পরিবেশ রক্ষায় গাছকে ভালবাসুন

দূষণের ভয়াবহ পরিণামের কথা ভেবে সচেতন মানুষ আতঙ্কিত। কী উপায়ে এই সমস্যার মোকাবিলা সম্ভব তা নিয়ে ভাবনা, পরিকল্পনার শেষ নেই। বিশ্ব পরিবেশ দিবসও পালন হয় এখন সমারোহে। কিন্তু সমস্যার শিকড় উপড়ে সুস্থ পরিবেশ গড়তে ব্যবহারিক শিক্ষায় আরও জোর দিতে হবে। লিখলেন ঈশানচন্দ্র মিশ্র আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদের অন্যতম উপকরণ হলো বাতাস। কিন্তু বাতাসে দূষণের বিষ বিশ্বজুড়ে। আমাদের রাজ্যে গ্রামাঞ্চলেও এখন বায়ু দূষণের মাত্রা অনেক বেশি।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৬ ডিসেম্বর ২০১৯ ০২:১১
Share:

গাছই বন্ধু। নিজস্ব চিত্র

প্রাচীনকালে মানুষ এবং প্রকৃতির মধ্যে একটা নিবিড় সম্পর্ক ছিল। সেকালে প্রকৃতি এবং মানুষের মাঝে কোনো সংঘাত ছিল না। কিন্তু সামপ্রতিককালে পরিবেশ এবং মানুষের মধ্যে সে সম্পর্কের অবসান ঘটেছে। মানুষ প্রকৃতির দাস। কিন্তু বর্তমান সময়ে এর উল্টোটাই দেখা যাচ্ছে। মানুষ প্রকৃতির প্রতি বিভিন্নভাবে অত্যাচার এবং ধ্বংসাত্মক কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। পরিবেশমুলক সমস্যাগুলো ভয়ংকর রূপ ধারণ করে চলেছে। বিজ্ঞানীদের মতে, একটি সুস্থ প্রাকৃতিক পরিবেশ গড়ে তুলতে হলে মোট সে দেশের জমির তেত্রিশ শতাংশ বনাঞ্চল থাকা উচিত। তাহলেই প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব। দেশের কথা ছেড়েই দিলাম, যদি ৪৫৪৫ বর্গকিলোমিটারের বীরভূম জেলাটিকেই দেখা যায় তাহলে পাঁচ বছর আগে এই জেলার প্রাকৃতিক বনরাজি আর বর্তমান অবস্থা খতিয়ে দেখলেই স্পষ্ট হবে বদলে যাওয়া ছবিটা। সরকারি, বেসরকারি উদ্যোগে বৃক্ষরোপণ হচ্ছে কিন্তু তার অধিকাংশেরই জীবনকাল সেই উদ্যোগ প্রচারের আলোয় আসার সময়টুকু। তারপর তাকে বাঁচিয়ে রাখার প্রবণতা কম।

Advertisement

আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদের অন্যতম উপকরণ হলো বাতাস। কিন্তু বাতাসে দূষণের বিষ বিশ্বজুড়ে। আমাদের রাজ্যে গ্রামাঞ্চলেও এখন বায়ু দূষণের মাত্রা অনেক বেশি। ক্রবর্ধমান নগরায়ণ, অধিকহারে যানবাহন বৃদ্ধি বায়ু দূষণের জন্য দায়ী। কলকারখানার ধোঁয়া, যানবাহনের ধোঁয়া বায়ু দূষণের প্রধান কারণ। এতে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ প্রতিনিয়ত বাড়ছে। ফলে আবহাওয়ায় তাপমাত্রাও ক্রমেই বেড়ে চলেছে।

