বন্ধুত্ব: পারস্পরিক সুসম্পর্ক বজায় রাখা দুই দেশের কাছেই সমান গুরুত্বপূর্ণ। ভারত সফরে নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে শেখ হাসিনা। পিটিআই
শেখ হাসিনার বহু প্রতীক্ষিত ভারত সফর শেষ। বাংলাদেশের পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনের আগে এটাই সম্ভবত তাঁর শেষ ভারত সফর। এই সফরে বাংলাদেশের মানুষের প্রধান আশা ছিল ভারত (পড়ুন পশ্চিমবঙ্গ) থেকে তিস্তার জল পাওয়া। এ বারের সফরে সে আশা পূর্ণ হল না। তবে, বাংলাদেশের প্রাপ্তির ঝুলি কিন্তু শূন্য নয়।
১৯৮৩ সালের জুলাই মাসে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে তিস্তার জল বণ্টনকে কেন্দ্র করে এক অস্থায়ী চুক্তি হলেও দু’বছরেই তার মেয়াদ অতিক্রান্ত হয়। বোঝাপড়া ছিল, তিস্তার ৩৯ শতাংশ জল ভারত ব্যবহার করবে, বাংলাদেশ করবে ৩৬ শতাংশ, আর বাকি ২৫ শতাংশ নদীর স্বাভাবিক গতিকে অক্ষুণ্ণ রাখবে। কিন্তু বিভিন্ন কারণে সাম্প্রতিক কালে শুখা মরসুমে তিস্তার গতিপথে নির্মিত গাজোলডোবা জলাধারে সঞ্চিত জলের পরিমাণ চার থেকে পাঁচ হাজার কিউসেকের মধ্যেই থাকে। একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৪ সালের মার্চ মাসের শেষ দশ দিনে এই পরিমাণ ছিল মাত্র ৫৫০ কিউসেক এবং ২০১৫ সালের একই সময়ে তা ছিল মাত্র ৩১৫ কিউসেক। প্রশ্ন হল, পশ্চিমবঙ্গেরই যদি তিস্তা থেকে শুখা মরসুমে এতটুকু জল মেলে, তা হলে বাংলাদেশকে দিলে কী থাকবে? মূলত এই প্রশ্নেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তিস্তার জলবণ্টন ঘিরে আপত্তি। পশ্চিমবঙ্গের দু’টি বক্তব্য। এক, পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে আলোচনা ব্যতিরেকে তিস্তায় জল বণ্টন সম্পর্কিত চুক্তি অনভিপ্রেত। দুই, এই আলোচনায় তিস্তার উজানে থাকা সিকিমকেও আলোচনায় ডাকা দরকার। অন্য দিকে, কেন্দ্রীয় সরকার দ্রুত তিস্তা চুক্তি সম্পাদনে আগ্রহী— এই সফর চলাকালীন প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যেই তা স্পষ্ট।
তিস্তার জল প্রাপ্তি বাংলাদেশের ঘরোয়া রাজনীতিতে অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয়। স্পর্শকাতর ভারতেও, বিশেষত উত্তরবঙ্গে। তা সত্ত্বেও নয়াদিল্লির বাড়তি আগ্রহের পিছনে আঞ্চলিক রাজনীতিতে চিনের ছায়া; আর বাংলাদেশের তাগিদ, ২০১৮-র শেষে সে দেশের সাধারণ নির্বাচনের আগে তিস্তার আরও বেশি জল পাওয়া সুনিশ্চিত করা।
চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং-এর গত নভেম্বরে বাংলাদেশ সফরের সময়ে বেজিং ঢাকাকে দুটি ডুবোজাহাজ সরবরাহ করায় সাউথ ব্লকের আধিকারিকদের কপালে ভাঁজ পড়ে। ভারতের প্রতিবেশ এলাকায় চিনের নানাবিধ প্রভাব ইদানীং বাড়তে থাকায় নয়াদিল্লির উদ্বেগ ছিলই। আওয়ামি লিগ এবং বিএনপি, বাংলাদেশে উভয় সরকারের আমলেই সে দেশে চিনের প্রভাব কম-বেশি বেড়েছে। সামরিক সাজসরঞ্জাম সরবরাহে চিন ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের বৃহত্তম সঙ্গী। পনেরো বছর আগেই চিন ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা চুক্তি হয়। চিনা প্রেসিডেন্টের সাম্প্রতিক সফরে দুই দেশ ২৫০০ কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের নতুন ২৭টি চুক্তি করেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতেই শি জিন পিংয়ের ঢাকা সফরের পরেই প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পর্রীকর এবং সম্প্রতি সেনাপ্রধান বিপিন রাবত ও লোকসভার অধ্যক্ষা সুমিত্রা মহাজন বাংলাদেশ গেছেন। গেছেন বিদেশ দফতরের রাষ্ট্রমন্ত্রী এম জে আকবর এবং বিদেশ মন্ত্রকের একাধিক কর্তা।
