মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী
মহারাজ বাহাদুর কিছুদিন যাবৎ ম্যালেরিয়াতে আক্রান্ত হয়ে কাশিমবাজারেই অবস্থান করছিলেন। কিন্তু সেখানে রোগ শান্তির কোনও সম্ভাবনা না দেখে তাঁকে কলকাতায় চিকিৎসার জন্য এনে ডাক্তার নীলরতন সরকার মহাশয়ের চিকিৎসাধীনে রাখা হয়। কিন্তু স্বয়ং মহাকাল যাকে আহ্বান করেছেন, তাঁঁকে কে ধরে রাখবেন? অবশেষে ১৯২৯ খ্রিস্টাূীগব্দের ১১ নভেম্বর, সোমবার মধ্যরাত্রির পরে ১টা ২২ মিনিটে সেই মহাকালের আহ্বানে মহারাজ সাধনোচিত ধামে গমন করলেন। বাঙালির মান, বাঙালীর গর্ব, বাঙালির আপনার থেকেও আপনার বলে অহঙ্কার করার মতো যা কিছু কালের অমোঘ দণ্ডাঘাতে তা ভুলুণ্ঠিত হল। তাঁর এই অকস্মাৎ প্রয়াণে অবিভক্ত বাংলার আকাশ বাতাস শোকচ্ছায়ায় তন্ময় হয়ে যায়।
বহরমপুরের প্রবীণ ব্যবহারজীবী কালীকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে গ্রান্ট হলে বহরমপুর অধিবাসী কর্তৃক একটি শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। মহারাজের মৃত্যুসংবাদ শোনামাত্র কৃষ্ণনাথ কলেজের অধ্যাপক ও ছাত্রবৃন্দ মিলিত হয়ে গভীর শোকপ্রকাশ করেন। কৃষ্ণনাথ কলেজ ও স্কুলও সাত দিনের জন্য বন্ধ রাখা হয়। ১৫ নভেম্বর বিকেলে কলকাতা টাউন হলে এক বিরাট শোকসভা আহুত হয়। সুভাষচন্দ্র বসু তাঁর মৃত্যুসংবাদে মর্মাহত হয়ে বলেন, ‘‘বর্তমান রাজনীতির সঙ্গে মহারাজের তেমন ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ ছিল না বটে, কিন্তু স্বদেশী আন্দোলনের যুগে সর্ব্বপ্রথম বিদেশী বর্জ্জন সভার সভাপতিরুপে তাঁহার নাম বাঙ্গালী চিরদিন মনে রাখিবে। মহারাজ দেশের সেবায় তাঁহার সর্ব্বস্ব দিয়া গিয়াছেন।’’
মফস্্সল, কলকাতা ও কলকাতার বাইরে বহু সাময়িক, দৈনিক ও মাসিক পত্রিকার সম্পাদকগণ নিজ নিজ পত্র-পত্রিকায় স্বর্গীয় মহারাজার মৃত্যুতে শোকপ্রকাশপূর্ব্বক শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছিলেন। এ সম্পর্কে আনন্দবাজার পত্রিকা ১৩৩৬ বঙ্গাব্দের ২৭শে কার্তিক, বুধবার সংখ্যায় ‘মহারাজ মণীন্দ্রচন্দ্র’ শিরোনামে উল্লেখ করে, ‘...অল্পদিন পূর্ব্বে বিশ্ববিদ্যালয়ে মহারাজ মণীন্দ্রচন্দ্রের তৈলচিত্র উন্মোচন উপলক্ষে ভাইসচ্যান্সেলার ডাঃ আর্কোহার্ট বলিয়াছিলেন, শিক্ষা বিষয়ে এদেশে মহারাজ যে দান করিয়াছেন, তাহার তুলনা নাই। একদিকে দীন-দুঃখীর প্রতি তাঁহার অসাধারণ দয়া, অন্যদিকে গভীর স্বদেশপ্রেম— এই দুই ভাব হইতেই তাঁহার এই বিরাট দান সম্ভবপর হইয়াছিল। ...তিনি ছিলেন পরম বৈষ্ণব এবং মহাপ্রভু শ্রীগৌরাঙ্গের প্রেমধর্ম যাহাতে দেশমধ্যে সুপ্রচারিত হয়, এজন্য তাঁহার প্রবল আগ্রহ ছিল। বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার এবং দুষ্প্রাপ্য বৈষ্ণব শাস্ত্র প্রকাশ করিবার জন্য তিনি বহু অর্থ ব্যয় করিয়া গিয়াছেন ...।’
আবার ‘সঞ্জীবনী’ পত্রিকা ১২ নভেম্বর সংখ্যায় ‘পরলোকে কাশিমবাজারের মহারাজা’ শিরোনামে লেখে, ‘...প্রসিদ্ধ ‘বেঙ্গলী’ সংবাদপত্র যখন মুমূর্ষু তখন তিনি তাহার একজন প্রধান স্বত্বাধিকারী হইয়া উহার জীবন রক্ষা করিয়াছিলেন। মৃত্যুকাল পর্যন্ত তিনি বেঙ্গলীর স্বত্বাধিকারী ছিলেন। তিনি এবং রায় বাহাদুর বৈকুন্ঠনাথ সেন বেঙ্গল পটারী ওয়ার্কসের সংস্থাপনকর্তা। বাঙ্গালাদেশে চীনামাটির বাসন তৈয়ারীর সর্ব্বপ্রকার উপাদানই আছে কিন্তু উৎসাহ ও অর্থের অভাবে বাঙ্গালাদেশের কেউই চীনামাটির দ্রব্য তৈয়ার করিতে অগ্রসর হয় নাই। বেঙ্গল পটারী ওয়ার্কস তাঁহার এক মহৎ কীর্ত্তি। ...বিদ্যা শিক্ষার সঙ্গে ব্যবসায় ও শিল্প শিক্ষা প্রদান করিলে অনেক বালক ছাত্রাবস্থাতেই উপার্জ্জনশীল হইয়া বিদ্যাচর্চ্চা করিতে পারে, এই উদ্দেশ্যে তিনি বাগবাজারে পলিটেক্্নিক স্কুল স্থাপন করিয়াছিলেন...।’
অন্যদিকে, ‘বাংলার বাণী’ ঢাকা, ১৪ নভেম্বর, ১৯২৯ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়, ‘...বাংলার জাতীয় প্রচেষ্টার সকল স্তরে তাঁহার দানশক্তির পর্যাপ্ত পরিচয় রহিয়াছে। ‘দানে নিঃস্ব মণীন্দ্র’ কবির একথা অতি সত্যি। বাংলার শিল্প-বাণিজ্য সাহিত্য ধর্ম-শিক্ষা রাজনীতি সকল দিকেই তাঁহার অকৃত্রিম অনুরাগ ছিল, সকল দিকের জন্যই তিনি মুক্তহস্ত ছিলেন। ...কিন্তু তিনি তাঁহার দেশবাসীর অন্তরস্মৃতিপটে চিরজীবী হইয়াই থাকিবেন।’
মহারাজার প্রয়াণে ‘প্রবাসী’র ১৩৩৬ বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ণ সংখ্যায় ‘মহানুভব মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী’ শিরোনামে বলা হয়, ‘... তাঁহার কথা ভাবিলে প্রথমেই মনে পড়ে, তাঁহার বিরাট দানযজ্ঞের কথা। এত বড় দাতা আধুনিক ভারতে দেখা যায় না। তিনি জীবিতকালেই এক কোটির অধিক দান করিয়া গিয়াছেন। মহাত্মাগান্ধী বলিয়াছেন, দানশীল পার্শীদিগের মধ্যেও ইঁঁহার মত দাতা দেখা যায় না ...।’
১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের ১৫ নভেম্বর ‘নবশক্তি’ পত্রিকায় ‘মহারাজা মণীন্দ্র নন্দী’ শিরোনামে লেখা হয়, ‘... দেশের শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্য, ধর্ম্ম, পন্ডিত, অক্ষম সকলের চাই অর্থ। কে দেবে?-মহারাজা মণীন্দ্র নন্দী। ...তিনি ছিলেন কলির দাতাকর্ণ, মানবতার জীবন্ত বিগ্রহ, আজ তাঁর আত্মার উদ্দেশ্যে আমরা শ্রদ্ধাঞ্জলী নিবেদন করছি আর মনে মনে ভাবছি এতখানি উদারতা এতখানি মানবতা নিয়ে আর কি কোন রাজা মহারাজা বাঙালীর দুঃখ দুর্দ্দশা ঘুচাবার জন্য সর্ব্বস্ব পণ করবেন?’
‘হিতবাদী’ পত্রিকাও কিন্তু মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর প্রয়াণ তর্পণে অংশ নেয়। ১৫ নভেম্বর, পত্রিকায় লেখা হয়, ‘... শিক্ষায় মহারাজ মণীন্দ্রচন্দ্রের সমকক্ষ বঙ্গদেশে আর কয়জন আছেন? এহেন মহানুভবের মৃত্যুকে বঙ্গের একটা ‘ইন্দ্রপাত’ বলিলে অত্যুক্তি হয় কি? কোন্ দিকে তাঁহার দৃষ্টি ছিল না? সাধারণ শিক্ষা বিস্তারের জন্য স্কুল ও কলেজ, আয়ুর্ব্বেদের পুনরুদ্ধার ও উন্নতির জন্য ‘গোবিন্দসুন্দরী আয়ুর্ব্বেদ বিদ্যালয়’, শিল্পশিক্ষার জন্য ‘পলিটেক্্নিক ইনস্টিটিউট’ কত নাম করিব?’
অন্যদিকে, ‘The Statesman’ পত্রিকায় ১২ নভেম্বর সংখ্যায় ‘Death of Maharaja of Cossimbazar’ শিরোনামে লেখা হয়, ‘... When the Great War broke out the Maharaja did his share of the work in connexion with the raising of war Loans and organising the resources of the country. ln order to afford relief to disabled soldiers in the field he and the members of his family paid for several units, and from August 1915 to November 1918 the Maharaja and the Maharani regularly contributed to the Carmichael Bengal Women's War Fund...।’
আবার, ১৩ নভেম্বর The Amrita Bazar Patrika (Editorial), ‘Maharaja of Cossimbazar’ শিরোনামে উল্লেখ করে, ‘The Maharaja was a friend of the poor. His heart melted at the sight of misery.Those who have seen him at the Cossimbazar Rajbati have found him surrounded at all Hours of the day by
the needy...’।
এ ভাবেই, ‘ভারতের সাধনা’, ‘স্বায়ত্বশাসন’, ‘ঋত্বিক’, ‘দৈনিক বসুমতী’, ‘Corporation of Calcutta’ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় চলতে থাকে প্রয়াণতর্পণ, অন্যদিকে বাঙ্গলা দেশের বিভিন্ন স্থানে আহুত হতে থাকে শোকসভা।
শিক্ষক, কৃষ্ণনাথ কলেজ স্কুল
গ্রন্থ ঋণ: মহারাজ মণীন্দ্রচন্দ্র, শ্রী সাবিত্রীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়।