয়টা। উত্তরটা যত দ্রুত সম্ভব খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করতে হবে।
বিজেপি-র সবচেয়ে পুরনো জোটসঙ্গী শিবসেনা ইতিমধ্যেই বিচ্ছেদের কথা ঘোষণা করে দিয়েছে। পরবর্তী নির্বাচন আর জোট বেঁধে নয়, জানিয়ে দিয়েছে উদ্ধব ঠাকরের দল। মহারাষ্ট্রের এই ধাক্কার রেশ কাটতে না কাটতেই জোটে অশান্তির ইঙ্গিত অন্ধ্রপ্রদেশ থেকেও। তেলুগু দেশম প্রধান তথা অন্ধ্রের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নায়ডু নিজে সাংবাদিক সম্মেলন করে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। বিজেপি যদি জোটের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে থাকে, তা হলে তেলুগু দেশম পার্টিরও কোনও দায় নেই জোট টিকিয়ে রাখার— এমনই বার্তা দিয়েছেন চন্দ্রবাবু।
আরও পড়ুন
প্রয়োজনে পথ দেখে নেব, এ বার বিজেপিকে হুঙ্কার টিডিপির
সমস্যা যে শুধু শরিকদের নিয়ে, তা নয়। সমস্যা বিজেপি-র অন্দরেও। মাসখানেক আগে সম্পন্ন হওয়া গুজরাত বিধানসভা নির্বাচন চোখে আঙুল দিয়ে তা দেখিয়ে দিয়েছে। দশকের পর দশক বিজেপি-র প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে এসেছে গুজরাতের যে পটেল সমাজ, এ বারের বিধানসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদীর নিজের রাজ্যে বিজেপিকে সবচেয়ে বড় ধাক্কা দিয়েছেন সেই পটেলরাই।
দুর্দিনেও সঙ্গে ছিলেন যাঁরা, সুখের দিনে অকারণে নিশ্চয়ই তাঁরা জোট ছেড়ে বেরিয়ে যাবেন না। প্রবল প্রতাপান্বিত শাসক জোট ছেড়ে খামোখা বেরিয়ে যাওয়া যে অবান্তর বিলাসিতা, যে কোনও রাজনৈতিক দলই তা খুব ভাল ভাবেই বোঝে। তা সত্ত্বেও জোটে ও ভোটে জটিলতা দিন দিন বাড়ার ইঙ্গিত মিলছে।
সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
সমস্যাটা আসলে সবাইকে নিয়ে চলতে না পারার মানসিকতায় নিহিত। সবার মতামত নিয়ে চলা, রাষ্ট্রচালনায় সব পক্ষের উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব সুনিশ্চিত করা, ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর গোষ্ঠীর আশা-আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটানোর প্রতিও যত্নশীল থাকা— জোট সরকার চালানোর জন্য এই বিষয়গুলি মাথায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। এই জরুরি বিষয়গুলিকে মাথায় রেখে বিজেপি আগেও জোট চালিয়েছে, লোকসভায় বিজেপি-র একক গরিষ্ঠতা না থাকা সত্ত্বেও সফল ভাবে এনডিএ সরকার মেয়াদ পূর্ণ করেছে। কিন্তু এ বারের এনডিএ সরকারের চেহারা আগেকার সেই এনডিএ সরকারের চেয়ে অনেকটাই ভিন্ন। সরকারের নেতৃত্বে প্রবল প্রতাপশালী নরেন্দ্র মোদী, এনডিএ-র নেতৃত্বে একক ভাবে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করা বিজেপি। সেই কারণেই সম্ভবত সকলের মতামতকে সমান গুরুত্ব দিয়ে চলার তাগিদ কম। নীতিগত ভাবেও অনেক বেশি আগ্রাসী রাজনীতিতে অভ্যস্ত আজ বিজেপি। জোটের ভিতরে হোক বা জোটের বাইরে, সংসদের ভিতরে হোক বা সংসদের বাইরে, কেন্দ্রে হোক বা রাজ্যে— সব ক্ষেত্রেই বিজেপি নিজের মত যে কোনও উপায়ে প্রতিষ্ঠা করতে তৎপর আজ। আমি বা আমরা যা বলছি, সেটাই ঠিক, আমি বা আমরা যা চাইছি, সে রকমই হবে, আমার বা আমাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছাই শেষ কথা— বিজেপি-র অনুচ্চারিত বার্তা আজ অনেকটা এই রকমই। এই রাজনৈতিক অবস্থান দম্ভ এবং ঔদ্ধত্যের নামান্তর। ভারতের মতো সুবিশাল এবং অঢেল বৈচিত্রের গণতন্ত্রে এই ধরনের রাজনৈতিক অবস্থান কখনওই জনপ্রিয় হতে পারে না।
সর্বস্তরে দলতন্ত্র কায়েম করার চেষ্টা করছে বিজেপি। লোকসভায় বিজেপি-র একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে গোটা দেশের গৈরিকীকরণ ঘটাতে চাইছে সংঘ পরিবার। সর্বস্তরে বিজেপি-র রাজনৈতিক কর্তৃত্ব যে কোনও উপায়ে সুদৃঢ় ভাবে প্রতিষ্ঠা করার নীতি নেওয়া হয়েছে আজ। এই একদলীয় আধিপত্য কায়েমের চেষ্টাকে রাজনৈতিক মৌলবাদ বললে ভুল বলা হয় না। রাজনৈতিক মৌলবাদ এবং রাজনৈতিক দম্ভ এ গণতন্ত্রে সবর্দাই সযত্নে বর্জনীয়। বিজেপি নেতৃত্ব সম্ভবত সে কথাটা মনে রাখতে পারছেন না। তবে মাথায় রাখা দরকার, সামনের বছরই সাধারণ নির্বাচন দেশে। কলহ-কোন্দল-মন কষাকষি অবিলম্বে মিটিয়ে ফেলে ঐক্যবদ্ধ এনডিএ-র ছবি নির্বাচনের আগে তুলে ধরতে না পারলে বড়সড় বিপর্যয় অপেক্ষায় থাকতে পারে। অতএব, বিজেপি-র জন্য আত্মবিশ্লেষণে জোর দেওয়ার সঠিক সময় এটাই।