ইতিহাসে ভাস্বর

আমাদের নারী। ফরাসি শব্দটির বাংলা অর্থ এমনই দাঁড়ায়। প্যারিসের নোত্র দাম ক্যাথিড্রালের কেন এই নাম হইয়াছিল, সেই কাহিনি ইতিহাসের গভীরে নিমজ্জিত।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২১ এপ্রিল ২০১৯ ০০:০৪
Share:

আমাদের নারী। ফরাসি শব্দটির বাংলা অর্থ এমনই দাঁড়ায়। প্যারিসের নোত্র দাম ক্যাথিড্রালের কেন এই নাম হইয়াছিল, সেই কাহিনি ইতিহাসের গভীরে নিমজ্জিত। কিন্তু অত্যুক্তি হইলেও বলিতে ইচ্ছা করে, নামটির ব্যঞ্জনা এই অসাধারণ সৌধটির ভাগ্য নির্ধারিত করিয়া দিয়াছিল। নারী যেমন একই সঙ্গে প্রাণের কেন্দ্রভূমি, উৎসবের ধারক, শোকসন্তাপের কারণ এবং অবহেলার পাত্র, নোত্র দাম ক্যাথিড্রালের ইতিহাসেও এই সব কিছুই রহিয়াছে। আজ ফ্রান্সের বিখ্যাততম ধর্মসৌধটির বিপর্যয় নাগরিকদের শোকগ্রস্ত করিতেছে। পর্যটকরা হাহাকার করিতেছেন। একটি অনবদ্য ক্লাসিক উপন্যাসের উৎসস্থল কিংবা দুই-দুইটি বিশ্বযুদ্ধ সমাপনের উৎসবস্থলকে লেলিহান অগ্নিশিখায় ধ্বস্ত হইতে দেখিয়া সাহিত্যপ্রেমী ও ইতিহাসপিপাসুরা হতভাগ্য বোধ করিতেছেন। বিপর্যয় হইতে আবার উঠিয়া আসিবার সঙ্কল্প শুনাইতেছেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট। নবনির্মাণের কাজে ইতিহাস ও আধুনিকতার মিশেল কী অনুপাতে গ্রাহ্য হইতে পারে, তাহা ভাবিয়া বিশেষজ্ঞরা উদ্বেল হইতেছেন। মনে রাখিতে হইবে, এমন বিপর্যয় কিন্তু এই ক্যাথিড্রালের জীবনে প্রথম বার নহে। নোত্র দাম ক্যাথিড্রালের সাড়ে আটশত বৎসরের ইতিহাসে বহু সময় গিয়াছে, যখন তাহার প্রতি নিয়তি হয় নির্দয় হইয়াছে, নয় বর্ষণ করিয়াছে চূড়ান্ত ঔদাসীন্য ও উপেক্ষা, নয়তো ঢালিয়া দিয়াছে কৃপাসুধার ধারা। চিরদিন কাহারও সমান যায় না। চক্রবৎ পরিবর্তন্তে।

Advertisement

মহিমময় সৌধটির যাত্রা শুরু দ্বাদশ শতকে। মধ্যযুগের ইউরোপের ইতিহাসে ঐক্য অপেক্ষা অনৈক্যের সূত্র বেশি, স্থিতি অপেক্ষা সংঘর্ষের পালা দীর্ঘতর। কখনও নোত্র দামের গথিক মহিমা কীর্তিত হইয়াছে সরবে। কখনও গথিক শৈলীর ‘অর্বাচীনতা’কে চাপা দিয়াছে ক্লাসিকাল ঘরানার ট্যাপেস্ট্রি-শোভা। রাজনীতিও ছাড় দেয় নাই। একশত বৎসরের যুদ্ধে ইংল্যান্ডের সম্রাট চতুর্থ হেনরি যখন সাগরের অপর পারে ফ্রান্সের মাটিতেও রাজপাটের দাবি প্রতিষ্ঠা করিলেন (১৪৩০ খ্রিস্টাব্দ), এক বিশেষ ভূমিকা লইল এই সৌধ। ষোড়শ শতকে নোত্র দামের উপর ছাপ ফেলিতে শুরু করিল ফ্রান্সের অন্তহীন অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষ। কেহ মনে করিলেন ক্যাথিড্রালের কিম্ভূতকিমাকার গারগয়েল নামক দৈব ড্রাগনসমূহ আসলে অধর্মের প্রতিমূর্তি; তাহাদের বিনাশ জরুরি। কেহ-বা এই সৌধের বিভেদ-অতিক্রমী মহিমা প্রচার করিতে চাহিলেন ফ্রান্সের ভিতরে-বাহিরে। প্রোটেস্ট্যান্ট হিউগনট রাজা যখন ক্যাথলিক পাত্রীকে এই ক্যাথিড্রালে বিবাহ করিতে চাহিলেন, প্রোটেস্ট্যান্ট অভ্যাগতদের কচুকাটা হইতে হইল ক্যাথিড্রালটির সম্মুখ-চত্বরেও। ঘটনাটি ইতিহাসে স্থান পাইল সেন্ট বার্থোলেমিউ’স ডে ম্যাসাকার নামে।

আধুনিক যুগের প্রারম্ভ হিসাবে ফরাসি বিপ্লবকে ধরা যাইবে কি না, তর্ক উঠিতে পারে। কিন্তু নোত্র দামের আধুনিকতার যাত্রাটি যে অঁসিয়ে রেজিম বা পুরানো শাসন কাঠামোর ধ্বংসের সঙ্গেই সম্পর্কিত, সন্দেহ নাই। পুরাতন সাম্রাজ্যকে হটাইয়া বিপ্লবীরা যখন নূতন যুগের সূর্য উঠাইতে ব্যস্ত, এই ক্যাথিড্রালের সম্মুখশোভা রাজমূর্তিগুলির মস্তকচ্ছেদনের সিদ্ধান্ত হইল। পুরাতনের প্রতীককে বিনাশ করিয়া এই সৌধেই পরবর্তী যাত্রা আরম্ভ হইল— সৌধের বিপুল অভ্যন্তরটি নির্ধারিত হইল খাদ্যসামগ্রী সঞ্চয়ের কাজে। ক্রমে বিপ্লবও প্রতিবিপ্লবের পথে চলিল, সম্রাট ও সাম্রাজ্যের নবজন্ম দিতে উদ্যত হইল। নবজন্ম না কি পুনর্জন্ম?— নেপোলিয়ন দ্য বোনাপার্ট পুরাতন রাজকীয় ঐতিহ্যই মানিতে চাহিলেন। নিজের অভিষেকের জন্য তাই এই গির্জাই বাছিয়া লইলেন। তবে পুরাতন বা নূতন কোনও রাজাই যাহা করিতে পারেন নাই, তাহা পারিলেন এক মসিজীবী। ‘হাঞ্চব্যাক অব নোত্র দাম’ উপন্যাসে (১৮৩১) ভিক্টর হুগোর হাতে যখন এই অপার্থিব রহস্যময় ক্যাথিড্রালটি একটি সাক্ষাৎ চরিত্রে পরিণত হইল, হতলাবণ্য সৌধটি আবার ফরাসি জনমানসে নবগৌরব লাভ করিল। অতিদীর্ঘ সেই গৌরবের ছায়া। বিংশ শতকের দুই ফরাসি কুলতিলক প্রেসিডেন্ট দ্য গল এবং মিতেরঁ-র মৃত্যুপরবর্তী ‘মাস’ও তাই স্থান পাইল এখানেই। সাম্রাজ্যে বিপ্লবে সাহিত্যে, প্রাক-আধুনিক হইতে উত্তর-আধুনিকের যাত্রাপথে, যে কয়েকটি সৌধ অনিমিখে মানুষের উত্থান, পতন, পুনরুত্থান দেখিতেছে, নোত্র দাম তাহাদের অন্যতম। কেবল ফ্রান্স নয়, সমগ্র বিশ্বের কামনা আজ বলিতেছে, ‘আমাদের নারী’ নোত্র দাম-এর কাছে অগ্নিদেবও হার মানিবেন।

Advertisement

য ৎ কি ঞ্চি ৎ

নোত্র দাম, না কোটি কোটি মানুষের প্রাণের দাম, কোনটা বেশি? দগ্ধ গির্জা ঠিকঠাক করার জন্য সব্বাই দাতাকর্ণ, খরা বন্যা দারিদ্রের কথা বললেই কড়া কিপটে? একটি সৌধ শিল্প সাহিত্য ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে, কিন্তু খিদের কষ্টের চেয়ে তার নান্দনিকতা মূল্যবান? অন্য দিকে, কে কোন কারণে নিজের টাকা দেবে, তা কি অন্য কেউ নির্ধারণ করতে পারে? আর, কে বললে প্রাণের মূল্য শিল্পের চেয়ে বেশি? দরিদ্র মানুষেরা টাকা পেয়ে চালের আগে মোবাইল কিনতে ব্যস্ত নয় কি?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement