দেখতে দেখতে কেটে গেল পৌনে এক বছর। অতিমারির ঊর্ধ্বমুখী গতি অব্যাহত। দ্বিমত নেই, এই পরিস্থিতির সবচেয়ে বড় শিকার, অন্তত আমাদের দেশে, স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা। খাস রাজধানী শহরগুলোতেও এমন অঞ্চল আছে, যেখানে স্মার্টফোন অলীক স্বপ্নমাত্র। আর প্রত্যন্ত অঞ্চলে নেট-সংযোগ আকাশকুসুম ছাড়া কিছু নয়। যাঁরা শিক্ষাদানের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িত, তাঁরা জানেন, শিশুর শিক্ষালাভের পথে প্রত্যেকটি সোপান কী ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। ভিত পাকা হয়ে গেলে উঁচু ক্লাসের ছাত্রছাত্রীরা অনেকটা নিজে থেকে সংগ্রহ করে নিতে পারে। কিন্তু বাড়ের সময়ে আলো জল না পেয়ে যে চারাগাছটি শুকিয়ে গেল, তার ভবিষ্যতে ফুলে-ফলে পল্লবিত হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। ভারতের বিপুল জনসংখ্যার কথা ভাবলে বলতে হয়, মানবসম্পদের এত বড় অপচয় সমাজের অপূরণীয় ক্ষতি।
অন্যান্য বিষয়ে যেমন আনলক প্রক্রিয়া রাজ্যের বিবেচনা ও পরিস্থিতি অনুযায়ী বলবৎ হয়েছে, শিক্ষার ক্ষেত্রেও সেটি করাই বিধেয়। অনেক সময় অতিক্রান্ত। তাই দ্রুত একটি শিক্ষা-মানচিত্র প্রস্তুত করা প্রয়োজন। এর জন্য প্রত্যেক জেলার জেলা-পরিদর্শক কার্যালয় থেকে একটি বিশেষ দল গঠন করতে হবে, যে দলে বিভিন্ন ব্লক, পঞ্চায়েত, মিউনিসিপ্যালিটির প্রতিনিধিরা থাকবেন। তাঁরা নিজের এলাকার স্কুলে যারা দারিদ্র বা প্রযুক্তিগত অসুবিধার জন্য অনলাইন শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে না, সেই ছাত্রদের একটা তালিকা তৈরি করবেন।
পরবর্তী পদক্ষেপ স্কুল চালু। স্যানিটাইজ়েশন ও পরিচ্ছন্নতার ভার শুধু স্কুলগুলির উপর ছেড়ে না দিয়ে ওয়ার্ডের পুরপিতা ব্যাপারটির তত্ত্বাবধান করবেন। একটি শ্রেণিকক্ষে এক বারে ২০ জনের বেশি ছাত্র হলে পারস্পরিক দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব নয়। তাই প্রতি ব্যাচকে সপ্তাহে তিন দিন আনা যাবে। অনেক স্কুলে এক-একটি ক্লাসে ৬০-৭০ জন ছাত্র থাকে। সে ক্ষেত্রে সপ্তাহে দু’দিন করে এক-একটি ব্যাচ আসবে। এই শিশুরা প্রায় এক বছর পাঠ থেকে বহু দূরে ছিল। ফলে আগে যাচাই করে নিতে হবে, কতটা দক্ষতা তারা ধরে রাখতে পেরেছে। হঠাৎ পাঠ্যক্রম অনেক কমিয়ে কোনও মতে একটা পরীক্ষা নিয়ে ক্লাসে তুলে দিলে সমস্যা বাড়বে বই কমবে না। শ্রেণির বিভাগটাও তাই নতুন করে করতে হবে। অর্থাৎ, যারা কিছুটা দক্ষতা ধরে রাখতে পেরেছে, তারা থাকবে এক ক্লাসে; আবার যারা প্রায় সবটাই বিস্মৃত হয়েছে, তারা থাকবে নীচের শ্রেণিতে। এতে তাদের মধ্যে যাতে ব্যর্থতার বোধ না জাগে, সে বিষয়ে কিছুটা কাউন্সেলিং করাও প্রয়োজন।
কিন্তু স্কুল মানে তো শুধু ক্লাসে বসে পড়াশোনা নয়। স্কুল মানে ভাগ করে টিফিন খাওয়া, ভাগাভাগি করে গল্পের বই পড়া, হাতে হাত রেখে চলা। এই নতুন ব্যবস্থায় শিক্ষকদের দায়িত্ব অনেক বেড়ে যাবে, সন্দেহ নেই। শাসন নয়, সেই কাউন্সেলিং-এর সাহায্যই নিতে হবে এ ক্ষেত্রেও।
পাঠ্যক্রমের বিষয়টি নিয়ে একটু বিশদ আলোচনা প্রয়োজন। এই যে বলা হল পুরনো পাঠ্যক্রম চালু করার আগে পূর্বপাঠ ঝালিয়ে নেওয়া প্রয়োজন, এ ব্যাপারে একটি সুনির্দিষ্ট নির্দেশিকা আবশ্যক। পঞ্চম শ্রেণিতে পূর্বপাঠ হবে চতুর্থ শ্রেণিতে অর্জিত দক্ষতার ভিত্তিতে। এবং শিক্ষকরা কী ফল পাচ্ছেন, তার একটা রিপোর্ট তাঁরা এক মাসের মধ্যে জমা দেবেন। তার ভিত্তিতে উচ্চতর কমিটি স্থির করবে পূর্বপাঠ আরও নিম্নশ্রেণির ভিত্তিতে হবে, না যেমন প্রথমে স্থির ছিল, তেমনই থাকবে।
এই নব পর্যায়ে শিক্ষক-অভিভাবক সম্পর্কের সমীকরণ নিয়েও নতুন করে ভাবা প্রয়োজন। মফস্সল বা গ্রামাঞ্চলের বাংলা মাধ্যমের স্কুলগুলোয় পেরেন্ট-টিচার মিটিং আদৌ হয় কি না, জানা নেই। না হলে সেটি নিশ্চিত করাও সরকারের দায়িত্ব। বহু সময় দেখা যায়, এঁরা যেন দুই যুযুধান প্রতিপক্ষ। কিন্তু তা তো হওয়ার কথা নয়। পারস্পরিক শ্রদ্ধা এখানে অমোঘ শর্ত। শিক্ষককে মনে রাখতে হবে, তিনি যাকে শেখাচ্ছেন, তার শিকড় বাড়িতে। তাকে সমৃদ্ধ না করলে সবই ভস্মে ঘি ঢালা হবে। অভিভাবকেরও নিজের একটা কর্মক্ষেত্র আছে। আছে একটা ছোট জগৎ, যেখানে তিনি শ্রদ্ধার পাত্র। অভিভাবককেও মনে রাখতে হবে, তাঁকে সহমর্মী হতে হবে। সন্তানকে ঘিরে তাঁর নিজস্ব বৃত্ত; আর এ রকম অনেক বৃত্ত নিয়ে এক জন শিক্ষকের সংসার। তিনিও মানুষ, অতিমানব নন।
অতিমারি আমাদের সত্যি কোনও যুগান্তের দ্বারে পৌঁছে দিল কি না, তার বিচার হবে তখনই, যখন জীবনের সমস্ত দিক একে একে খুলতে শুরু করবে। আমরা কি তখনও এমন এক জীবন যাপন করব, যেখানে আগের মানুষকে ধাক্কা মেরে এগিয়ে যেতে হয়? যেখানে স্বেচ্ছাচারে বাধা পেলে নৃশংসতা দানবীয় পর্যায়ে পৌঁছয়? নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য বুক ফুলিয়ে অপরের, অর্থাৎ সমষ্টির ক্ষতি করা যায়?
এই নব যুগের শিশুদের পথ দেখানোর জন্য শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে জড়িত সকলে কি আর একটু সদিচ্ছাসম্পন্ন, আর একটু দায়বদ্ধ, তৎপর হতে পারি না?