বায়ু দূষণ আমাদের স্বাস্থ্যের প্রতি স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদী দুইভাবে আক্রান্ত করতে পারে। কেউ বায়ু দূষণ থেকে মুক্ত নয় তবে শিশু ও বৃদ্ধরা বেশি ক্ষতির শিকার। বায়ু দূষণের কারণে মানুষের অ্যাজমা, হার্ট ও ফুসফুসে সমস্যা দেখা দেয়। বায়ু দূষণের কারণে স্বল্প মেয়াদে চোখ ও নাকে ব্যথা হয়। এছাড়া ব্রঙ্কাইটিস ও নিউমোনিয়ার মতো মারাত্মক রোগ হয়। এছাড়া অকাল-বর্ষণ, কুয়াশা এরই ফল। এ রকম আবহাওয়ায় চাষবাস হয় অনিশ্চিত।

Advertisement

আধুনিক বিজ্ঞানের আর্শীবাদে কৃষিক্ষেত্রে সবুজবিপ্লব ঘটেছে। কিন্তু উৎপাদন বৃদ্ধি করতে গিয়ে জমিতে নানা প্রকারের রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে, এর ফলে মাটি দূষিত হচ্ছে। সারা বছর জমিতে সেচব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য বহু নদীতে বাঁধ দিয়ে নদীর গতিকে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে, এতে একদিকে যেমন নদীর জল দূষিত হচ্ছে অন্যদিকে মাটির দূষণও হচ্ছে। রাসায়নিক সার দিয়ে তৈরি কৃষিজাত সামগ্রী থেকে নানা ধরনের রোগ সৃষ্টি হচ্ছে।

মাটি দূষণের ফলে আমারা বিভিন্ন ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। যেমন মাটি দূষণের ফলে ফসল উৎপাদন বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। গাছপালা মরে যাচ্ছে। যদিও খাদ্য উৎপাদন হচ্ছে, তবুও খাদ্যের পুষ্টিমান নষ্ট হচ্ছে। দূষিত মাটিতে উৎপাদিত ফসল ও শাকসবজি খেলে মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়।

দূষিত হচ্ছে জলও। সচেতনতার অভাব ও অলসতাই মূলত দূষণমুখী করছে আমাদের বাসস্থানকে। নদী বা জলাশয়কে আমরা না জলজ প্রাণীর বাসযোগ্য রাখছি না আমাদের জন্য স্বাস্থ্যকর থাকছে। প্রবহমান নদীগুলো দূষিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ভূমি অবক্ষয় দেশের পরিবেশজনিত একটি গভীর সমস্যা। নদীগুলোর তীর ভাঙনের ফলে মাটি ভরাট হয়ে নদীর গভীরতা কমে আসছে। ফলে নদীর জল ধারণের ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। বন্যা এক ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করছে। দেশের মূল নদীগুলোর বুকে প্রতি বছর হাজার হাজার টন মাটি খসে পড়ে। এর ফলে নদীর গভীরতা কমে আসছে এবং বন্যা সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলছে।

একই সঙ্গে মাথায় রাখতে হবে পরিবেশের ভারসাম্য হারাতে থাকার ফলেই ব্যাধি আজ মানুষের জীবনকে ভরে দিয়েছে দুর্বিসহ অভিশাপে। হাঁপানি, শ্বাষকষ্ট, ইনফ্লুয়েঞ্জা তো বর্তমান নগরবাসীর নিত্যসঙ্গী। ঔষধ-বিজ্ঞান ও চিকিৎসাশাস্ত্র সেখানে অসহায়। এমনকি, সুস্থ সন্তানের জন্ম এবং তার সুস্থ বিকাশ এই দূষিত বায়ুমণ্ডলের মধ্যে কখনও সম্ভব নয়। দূষিত বায়ুমণ্ডল নানা রোগ জীবাণুর বংশবিস্তারের স্বর্গভূমি। কাজেই পৃথিবীতে মানুষের সুস্থ জীবনের প্রতিশ্রুতি দিনের পর দিন হয়ে আসছে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর।

পরিবেশ শিক্ষা তুলনামূলকভাবে একটি নতুন অধ্যয়নের ক্ষেত্র। মানব সভ্যতার বিকাশ প্রক্রিয়ায় সমান্তরালভাবে উদ্ভুত পরিবেশজনিত সমস্যাগুলোর সঙ্গে মোকাবিলা করতে হলে পরিবেশ শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা আজ সবাই উপলব্ধি করছেন। পরিবেশ শিক্ষা পরিবর্তিত পৃথিবীর প্রতি দায়িত্বশীল এবং জীবনজোড়া শিক্ষা। পরিবেশকে সংরক্ষণ এবং উন্নয়নের ক্ষেত্রে মানুষের জ্ঞান-অভিজ্ঞতা বৃদ্ধি করে একটি সুস্থ পৃথিবী গড়াটাই শিক্ষার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিৎ। পরিবেশ শিক্ষাই মানুষ এবং পরিবেশের মধ্যে আন্ত:সম্পর্কের বিষয়ে সচেতনতা, জ্ঞান, কৌশল এবং উপযুক্ত মনোভাবসম্পন্ন ব্যক্তি গড়ে তুলতে সাহায্য করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, শিশু অবস্থা থেকেই যদি পরিবেশ এবং মানুষের মধ্যের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া তথা পারস্পরিক নির্ভরশীলতার কথা বোধগম্য করে তুলে দেওয়া যায় তবে পরিবেশীয় সমস্যা সমাধানের পথ আপনাআপনিই বেরিয়ে আসবে। মানুষ পৃথিবীর বুকে থাকা সম্পদগুলোর ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ আনতে চাইছে। বন-জঙ্গল থেকে আমরা জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করি। গাছপালা প্রকৃতির শোভাবর্ধক এবং মানুষের বেঁচে থাকার সহায়কও বটে। আমাদের আশপাশে অনেক জায়গা আছে যেখানে গাছপালা লাগানো যায়। এটা আমাদের পরিবেশকে সুন্দর ও মনোরম করবে। কিন্তু আমরা সেদিকে লক্ষ্য করি না।

‘সবুজ বিপ্লব’-এর প্রতি অনুপ্রেরণা দেওয়া হচ্ছে কিন্তু যথেষ্ট সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। বনের গাছপালা থেকে শুধু কাঠ, রাবার, ওষুধ বা ফলমূলই সংগৃহীত হয় না, এগুলো থেকে বিভিন্ন ধরনের তেলও আহরণ করা হয়। গাছ কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে বাতাস নির্মল করে এবং অক্সিজেন ছাড়ে, যা মানুষের বেঁচে থাকার নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। গাছ আমাদের জন্য বিশেষ উপকারী। ভূমিক্ষয় রোধ, জমির উর্বরতা বৃদ্ধি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসের প্রকোপ কমাতে গাছপালা সহায়তা করে। প্রাকৃতিক পরিবেশকে শীতল, সুন্দর, মনোরম ও সুস্বাস্থ্যকর রাখতে গাছ বিশেষ ভূমিকা পালন করে। বিভিন্ন ধরনের গাছগাছড়া, লতাপাতা ইত্যাদি ওষুধ হিসেবেও ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তাছাড়া বিভিন্ন গাছের ফুল থেকে মধু আহরণ করে মৌমাছি মানুষের ব্যবহারের জন্য একটি উৎকৃষ্ট এবং উন্নতমানের খাদ্য প্রস্তুত করে। স্কুল পাঠ্যক্রমে এসব বিষয় ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত করলে ছোটবেলা থেকেই শিক্ষা গ্রহণ করে পরবর্তী পর্যায়ে সবাই ভূমিকা রাখতে পারবে।

পরিবেশ রক্ষার দায় সর্বাগ্রে মানুষেরই। কিছু মানুষের অপরিণামদর্শী কার্যকলাপের জেরে পরিবেশের উপর যে আঘাত আসছে এর ভবিষ্যৎ পরিণাম হতে পারে আরও ভয়াবহ। কাজেই সতর্ক হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। গাছ আমাদের জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তাই গাছকে আমাদের ভালবাসতেই হবে।

লেখক: বিশ্বভারতীর প্রাক্তনী ও পরিবেশকর্মী, মতামত নিজস্ব

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement