সাতটি পুরসভায় নির্বাচনের ফল দেখিয়া টেনিদা নির্ঘাত তাঁহার জীবনের সেই আশ্চর্য ফুটবল ম্যাচখানি আবার স্মরণ করিতেন। আমন্ত্রিত খেলোয়াড় হিসাবে বর্ষাকালে গ্রামের মাঠে নামিয়াছেন পটলডাঙার ভজহরি মুখোপাধ্যায়। বৃষ্টিও নামিয়াছে মুষলধারে। অচিরেই পাশের পুকুর ভাসিল, দুই দলের সব খেলোয়াড় মাছ ধরিতে রওনা হইল, কিন্তু রেফারি নিয়মনিষ্ঠ, খেলা বন্ধ করিবেন না, অতএব তাঁহার নির্দেশে টেনিদা ফাঁকা গোলে একের পর এক শট লইয়া চলিলেন, বত্রিশ গোল করিয়া তবে নিস্তার মিলিল। পশ্চিমবঙ্গেও এই মরশুমে অতিবর্ষণ চলিতেছে, তবে মা মাটি মানুষের দল প্রকৃতির সাহায্যের তোয়াক্কা করে না, সর্বাধিনায়িকার আশীর্বাদই যথেষ্ট। সুতরাং দেড়শো ওয়ার্ডের মধ্যে ১৪২টিতেই ঘাসফুল ফুটিয়াছে, বাকি আটখানি হাতছাড়া হইয়াছে বলিয়া শ্রীযুক্ত অনুব্রত মণ্ডল ও সহশিল্পীবৃন্দের আক্ষেপের অন্ত নাই। হয়তো বা ভর্ৎসনার আশঙ্কাও আছে, দেড়শোয় দেড়শো না পাইবার ব্যর্থতায় দিদি না জানি কী বলিবেন! ৯৫ শতাংশ ওয়ার্ডে জয়ী হইয়াও তাই ভাইদের বুক ঢিপঢিপ। দুর্জনে বলে, এ কালের নামী-দামি কলেজের মতো কালীঘাটেও নাকি ‘কাট-অফ’ ১০০ শতাংশ।
একশোয় একশো পাইতে হইবে— এমন কথা গণতন্ত্রের কেতাবে লেখা নাই। বরং গণতন্ত্রে বিরোধী দলের উপকারিতা লইয়াই ছাত্রছাত্রীরা রচনা লিখিয়া থাকে। কিন্তু সর্বশক্তিমান হইবার সাধনায় সে-সকল কথা ভাবিতে বসিলে চলে না, সর্বগ্রাসী ক্ষুধাই সেই সাধনার দস্তুর। পশ্চিমবঙ্গীয় রাজনীতিতে তাবৎ ব্যাধির মতো এই সর্বগ্রাসিতার ব্যাধিটিও বামফ্রন্টের অবদান। ক্ষমতার স্বর্ণযুগে ‘বিরোধীদের একটিও ভোট দিবেন না’ কথাটি তাহারা কেবল মুখে বলিয়া বা দেওয়ালে লিখিয়া ক্ষান্ত হয় নাই, প্রবল বিক্রমে কাজেও পরিণত করিতে তৎপর হইয়াছে— কেশপুরে নন্দরানি ডলের বিজয়গাথা স্মরণীয়। লক্ষণীয়, ‘কংগ্রেসমুক্ত ভারত’ গড়িবার স্লোগান শানাইয়া নরেন্দ্র মোদী ও তাঁহার পারিষদবর্গ বুঝাইয়া দিতেছেন, এই ব্যাধি তাঁহাদেরও মজ্জাগত। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সিপিআইএমের তীব্র বিরোধিতা করিয়া ক্ষমতায় আসিয়াছেন এবং ক্ষমতায় আসিয়া বিজেপির তীব্র বিরোধিতা করিতেছেন। এবং, তৃণমূল কংগ্রেসের সকলই স্বচ্ছ, সকলই নিরাবরণ— এই দলের রথী মহারথী আধারথী সিকিরথীরা কোনও প্রকার রাখঢাক না করিয়া ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে আপন প্রার্থীদের ‘জিতাইয়া আনিয়াছেন’। সবার উপরে অনুব্রত মণ্ডল সত্য, তাঁহার উপরে নাই, অতএব দুইটি ওয়ার্ড হারাইয়া তিনি সাফ ঘোষণা করিয়াছেন: ওই দুই ওয়ার্ডে কোনও উন্নয়ন হইবে না। অপরাধ করিলে শাস্তি তো পাইতেই হইবে!
রাজনীতির পরিসরকে বিরোধীশূন্য করিবার এই তাড়না গণতন্ত্রের স্বধর্ম নহে। যে ভাবে প্রশাসনযন্ত্র এবং দলতন্ত্রের অপব্যবহার করিয়া এই তাড়নাকে রূপায়িত করা হইতেছে, তাহা গণতন্ত্রের নীতি নহে। তবে এ ঘোর কলিতে ধর্ম বা নীতির কথা বলা হয়তো অরণ্যে রোদনমাত্র, সুতরাং সে কথা থাকুক। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী একটি কথা ভাবিয়া দেখিতে পারেন। তাহা বাস্তববুদ্ধির কথা। নির্বাচনী রাজনীতির স্বাভাবিক চালটিকে বজায় রাখিয়া চলিলে আখেরে তাঁহার দলেরই লাভ। যেন তেন প্রকারেণ সব ভোট নিজের ঝুলিতে পুরিতে ব্যগ্র হইলে বিরোধী রাজনীতি তাহার স্বাভাবিক প্রকাশে ব্যর্থ হইয়া অস্বাভাবিক প্রকাশের পথ খুঁজিবে। শেষ অবধি সেই অস্বাভাবিক প্রকাশের মোকাবিলা বহুগুণ কঠিন হইতে বাধ্য। এই সত্যের স্বরূপ বুঝিবার জন্য অধিক দূরে যাইবার প্রয়োজন নাই, তৃণমূল কংগ্রেসের নেত্রী আপন রাজনৈতিক সাফল্যের ইতিহাসের পাতা উলটাইয়া দেখিলেই সত্য দেখিতে পাইবেন। নন্দরানি ডলেরা এখন কোথায়?