অন্য দিকে, ভারত-বন্ধু আওয়ামি লিগ সরকার যে বিগত কয়েক বছরে সে দেশের মাটি থেকে ভারত-বিরোধী রাজনৈতিক ও জঙ্গি গোষ্ঠীগুলিকে নির্মূল করতে সব রকম চেষ্টা করেছে, বা নিজের ভূখণ্ডের মাধ্যমে উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলির সঙ্গে ভারতের মূল ভূখণ্ডের সহজতর সংযোগের পথ সুগম করতে সাহায্য করেছে, কিংবা বাংলাদেশ থেকে ভারতে জাল নোট পাচার নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগী হয়েছে, সে বিষয়ে নয়াদিল্লির সংশয় নেই। ঢাকা বিভিন্ন ইসলামি জঙ্গিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ করায় বা ‘রাজাকার’দের বিরুদ্ধে এত দিন বাদে হলেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ায় দিল্লি স্বস্তিতে।
মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা বিষয়ে সে দেশের অধিকাংশ মানুষই এখনও কৃতজ্ঞ। রাষ্ট্রীয় স্তরেও সেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু প্রতিবেশীর কাছ থেকে শুধু হাত পেতে নেওয়া যায় না। কিছু দিতেও হয়। ১৯৭১ আর ২০১৭-র বাংলাদেশও এক নয়। বাংলাদেশের বহু সংখ্যক মানুষ আজ নানা কারণে ভারতবিরোধী মনোভাব পোষণ করেন। তাঁদের এবং চরমপন্থী ইসলামি গোষ্ঠীগুলির মোকাবিলা করতে গেলে শেখ হাসিনা সরকারের হাত শক্ত করা দিল্লির জন্য জরুরি। বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের মেয়াদ ফুরোবার আগে ঢাকাকে বেজিংয়ের প্রভাব থেকে কিছুটা মুক্ত করতে গেলেও সে দেশের সঙ্গে বিবিধ সমঝোতা জরুরি।
আর তাই নিরাপত্তা বাণিজ্য বা পারস্পরিক সংযোগ বৃদ্ধির ব্যাপারে সমঝোতায় দিল্লি অত্যন্ত তৎপর। এই প্রেক্ষিতে এই সফরে ২৫ বছরের জন্য এক সর্বাত্মক প্রতিরক্ষা চুক্তি হল। প্রসঙ্গত, প্রধানমন্ত্রী মোদী ২০১৫ সালে ‘ব্লু ইকনমি’-র কথা ঘোষণা করেছিলেন। সেই অনুযায়ী, শুধু বঙ্গোপসাগর সামুদ্রিক এলাকাকে শান্তিপূর্ণ রাখা জরুরি নয়, এই বহুপাক্ষিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে উপকূলবর্তী দেশগুলি যৌথ ভাবে সমুদ্রতলে অবস্থিত জ্বালানিসহ অন্যান্য সামুদ্রিক সম্পদ সংগ্রহের বন্দোবস্ত করা, মহাসমুদ্রে মাছ ধরা, সামুদ্রিক পরিবেশ সংরক্ষণ বা বিপর্যয় মোকাবিলা করবে, এমনটাই প্রত্যাশিত। বস্তুত, বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে ভারত মহাসাগর ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। এক দিকে হরমুজ প্রণালী, সুয়েজ খাল, লোহিত সাগর, পারস্য উপসাগর, এবং অন্য দিকে মালাক্কা প্রণালী ও দক্ষিণ চিন সাগর অঞ্চল দিয়ে বাণিজ্যিক জলযানগুলির অবাধ যাতায়াত জরুরি। ভারত মহাসাগরীয় বেশ কয়েকটি দেশ ইতিমধ্যেই মোদীর এই প্রয়াসের শরিক। বাংলাদেশও যাতে এর অংশীদার হয়, নয়াদিল্লি এ বারে তার প্রত্যাশী।
ভারত যেমন পায়রা বন্দরে বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়তে আগ্রহী, তেমনই বাংলাদেশে রেললাইন বন্দর ও সড়ক নির্মাণ ও সংস্কারে উৎসাহী। এই উদ্দেশ্যে নয়াদিল্লি এ বারে ঢাকাকে ৫০০ কোটি ডলার ঋণ দিল। কোনও দেশকে এই বিপুল পরিমাণ আর্থিক সাহায্য এ যাবৎ দেওয়া হয়নি। ২০ বছর মেয়াদে এই ঋণ পরিশোধযোগ্য হলেও আরও পাঁচ বছর ছাড়ের সুযোগ থাকবে। মাত্র ১ শতাংশ সুদের হারে এই ঋণদান। এই বন্দোবস্ত কার্যকর হলেও শুধু ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সৌহার্দ্য বাড়বে তা-ই নয়, ভারতের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির সঙ্গে সংযোগ সাধন দৃঢ়তর হবে। অতএব, তিস্তা চুক্তি এই মুহূর্তে আয়ত্তের বাইরে থাকলেও প্রধানমন্ত্রী হাসিনা এই সফরে মোটেই শূন্য হাতে ফেরেননি।
আর, সমস্যা তো কেবল তিস্তাকে নিয়ে নয়। সমস্যা নদীর জল পাওয়া নিয়ে। উভয় দেশের মানুষের স্বার্থেই এটা জরুরি। তাই প্রয়োজনে ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবাহমান মোট ৫৪টি নদীর জলভাগ নিয়ে আলোচনা নয় কেন? তা ছাড়া, কূটনীতির প্রয়োজনে কোনও কোনও সময় রাজনীতিকে পিছু হঠতে হয় বইকি!
রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক