করোনা-আক্রান্ত করুণ অবস্থা জনস্বাস্থ্যব্যবস্থার দুর্গতিরই প্রমাণপত্র। দ্রুত বাড়ন্ত কোভিড-সংখ্যা প্রতিনিয়ত জানান দিচ্ছে কঠিন সময়ে সার্বিক মঙ্গলসাধনে রাষ্ট্রের চূড়ান্ত ব্যর্থতা। রুজি হারানো গরিব নিঃসন্দেহে আজ সবচেয়ে অসহায়। মাসদুয়েক বিনা রোজগারে বিভিন্ন প্রান্তে চরম অনিশ্চয়তা ও অনাহারে কাটানোর পর আজ যখন তাঁরা কোনও ক্রমে গৃহমুখী, তখন আমরা প্রবল ব্যস্ত হয়ে পড়েছি তাঁদের প্রত্যাবর্তনের প্রবাহ রোধ করতে। কঠিন পরিস্থিতিতে সহজ যুক্তি— সংক্রমণ বৃদ্ধির আশঙ্কার প্রতিরোধ।
বৈশ্বিক অতিমারির চেয়েও ভয়ঙ্কর এক মানসিকতা প্রবেশ করেছে আমাদের চিন্তাধারায়। সেই দৃষ্টিভঙ্গি যে কোনও বহিরাগতকেই দেখছে প্রবল সন্দেহের নজরে। গণ্ডির ও পার থেকে আসা মানুষ সমাজের চোখে এখন আতঙ্কের কারণ। তাই আমরা কেবলই উচ্চতা বাড়াচ্ছি এক নতুন সীমান্ত-গঠন-প্রবৃত্তির। বা, মেতে উঠেছি একই দেশে অন্য রাজ্যের মানুষ, বা অন্য এলাকার মানুষের বিরুদ্ধে এক অদ্ভুত দেওয়াল তোলার প্রক্রিয়ায়। সীমারেখা আঁকার ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে আমরা ভুলতে বসেছি যে লড়াইটা ছিল, আছে এবং থাকবে রোগের বিরুদ্ধে— রোগী বা সম্ভাব্য রোগীর বিরুদ্ধে নয়।
আমরা ভুলতে বসেছি নগর উন্নয়ন, উপার্জন ও বিশ্বায়নের মূল শর্তই সজীব গতিশীলতা— মানুষের ও সামগ্রীর। কোভিড শ্বাসপ্রণালী রুদ্ধ করার চেয়েও অনেক বড় আঘাত হেনেছে স্বাভাবিক চলাফেরার স্বাধীনতায়— যা মানুষের মৌলিক অধিকার ও প্রয়োজনও বটে। অস্বাভাবিক অবস্থায় স্বাভাবিক নিয়ম স্থগিত থাকবে, সেটা যেমন ঠিক, এটাও ভুলে গেলে চলবে না যে লকডাউন শিথিল করার উদ্দেশ্যই ছিল স্বাভাবিকীকরণের দিকে অগ্রসর হওয়া। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নানা ভৌগোলিক অবস্থান ও সীমান্ত অতিক্রম না করে কাজ-বিনিয়োগ-ব্যবসা-বাণিজ্য-জীবিকা অসম্ভব।
রাজ্য-জেলা-মহল্লার সীমান্তগুলি একদা ছিল সহজ পারাপারসাধ্য, কোভিড-১৯ তাকে অতি কঠোর করে তুলেছে। অবশ্য, শুধু প্রশাসনের এঁকে দেওয়া গণ্ডিই বা কেন? সুরক্ষার দোহাই দিয়ে আমরা সকলেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছি নিজ-নিজ এলাকা নির্ধারিত করে সীমান্ত-সংরক্ষণে। অনেক ক্ষেত্রেই এই নিরাপত্তাহীনতা ভিত্তিহীন। ভাবটা এমন, যেন করোনার আক্রমণ এই জোর-করে-আরোপিত ও আপাত-মজবুত সীমানার ও পার থেকেই আসবে। অভ্যন্তরীণ সংক্রমণের সমূহ সম্ভাবনাকে যে আমরা এখনও স্বীকার করছি না— এই অদম্য সীমান্ত-চেতনা তারই প্রমাণ। তাই গুটিসুটি হয়ে বসে থাকা বা লক্ষ্মণরেখার মধ্যে বিচরণ বাঞ্ছনীয়; গতিবিধি মানেই চরম উদ্বেগের কারণ। সীমানা পেরনো পথিক মানেই আতঙ্কের বাহক, অদৃশ্য করোনার ধারক— যা অনেক ক্ষেত্রেই আবার উপসর্গবিহীন। জনসাধারণের যত অসুবিধেই হোক না কেন, চলাফেরা কমাতে তৎপর সীমান্ত-সংগঠনকারীরা। যেখানে-সেখানে, যখন-তখন খাড়া হচ্ছে নির্ধারিত সীমান্তের অপর প্রান্ত থেকে প্রবাহিত মানুষজন আটকাতে কন্টেনমেন্ট-এর মহাপ্রাচীর।
