একেই কি বলে অদৃষ্টের পরিহাস? না কি ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি? নইলে ২২ বছর আগে (১৯৯৬) মে মাসের ২৮ তারিখে লোকসভায় যে রাজনৈতিক একাঙ্কটি অভিনীত হয়েছিল, তার চেয়েও ক্ষুদ্র একাঙ্ক অভিনীত হয়ে গেল কর্নাটক বিধানসভায় মে মাসেরই ১৯ তারিখ! শুধু তা-ই নয়। সে বার সর্ববৃহৎ দল হওয়া সত্ত্বেও বাড়তি সমর্থক জোগাড় করতে না পেরে বিজেপির অটলবিহারী বাজপেয়ী আস্থাভোটে অবতীর্ণ না হয়েই মাত্র ১৩ দিনের মাথায় প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন। আর এ বার, কর্নাটক রাজ্যে সবচেয়ে বেশি আসন (১০৪) নিয়েও বিজেপির মুখ্যমন্ত্রীর পদপ্রার্থী বি এস ইয়েদুরাপ্পা কেবল আড়াই দিনেই অন্য সঙ্গী জোগাড়ে ব্যর্থ হয়ে কন্নড়ে আবেগমথিত ভাষণের (শেষের দিকে কেঁদে ফেলেছিলেন) পর ইস্তফার কথা ঘোষণা করলেন, আস্থা ভোটের প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার আগেই। সে বার বাজপেয়ীর ইস্তফার পর কংগ্রেসের সমর্থনে ইউনাইটেড ফ্রন্ট (ইউএফ) জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন কর্নাটকের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী এইচ ডি দেবগৌড়া। এ বার ইয়েদুরাপ্পার ইস্তফায় কংগ্রেসরই সঙ্গে জোট বেঁধে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে উঠে এলেন দেবগৌড়া-পুত্র কুমারস্বামী। সবই এই মে মাসে! বহু দিন আগে ইংরেজ কবি টি এস এলিয়ট তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’-এ এপ্রিলকে ‘নিষ্ঠুরতম’ মাস বলেছিলেন, কিন্তু ভারতীয় সংসদীয় রাজনীতিতে অন্তত বিজেপির কাছে মে মাসই হল নিষ্ঠুরতম!
কর্নাটকের এই নাটকীয় পরিস্থিতি এক দিকে যেমন দক্ষিণে কংগ্রেসের একমাত্র রাজ্যটিকে বিজেপির দখলে চলে যাওয়া থেকে রুখল, তেমনই সাম্প্রতিক জাতীয় রাজনীতিতে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ জুটির যে অপরাজেয় ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছিল তাতেও খানিকটা টোল ফেলতে পারল। কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গাঁধীর পক্ষে ব্যাপারটা হয়তো আপাত-স্বস্তির, কিন্তু জেডিএস-এর সঙ্গে তাঁর দলের প্রাক্-নির্বাচনী সমঝোতা না করায়, তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা নিয়েও কিছু প্রশ্ন রয়ে গেল। যে প্রজ্ঞা দেখা গেল সনিয়া গাঁধীর। বড় দল হয়েও কুমারস্বামীকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মেনে নেওয়ার পরামর্শে। এই পরামর্শ অবশ্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তথা