সরকারের সমালোচনা মানেই দেশদ্রোহিতা নয়’— জাতীয় আইন কমিশন দৃঢ় ভাবে এই মত জানিয়ে ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪এ ধারাটি তুলে দেওয়ার প্রশ্নে দেশ জুড়ে আরও বিতর্কের আহ্বান জানিয়েছেন। ঠিক কোথায় গিয়ে বাকস্বাধীনতার শেষ এবং দেশদ্রোহিতার শুরু, এই বিষয়টা নিয়ে আরও বিতর্কের প্রয়োজন আছে। এবং আরও প্রয়োজন আছে ভবিষ্যৎ ভারতের গণতান্ত্রিক চেহারাটা কেমন হবে, সেই মূল বিতর্কটিও। অতএব দেশ জুড়ে মতামত ও বিতর্ক চলুক। প্রসঙ্গত, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের বাম ছাত্র নেতা কানহাইয়া কুমার-সহ আরও কয়েক জন নেতার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হলে দেশ জুড়ে তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি হয়। সেই বিতর্কের ফলে নরেন্দ্র মোদী সরকার জাতীয় আইন কমিশনকে ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪এ ধারাটি পর্যালোচনা করে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ জানানোর দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তার পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় আইন কমিশনের ওই মতামত ও বিতর্কের আহ্বান। এবং এই বিতর্কে আইন কমিশন নিজেই কতগুলো প্রশ্ন তুলেছে। যার একটি হল ভারতীয়দের দমন করার জন্য ব্রিটিশরা আইপিসি-তে যে ধারা ঢুকিয়েছিল, এখন তা চালু রাখা কতটা যুক্তিসঙ্গত? তাছাড়া, বাকস্বাধীনতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা যেখানে বিশ্বের এই বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশটির প্রধান অঙ্গ সেখানে রাষ্ট্রদ্রোহের সংজ্ঞা নতুন করে লেখার প্রয়োজন নয় কি? আদালতের অবমাননা যেখানে দণ্ডনীয়, সেখানে বৈধ ভাবে প্রতিষ্ঠিত সরকারের অবমাননা কি শাস্তিযোগ্য নয়? সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে ১২৪এ ধারার অপপ্রয়োগ বন্ধে সম্ভাব্য রক্ষাকবচ কী হতে পারে?
ভারতে রাষ্ট্রদ্রোহ বা দেশদ্রোহিতার সাথে সংযুক্ত আইন ১২৪এ ধারাটি ঔপনিবেশিক। বিনা বিচারে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জেলে ভরতে ইংরেজ সরকার ১৮৬০ সালে এই আইনটি প্রয়োগ করেছিল। ১৮৯১ সালের ৭ আগস্ট ভারতে বঙ্গবাসী পত্রিকার সম্পাদক রামচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে এই আইনে প্রথম গ্রেফতার করা হয়। লোকমান্য বালগঙ্গাধর তিলক তিন তিন বার (১৮৯৭, ১৯০৯ ও ১৯১৬) এই আইনে গ্রেফতার হন। মজফ্ফরপুরে ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকীর সমর্থন এবং বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সমর্থনে তাঁর পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হওয়ার জন্য তিলকের ছ’মাস কারাদণ্ড হয়। হরিজন পত্রিকায় সরকার বিরোধী নিবন্ধ লেখার জন্য মহাত্মা গাঁধীর বিরুদ্ধে ১২৪ (ক) ধারা প্রয়োগ করা হলে গাঁধী মন্তব্য করেছিলেন— rape of the word law। শ্রীঅরবিন্দের বিরুদ্ধেও একই ভাবে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয়েছিল। অথচ, স্বাধীন ভারতে এই আইনকে বর্জন করা হল না। বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারত, যেখানে সংবিধানে মতপ্রকাশ ও বক্তব্যের স্বাধীনতাকে মৌলিক অধিকারের মধ্যে রাখা হয়েছে, সেখানে এই আইনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। উঠতে পারে দেশদ্রোহিতার আইনটিকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করার বিতর্কও। কেন এবং কোন পরিপ্রেক্ষিতে এই আইনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে?
জনশান্তি বিঘ্নিত না করে স্বাধীন দেশের নাগরিক স্বাধীন ভাবে সরকারের কোনও সিদ্ধান্তের বিরোধিতা বা গঠনমূলক সমালোচনা করতে পারবেন না কেন? দেশ যদি গঠনমূলক সমালোচনা গ্রহণ করতে না পারে, সরকার তার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা মানতে না পারে, ‘দেশদ্রোহিতার’ অজুহাত তুলে বিরোধী কণ্ঠরোধ করতে থাকে, তা হলে স্বাধীনতা-পূর্ব ও স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের মধ্যে পার্থক্য থাকল কোথায়! নিজের ইতিহাসকে সমালোচনা করার অধিকার, সরকারি সিদ্ধান্ত জনবিরোধী কি না তা নিয়ে বিশ্লেষণ ও কঠোর সমালোচনা এবং তা নিয়ে দেশজুড়ে বিশাল জনমত গড়ে তোলা, এ সব কিছুই স্বাধীন ভারতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার মধ্যে পড়ে। কঠোর সমালোচনার মূল উদ্দেশ্যই হল সরকারি নীতির ফাঁক-ফোকরগুলিকে চিহ্নিত করা। এবং তা করতে গিয়ে সমালোচকদের বক্তব্য কঠোর হতে পারে, সেটা কারও কারও কাছে অস্বস্তিকর বলেও মনে হতে পারে। তাই বলে, কেবল সেই কারণে তাঁদের ‘দেশদ্রোহী’ তকমা দেওয়া কতটা যুক্তিযুক্ত তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। সরকারের কোনও জনবিরোধী নীতির যুক্তিসঙ্গত সমালোচনা, তা নিয়ে দেশ জুড়ে জনমত তৈরি করা, হিংসা না ছড়িয়ে অহিংস পথে দেশ জুড়ে সরকার বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলা— কোনওটাই দেশদ্রোহিতা বা অবৈধ ভাবে সরকারকে উৎখাত করার চেষ্টার মধ্যে পড়ে না । তা ছাড়া, কেউ সরকারি নীতি নিয়ে সমালোচনামূলক ভাবনা প্রকাশ করলেই তাকে দেশদ্রোহিতার দায়ে অভিযুক্ত করা যায় না। নিজের মতো করে দেশের প্রতি আনুগত্য ব্যক্ত করার অধিকার রয়েছে প্রতিটি মানুষের। যেখানে সশস্ত্র এবং বেআইনি পদ্ধতিতে সরকারকে উৎখাত করার উদ্দেশ্য রয়েছে, কেবলমাত্র সেই ক্ষেত্রেই কঠোর দেশদ্রোহী আইন বলবৎ করা যেতে পারে। কমিশনও এমন অভিমত ব্যক্ত করেছে। ব্রিটিশ সরকার নিজের দেশে ২০০৯ সালে এই আইনটি বাতিল করে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট অ্যাডামসের কর্তৃত্ববাদী ফেডারেলিস্ট সরকার ১৭৯৮ সালে আমেরিকার দুই প্রধান দল ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকান এবং সংবাদপত্রের সমালোচনার মুখ বন্ধ করতে রাষ্ট্রদ্রোহ আইন করেছিল। যুক্তরাষ্ট্রে এখন আর সেই আইন নেই।
দেশদ্রোহিতার উল্টো পিঠে বাকস্বাধীনতা, মুক্ত চিন্তা, দেশ-সমাজ-জাতি প্রভৃতি শব্দগুলি অনিবার্য ভাবে চলে আসে। বর্তমানে জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় দেশের নাগরিকের উপর রাষ্ট্রের ভূমিকা অতি গুরুত্বপূর্ণ। অতএব, দেশের একটি সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা সামাজিক পরিকল্পনা বা নীতি নির্ধারণের প্রভাব দেশের জনসাধারণের উপর অবশ্যম্ভাবী। তাই, সরকারের যে কোনও নীতি-নির্ধারণ বা পরিকল্পনার যুক্তিসঙ্গত সমালোচনা করার গণতান্ত্রিক অধিকার দেশের প্রতিটি মানুষের থাকা দরকার। দেশদ্রোহিতার অজুহাত দেখিয়ে কোনও মতেই সেই অধিকার কেড়ে নেওয়া যায় না। এই কথাটা বোঝার জন্য সরকারের গণতান্ত্রিক চেতনা ও বোধ থাকারও ভীষণ দরকার রয়েছে । তা নাহলে তথাকথিত ‘দেশদ্রোহিতা’র লেবেলে নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকারটাই না চাপা পড়ে যায়!
এটা মনে রাখা দরকার যে, সমাজ বিকাশের নিয়ম মেনে চিন্তা ও কাজ করতে পারার নামই প্রগতিশীলতা৷ সমাজ বিকাশের নিয়মকে অস্বীকার করে যেমন কখনও মুক্তচিন্তক বা স্বাধীন মানুষ হওয়া যায় না, তেমনি মুক্ত চিন্তা বা মানুষের বাক স্বাধীনতাকে অস্বীকার করে একটি প্রগতিশীল, শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠিত হয় না। বিজ্ঞান ও যুক্তির আলোকে গঠনমূলক সমালোচনা যেমন রাষ্ট্রের ভাবী দিশা এনে দেয়, তেমনই সেই পথেই অর্জিত হয় মানুষের প্রকৃত স্বাধীনতা। একটি সত্যিকারের মানবিক সমাজ ও রাষ্ট্র যেমন মুক্তচিন্তা ও চিন্তার স্বাধীনতা এবং মানুষের বাকস্বাধীনতার পরিবেশ তৈরি করে দিতে পারে তেমনই মানুষের বাক স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা একটি শক্তিশালী ও জনকল্যাণকামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারে। যখন রাষ্ট্র নিজের প্রয়োজনে সরাসরি বা কোনও শক্তিশালী মাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে দেশের কোনও জাতি-গোষ্ঠী-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গের প্রতি সচেতনভাবে বিদ্বেষ ছড়ায় তখন সেখানে মুক্তবুদ্ধির চর্চা, বাক স্বাধীনতা গর্জে উঠে রাষ্ট্রকে তার সঠিক পথে এগিয়ে যেতে নির্দেশ দেয়। তবে, স্বাধীনতার নামে স্বেচ্ছাচারিতা যেমন অপ্রত্যাশিত, তেমনই নিয়ন্ত্রণের নামে নাগরিকের স্বাধীনতা হরণও মেনে নেওয়া যায় না। অতএব ‘দেশদ্রোহিতা’র আইন নিয়ে দেশ জুড়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ ও বিতর্ক চলুক।
(মতামত ব্যক্তিগত)
শিক্ষক, ইসলামপুর নসিপুর
হাই মাদ্রাসা