উদ্দেশ্য একটাই। যে কোনও সীমান্তের যা ধর্ম: দাগ টেনে প্রবাহমোচন। তোমার রাজ্যে, তোমার জেলায়, তোমার এলাকায়, তোমার পাড়ায়, তোমার আবাসনে সংখ্যা বাড়লে বাড়ুক— আগে তো আমি বাঁচি। এমন সঙ্কীর্ণ সীমান্ত-চিন্তা সম্বল করে কি আদৌ এক অতি সংক্রামক ব্যাধি রোধ করা সম্ভব, যা কিনা ইতিমধ্যেই সীমান্তের ভিতরেও বিস্তৃত? দু’মাস ধরে গোটা দেশের কর্মসংস্থান স্তব্ধ করে কী করছিল প্রশাসন? ষাট দিনব্যাপী কোভিড-প্রস্তুতি কি এতটাই অসম্পূর্ণ ও অপর্যাপ্ত যে তা সীমান্ত নিয়ে বিভিন্ন রাজ্যকে এতটাই নিরাপত্তার অভাবে ভোগাচ্ছে? সংখ্যা যে হু-হু করে বাড়বে, তা অনুমান করার জন্য কি দু’মাস পর্যাপ্ত ছিল না? তা হলে এখন কেন একই দেশের মধ্যে এত সীমান্ত-কেন্দ্রিক সন্দেহবাতিকগ্রস্ততা? কেন একই দেশের শ্রমিক, কৃষক, চাকুরে, ব্যবসায়ী, ছাত্র, রোগী বা ভ্রমণকারীকে রাজ্যভিত্তিক বিভাজনের শিকার হতে হবে? ন্যায্য ছাড়পত্র থাকা সত্ত্বেও প্রতিবেশী রাজ্যে যাওয়া যাবে না রুজির সন্ধানে বা চাকরি বজায় রাখতে? কোনও কোনও ক্ষেত্রে গর্ত খুঁড়ে প্রতিবেশী রাজ্য থেকে আসার পথ বন্ধ করা হচ্ছে। টিকা বেরনো অবধি কোভিড-১৯’এর সঙ্গে যদি বাঁচতেই হয়, এই কি তার তালমিলহীন গতিপথ?
রাজ্য, জেলা, অঞ্চল, পাড়া, হাউজ়িং সোসাইটি— ছোট, বড়, মাঝারি বা নগণ্য— সকল ঘেরাটোপই এই সঙ্কীর্ণ সীমান্ত-ভাবনায় শামিল। ভিতর-বাইরের দ্বৈত ধারণায় প্রথমটা সুরক্ষার প্রতীক, দ্বিতীয়টি আতঙ্কের কারণ। বাইরে থেকে ভিতরে প্রবেশ মানেই অনধিকার চর্চা— দমনযোগ্য। লাল কমলা সবুজে বিভক্ত করোনা-আক্রান্ত উপমহাদেশ এখন খোপে খোপে আঞ্চলিক। প্রতিটি অঞ্চল পুলিশ লাগিয়ে গড়ে তুলছে নিত্যনতুন লাইন অব কন্ট্রোল। পশ্চাৎগামী এই সীমান্ত-চিন্তা জন্ম দিচ্ছে ভীতসন্ত্রস্ত প্রাচীরে ঘেরা, নিশ্চল, অসুবিধের দ্বীপপুঞ্জ। বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরার সমস্ত প্রয়াস। করোনা-আক্রান্তের সংখ্যা বাড়াটা অবশ্যম্ভাবী ও প্রত্যাশিত। করোনার সঙ্গেই যদি বাঁচতে হয়, তবে অযথা সীমান্ত জাহির করাটা প্যানিক করার শামিল।
কেন জানি না মনে হচ্ছে, কোভিড-১৯ একটা অজুহাতমাত্র। আমাদের অন্তরের বিচ্ছিন্নতা, প্রাচীর-চেতনাকে সামাজিক বৈধতা দিয়েছে এই অতিমারি, এটুকুই। এই দেওয়ালগুলো আসলে আমরা গড়তে চেয়েছি প্রাণপণ— বাহিরের থেকে অন্দরকে বিচ্ছিন্ন করতে, অপর থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে সঙ্গোপনে। যেন এই দূরত্বটুকু রচনা করতে পারলেই আমাদের আর বিপদ থাকবে না, নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে সব বিপদ থেকে। সমাজবদ্ধ জীব হওয়ার ঐতিহাসিক দায় থেকে করোনাভাইরাস আমাদের মুক্তি দিয়ে গেল।
সমাজতত্ত্ব বিভাগ, শিব নাদার বিশ্ববিদ্যালয়