ভারতে আঞ্চলিক দলগুলি নিয়ে একটি ‘যুক্তরাষ্ট্রীয় ফ্রন্ট’ গড়ার প্রধান প্রবক্তা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও দিয়েছিলেন। কর্নাটকি সাফল্যে দারুণ খুশি তিনি। খুশি উত্তরপ্রদেশের মায়াবতী, অখিলেশ যাদব; অন্ধ্রের চন্দ্রবাবু নায়ডু, তেলঙ্গানার কে চন্দ্রশেখর রাও— মোটের উপর সব বিজেপি-বিরোধী অ-কংগ্রেসি আঞ্চলিক দলই। সিপিএম-সহ বাম দলগুলিও।
কর্নাটক কি তবে জাতীয় রাজনীতিতে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করল? এই সম্ভাবনায় কি জাতীয় রাজনীতিতে ১৯৯৬ সালের স্মৃতির প্রত্যাবর্তনেরও ইঙ্গিত বইছে? তার অর্থ কি ফের জাতীয় রাজনীতিতে অনিশ্চিতির, সরকারের ক্ষণস্থায়িত্বেরও প্রত্যাবর্তনের ইঙ্গিত? প্রশ্নগুলির উত্তর জরুরি, কারণ, এ সব নিয়েই রাজনৈতিক মহল থেকে হাটে-মাঠে-বাটে কয়েক দিন নানান চর্চা চলছে। আঞ্চলিক দলগুলি ও বিশেষত কংগ্রেসের পক্ষ থেকে এর যথাযথ জবাব ও তার সঙ্গে প্রয়োজনীয় রাজনীতির প্রয়োগও (বিশেষত কর্নাটকের ক্ষেত্রে) জরুরি। তাতে ব্যর্থ হলে ২০১৯ সালের নির্বাচনের সময় জনমনে এখন কিছুটা ‘ব্যাকফুটে’ থাকা বিজেপির ‘অপরিহার্যতা’ ফের প্রমাণিত হয়ে বসবে।
সবচেয়ে জরুরি কথা হল, প্রস্তাবিত অ-বিজেপি আঞ্চলিক দলগুলির প্রস্তাবিত ফ্রন্টের প্রকৃতি কী হবে? তার মধ্যে কি কংগ্রেস থাকবে? থাকলে কি ‘ভিতরে’ থাকবে, না ‘বাইরে’? ১৯৯৬ সালের ইউএফ মন্ত্রিসভাকে কংগ্রেস বাইরে থেকে সমর্থন করেছিল, সিপিএম-সহ কিছু বাম দলও বাইরে থেকেই সমর্থন করেছিল, কেবল সিপিআই ভিতরে ছিল। ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছিলেন।
কিন্তু গোড়া থেকেই সমস্যা করছিল বাইরের কংগ্রেস বন্ধুরা। দেবগৌড়ার প্রধানমন্ত্রিত্বের কয়েক মাস পর থেকেই ইউএফ-এর সঙ্গে কংগ্রেসের টানাপড়েন শুরু হয়, যার বাড়াবাড়িতে ৯ মাস ২১ দিনের মাথায় তিনি তাঁর পদটি হারান, বদলে ইন্দ্রকুমার গুজরালের নেতৃত্বে নতুন ইউএফ মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। কংগ্রেস এই সরকারকেও ‘বাইরে থেকে’ই সমর্থন করে। এ বারও মাত্র ১১ মাস শাসনের পর, মন্ত্রিসভায় ডিএমকে-কে রাখা চলবে না (কারণ, রাজীব-হত্যাকারীদের সঙ্গে ডিএমকে-র ‘যোগ’ ছিল), এই দাবিতে কংগ্রেস সমর্থন প্রত্যাহার করে। ফলত দুই প্রধানমন্ত্রীর মোট ২০ মাস শাসনের পর, কংগ্রেসের সমর্থনভিত্তিতে গড়া ইউএফ সরকার অস্তাচলে যায়।
