ছবি: সংগৃহীত
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বড়দা শ্যামাচরণ চট্টোপাধ্যায়ের ছোট ছেলে শচীশচন্দ্রের বিয়ে। বিয়ে হচ্ছে সাহিত্যিক দামোদর মুখোপাধ্যায়ের মেয়ে সুরেশ্বরীর সঙ্গে। শচীশচন্দ্র পাইকপাড়ার জমিদারদের কাছ থেকে পোশাক ধার করে একেবারে রাজপুত্র সেছে এসেছেন। রাজবেশে তখন বর নামছেন। রাজপোশাক নষ্ট হয়ে যেতে পারে মনে করে শচীশচন্দ্র বাঁ হাত দিয়ে বিদ্যাসাগরকে সরিয়ে দিলেন। থতমত খেয়ে বিদ্যাসাগর চকিতে পিছু হটলেন। পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। ভাইপোর এমন আচরণ দেখে তিনি তো অগ্নিশর্মা, ‘‘তুমি জানো ইনি কে? ইনি বিদ্যাসাগর! এক্ষুণি ক্ষমা চাও।’’ মাথা নিচু করে ক্ষমা চাইতে বাধ্য হলেন শচীশচন্দ্র। বঙ্কিমের এরকম শ্রদ্ধা অটুট ছিল ঈশ্বরের মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত।
অন্যদিকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের তীব্র সমালোচকও ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বঙ্কিমের সমালোচনা এতটাই মাত্রাতিরিক্ত ছিল যে, বিদ্যাসাগর কিছুটা হলেও বিরক্ত হয়েছিলেন। বঙ্কিম সর্বপ্রথম ১৮৭১ সালে ‘ক্যালকাটা রিভিউ’ পত্রে বেঙ্গলি লিটারেচার শীর্ষক প্রবন্ধে বিদ্যাসাগরের প্রতিভা অস্বীকার করেন। এমনকি ঈশ্বর গুপ্তের চেয়েও বিদ্যাসাগরের স্থান নিচুতে বলে মত প্রকাশ করেন। ১৮৭২ সালে বঙ্কিম তাঁর নিজের সম্পাদিত ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার প্রথম বর্ষের ২য় সংখ্যায় (১২৭৯ জ্যৈষ্ঠ) ‘উত্তরচরিত’ নামক প্রবন্ধে বিদ্যাসাগরের উদ্দেশে বলেন, ‘‘তাঁকে ‘কাব্য রসজ্ঞ’ বলিয়া স্বীকার করি না।’’ এটিই বাংলা ভাষায় বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম সাহিত্য-সমালোচনা। এই প্রবন্ধে বঙ্কিম ভবভূতির ‘উত্তরচরিত’ গ্রন্থের সমালোচনা প্রসঙ্গে অনাবশ্যক কারণে বিদ্যাসাগরকে আক্রমণ করেন এবং তাঁকে ‘যদুবাবু মধুবাবু’র সমগোত্রীয় বলে তুলনা করেন।
বঙ্গদর্শনের ‘উত্তরচরিত’ প্রবন্ধের প্রথম অনুচ্ছেদে বলা হয়, ‘‘ভবভূতি প্রসিদ্ধ কবি এবং তাঁহার প্রণীত উত্তরচরিত উৎকৃষ্ট নাটক, ...আমরা বিদ্যাসাগর মহাশয়কে অদ্বিতীয় পণ্ডিত এবং লোকহিতৈষী বলিয়া মান্য করি, কিন্তু তাদৃশ কাব্যরসজ্ঞ বলিয়া স্বীকার করি না, যাহা হউক, তাঁহার ন্যায় ব্যক্তির লেখনী হইতে এইরূপ সমালোচনার নিঃসরণ, অস্মদেশে সাধারণতঃ কাব্যরসজ্ঞতার অভাবের চিহ্নস্বরূপ। বিদ্যাসাগরও যদি উত্তরচরিতের মর্যাদা বুঝিতে অসমর্থ হন, তবে যদুবাবু, মধুবাবু তাহার কি বুঝিবেন?’’
আবার দ্বিতীয় বর্ষের প্রথম সংখ্যা ১২৮০ বঙ্গাব্দের বৈশাখ সংখ্যায় (১৮৭৩ সাল) ‘তুলনায় সমালোচনা’ শিরোনামে একটি রচনা ছাপা হয়। এই প্রবন্ধে বিদ্যাসাগর সম্পর্কে বলা হয়, ‘‘বিদ্যাসাগর মহাশয় টাঁকশাল ও তাঁহার গ্রন্থগুলি দুআনি সিকি ও টাকা ব্যতীত আর কিছুই নহে। সাগরী টাঁকশালে রূপা ব্যতীত সোনার সম্পর্ক নাই, টঙ্কযন্ত্রাধ্যক্ষ বিদ্যাসাগর অন্য স্থানে রূপা ক্রয় করিয়া নিজে খাদ মিশাইয়া ব্যবসা করিতেছেন। খণ্ড রূপা যেমন একটু পরিষ্কার করিয়া চারিদিকে গোলাকার করিয়া কিরণ দিয়া, উপরে Queen Victoria ছাপিয়া দিলেই মুদ্রা হয়, সেইরূপ অন্যের রূপা একটু বাঙ্গালা রসনা চড়াইয়া, চতুষ্কোণ করিয়া চারদিকে ছাঁটিয়া উপরে ‘শ্রী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যসাগর প্রণীত’ ছাপিয়া দিলেই সাগরিক গ্রন্থ হয়। বর্ণপরিচয় দুআনি; ক্ষুদ্র, বালকের জন্য প্রয়োজনীয়, শীঘ্র নষ্ট হয় বা হারাইয়া যায়। এইরূপ তাঁহার কোন গ্রন্থ সিকি, কোন গ্রন্থ আধুলি ও কোন গ্রন্থ টাকা। তিনি প্রথমে এক খোট্টা মহাজনের নিকট রূপা লইয়া মুদ্রাযন্ত্র বসান; সেই খোট্টার রূপায় টাকা প্রস্তুত করান; সে টাকার নাম ‘বেতাল পঁচিশ’; সেবার চেম্বার্স বলে একজন বিলাতী মহাজনের নিকট রূপা লইয়া ‘জীবন চরিত’ নাম দিয়া, একটু কম খাদ মিশাইয়া ক’হাজার আধুলি প্রস্তুত করাইয়া অনেক লাভ করিলেন।...এখনও ব্যবসা ছাড়েন নাই, আজি চার বৎসর হইল শেক্সপিয়রের ‘ধোঁকার মজা’ বলে খানিক রূপা ছিল। তাহাতেই আপনার সেই মোহর দিয়া ‘ভ্রান্তিবিলাস’ টাকা নাম দিয়া বিক্রয় করিলেন। এইরূপে উপদেষ্টা প্রতিপন্ন করিলেন যে বিদ্যাসাগর টঙ্কযন্ত্রমাত্র।’’ এই প্রবন্ধের রচনাকার অক্ষয় সরকার নিজেই তাঁর প্রবন্ধে জানিয়েছেন, বিদ্যাসাগর নিয়ে এই তুলনা তাঁর নিজের মাথা থেকে আসেনি। ‘এক জ্ঞানী সমালোচক’ তাঁকে এই তুলনাটি শুনিয়েছিলেন। এই ‘জ্ঞানী সমালোচক’ কে তা বুঝতে অসুবিধে হয় না।
১৮৭৩ সালের ১ এপ্রিল প্রকাশিত হয় বহুবিবাহ বিষয়ে বিদ্যাসাগরের দ্বিতীয় পুস্তক ‘বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার’। এই পুস্তকের তীব্র সমালোচনা করেন স্বয়ং সাহিত্যসম্রাট। সমালোচনা প্রকাশিত হল ‘বঙ্গদর্শন’-এর ১২৮০ বঙ্গাব্দের আষাঢ় (১৮৭৩ সাল) সংখ্যায়। ‘বহুবিবাহ’ শিরোনামে তিনি বলেন, ‘‘এই ক্ষুদ্র পৃথিবী মধ্যে যে কয়েকজন পণ্ডিত আছেন, তাঁঁহাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বিদ্যাসাগর মহাশয়ই ধর্মশাস্ত্রে বিশারদ। কিন্তু সে কথা পরের মুখে ভালো শুনায়। বিদ্যাসাগর মহাশয় ততক্ষণ বিলম্ব করিতে পারেন নাই। শ্রীযুক্ত তারানাথ তর্কবাচস্পতি, শ্রীযুক্ত রাজকুমার ন্যায়রত্ন, শ্রীযুক্ত ক্ষেত্রপাল স্মৃতিরত্ন, শ্রীযুক্ত গঙ্গাধর কবিরাজ কবিরত্ন (বহরমপুর সৈয়দাবাদ নিবাসী) তাঁহার প্রতিবাদী। বিদ্যাসাগর মহাশয় একে একে পাঁচ জনকেই বলিয়াছেন যে, তাঁহারা ধর্মশাস্ত্রের অনুশীলন করেন নাই। ... প্রতিবাদী পণ্ডিতেরা এ কথার এই অর্থ করিবেন যে, বিদ্যাসাগর বলিয়াছেন, ‘তোমরা কেহ কিছু জান না, ধর্মশাস্ত্রে যাহা কিছু জানি তা আমিই।’ আমরা ইহাতে দুঃখিত হইলাম। ... বিদ্যাসাগর মহাশয় পূর্বে এক বার বিধবা বিবাহের শাস্ত্রীয়তা প্রমাণ করিয়াছেন; কিন্তু কয়জন স্বেচ্ছাসেবক, বিধবা বিবাহের অনুষ্ঠেয়তা বা শাস্ত্রীয়তা অনুভূত করিয়া আপন পরিবারস্থা বিধবাদিগের পুনর্ব্বার বিবাহ দিয়াছেন? ...আর একটি কথা এই যে, এদেশে অর্দ্ধেক হিন্দু, অর্দ্ধেক মুসলমান। যদি বহুবিবাহ নিবারণ জন্য আইন হওয়া উচিত হয় তবে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্বন্ধেই সে আইন হওয়া উচিত। হিন্দুর পক্ষে বহুবিবাহ মন্দ, মুসলমানের পক্ষে ভাল এমত নহে। কিন্তু বহুবিবাহ হিন্দুশাস্ত্র বিরুদ্ধ বলিয়া, মুসলমানের পক্ষেও তাহা কি প্রকারে দণ্ডবিধির দ্বারা নিষিদ্ধ হইবে ?...’’
তবে ১৮৭৩ সালের ৩ জুলাই অমৃতবাজার পত্রিকা লিখেছিল, ‘‘বঙ্গদর্শন সম্পাদক নতুন লেখক, সুতরাং তাঁর সহস্র অপরাধ মার্জ্জনীয়; আমাদের ভরসা, তাঁর মত সুবোধ সম্পাদক আরো একটু শিক্ষিত হলে এ ভ্রমের পুনরাবৃত্তি হবে না।’’ কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হল, বঙ্কিম এই ‘বহুবিবাহ’ শীর্ষক প্রবন্ধটি দীর্ঘকাল তাঁর কোনও গ্রন্থে সঙ্কলন করেননি। বিদ্যাসাগরের তিরোধানের পরে ১৮৯২ সালে ‘বিবিধ প্রবন্ধ’-এর দ্বিতীয় ভাগে এই প্রবন্ধ সংক্ষেপিত হয়ে সঙ্কলিত হয়। তাই একটা প্রশ্ন থেকেই যায়, বঙ্কিম ১৮৯২ সালের পূর্বে এই প্রবন্ধ গ্রন্থভুক্ত করেননি কেন? তবে ‘বিবিধ প্রবন্ধ’-এর দ্বিতীয় ভাগে নিঃসংকোচে বঙ্কিম বলেন, ‘‘বিদ্যাসাগর মহাশয় প্রণীত বহুবিবাহ সম্বন্ধীয় দ্বিতীয় পুস্তকের কিছু তীব্র সমালোচনায় আমি কর্তব্যানুরোধে বাধ্য হয়েছিলাম। তাহাতে তিনি কিছুটা বিরক্তও হয়েছিলেন। তাই আমি এ প্রবন্ধ আর পুনর্মুদ্রিত করি নাই।’’ এহেন দৃষ্টান্ত ঈশ্বরের প্রতি আর এক সম্রাটের (সাহিত্য) শ্রদ্ধাঞ্জলি। তবে এই শ্রদ্ধা কিন্তু একতরফা ছিল না। এক বার ঈশ্বরের অভিমত জানতে তাঁর এক সফরসঙ্গী তাঁকে জানায়, ‘‘জানো হে ঈশ্বর, বঙ্কিম দিনের বেলায় অফিসে যান, আর রাতে যান বাঈজি পাড়ায়।’’ এ কথা শোনার পরে ঈশ্বর কিছুটা হতচকিত হয়ে পড়লেও সঙ্গীকে বুঝতে না দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘কি বলছো হে, এত কিছুর পরেও উনি বিষবৃক্ষ, রাজসিংহ, আনন্দমঠ এর মত উপন্যাস লিখছেন কি করে! আমার তো শ্রদ্ধায় মাথা উঁচু হয়ে গেলো।’’ সঙ্গীর মুখে আর কথা নেই।
শিক্ষক, বহরমপুর
কৃষ্ণনাথ কলেজ স্কুল
গ্রন্থ ঋণ: মুর্শিদাবাদ ইতিহাস চর্চা ২/ সম্পাদনা: কিশোরকুমার দাস