‘বাইরে থেকে’ কংগ্রেসের শাসনের এর আগের নমুনাও ভাল নয়। ১৯৭৯ সালে মোরারজি দেশাইয়ের জনতা পার্টি মন্ত্রিসভা থেকে বেরিয়ে তদানীন্তন উপপ্রধানমন্ত্রী চৌধুরী চরণ সিংহ কংগ্রেসের ‘বাইরের সমর্থন’-এর ভরসায় নতুন মন্ত্রিসভা গড়েন। যার আয়ু ৫ মাস ১৪ দিন। এই সময়ের মধ্যে লোকসভার অধিবেশন বসেনি, ফলে নতুন মন্ত্রিসভা লোকসভায় বাধ্যতামূলক আস্থা ভোটও নিতে পারেনি। যে দিন এই আস্থা অর্জনের কথা, তার ঠিক আগের দিন কংগ্রেস তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করে। ফলে, চরণ সিংহের আর লোকসভায় ‘আস্থা’ নেওয়া হল না। এর পর, ১৯৯০ সালে ভি পি সিংহের ‘জাতীয় ফ্রন্ট’ সরকার থেকে চন্দ্রশেখর বেরিয়ে এসে কংগ্রেসের ‘বাইরের’ সমর্থনে নতুন মন্ত্রিসভা গড়েন, রাজীব গাঁধীর সঙ্গে মতবিরোধে ৭ মাস পরে পদত্যাগও করেন।
তাই, অন্য দলকে বাইরে থেকে সমর্থন করার ক্ষেত্রে কংগ্রেসের অতীত রেকর্ড মোটেই আশাব্যঞ্জক নয়। তবে, এ কথাও ঠিক যে ১৯৭০, ’৮০ বা ’৯০ দশকের কংগ্রেস আর আজকের কংগ্রেসের মধ্যে তফাত অনেকখানি। হাতে মাত্র একটি বড় রাজ্য: পঞ্জাব। তাই, বিপাকে পড়ে, ছোট শরিক কুমারস্বামীকে মুখ্যমন্ত্রী মেনে নিয়েই তাকে এখন কর্নাটকে জোট করতে হচ্ছে। ‘বাইরে’ থেকে নয়, সরকারে শামিল হয়েই। কিন্তু কথায় বলে, মরা হাতি লাখ টাকা। কংগ্রেস যে এখন ‘সেই-কংগ্রেস’ নেই, তা এখনও পুরনো নেতাদের মাথা থেকে যাচ্ছে না। জলসাঘর উপন্যাস/সিনেমার জমিদার বিশ্বম্ভর রায়ের মতোই তার মেজাজ, কেতাদুরস্ত চালচলন। তাতে সময় লাগে। তুলনায় বিজেপি যেন হাল আমলের নব্য ধনী মহিম গাঙ্গুলি। চটপট সিদ্ধান্ত নিয়ে কার্যসিদ্ধি করতে জুড়ি নেই। বিভিন্ন রাজ্যে প্রয়োজন মাফিক, ‘শক্তি’ থাকা সত্ত্বেও আঞ্চলিক দলের ‘ছোট’ শরিক হয়ে, ক্ষমতা বাড়িয়ে আজকের অবস্থায় এসেছে সে। তাই এই বার কর্নাটকে জোট সরকার সফল ভাবে চালানোর ক্ষেত্রে কংগ্রেসের ‘নমনীয়তা’র দিকে তাকিয়ে থাকবে বিভিন্ন রাজ্যের আঞ্চলিক দলগুলি। যদি কংগ্রেস তাতে সফল হয়, তবে তার প্রতি আঞ্চলিক শক্তিগুলির আস্থা বাড়বে।
দেশের রাজনীতিতে এই নতুন বিন্যাসের স্থপতিদের কাছে আশার কথা, কর্নাটক ভোটে রাহুল গাঁধী জেডিএস-কে তীব্র আক্রমণ করলেও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নমনীয়তার নিদর্শন রেখেছেন। রাজ্যে যথেষ্ট দলীয় নেতাদের (বড় শরিক হওয়ার সুবাদে) নানান আবদার/দাবি-দাওয়াকে বেশি গুরুত্ব না দিয়ে জোটধর্মকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। কর্নাটকে এই জোট যদি মসৃণ হয়, তবে তা ২০১৯ সালের লোকসভার আগে বিজেপি-বিরোধী রাজনীতির মডেল হয়ে উঠতে পারে। নতুবা, বিজেপির মতোই, সাধারণ মানুষও একে নিছক ক্ষমতা দখলের আরও একটি ‘সুবিধাবাদী’ রাজনীতির তকমাই দেবে।
বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক