হাল আমলে কলকাতার পথেঘাটে ‘মেগা’ উপদ্রবের নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে অটো। সন্দেহ নেই, অটোর উপযোগিতা বনাম উপদ্রবের মকটেলে বাঙালি মধ্যবিত্তের রক্তচাপ রোজ বেড়ে চলেছে একটু একটু করে। শহর-শহরতলির এই অসংগঠিত ক্ষেত্র এখন দুঃশাসনের প্রতীক। এই প্রেক্ষিতেই রাজ্যের সরকার চালু করতে চলেছে নতুন অটো-নীতি। কলকাতা বাদে, দুর্গাপুর-আসানসোল ও শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়ির শহরাঞ্চলেই প্রাথমিক ভাবে চালু হতে চলেছে এই নীতি। কেতাবি অর্থে ‘নতুন নীতি’ ঘোষণা হলেও অটোর ‘পুরনো রোগ’ এতে কতটা সারবে— ঘোর সন্দেহ।
মনে রাখা দরকার, বড় আধুনিক শহরের পরিবহণ ব্যবস্থায় গণপরিবহণই এখন উন্নত বিকল্পের মর্যাদা পাচ্ছে। সংখ্যার নিরিখে অটো এই শহরের মোট যানসংখ্যার মাত্র তিন শতাংশ হলেও যাত্রী পরিবহণের নিরিখে সেটি তৃতীয় বৃহত্তম স্থান দখল করে। বাস বা ট্রেনের মতো বড় প্রাথমিক গণপরিবহণের যাত্রা শেষ যেখান থেকে, সেখান থেকেই শুরু অটোর মতো মধ্যবর্তী গণপরিবহণ ব্যবস্থার। অটোর গঠনবৈশিষ্ট্যের জন্যই কলকাতার মতো পুরনো শহরের অলি গলি ধরে এই যান মানুষের বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে যায়, সড়ক পরিবহণের আধুনিক দর্শন ‘ডোর টু ডোর’ ধারণার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে। ফলে দৌরাত্ম্যের প্রতীক হলেও এই যানকে বাদ দিয়ে আজ আর পরিবহণ ব্যবস্থা ভাবার সুযোগ নেই। বরং অটো থাকবে, এই শর্ত দিয়েই ভাবা দরকার আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার বিকল্প পথ।
প্রথমত বোঝা দরকার, অটো ব্যবস্থার প্রবর্তন ঘটেছিল শহর-শহরতলিতে নিম্ন আয়ের পরিমণ্ডলে বিকল্প কর্মসংস্থানের উপায় হিসেবে, অর্থাৎ বেকার সমস্যার আংশিক সমাধান হিসেবে। ফলে প্রথম থেকেই অটোর বাস্তুতন্ত্রে জড়িয়ে গিয়েছেন স্থানীয় রাজনীতির কুশীলবরা, যাঁদের নিয়ন্ত্রণের হাত ধরে অটোর রুট রচনা থেকে অটো পারমিট, অটোর ভাড়া, অটো স্ট্যান্ডের জায়গা, সবটাই নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। ফলে বিকল্প পেশা হিসেবে অটোর উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে সে ব্যবস্থায় প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে অনেক বেশি রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ চলে এসেছে, ভোট রাজনীতির পাটিগণিতের কারণেই।
ওই ভোটের পাটিগণিতই উত্তরোত্তর অটোচালক ও যাত্রিসাধারণের সম্পর্ককে বীজগণিতের মতো জটিল ও সঙ্কেতময় করে তুলেছে, ফলে দৈনন্দিন ঘটে চলেছে যাত্রী হেনস্থা। এই অবস্থায় অটো পরিবহণে শৃঙ্খলা আনতে প্রয়োজন আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা। ইট-বালি-সিন্ডিকেট রাজনীতির আবর্তে এখন গড়ে উঠেছে ‘অটো সিন্ডিকেট’ও। অটো দৌরাত্ম্যের মূল শক্তি এই অটো সিন্ডিকেটেই লুকিয়ে। এরা ইচ্ছেমতো মূল রুট কেটে ছোট করে বাড়তি ভাড়া আদায় করে যাত্রীদের থেকে। এক দিকে অসময়ে ওলা-উব্র’এর মেজাজি বাড়তি ভাড়ার প্রভাব পড়ছে অটোরিকশার ক্ষেত্রে। অন্য দিকে হলুদ ট্যাক্সির যাত্রী প্রত্যাখ্যানের ব্যাধিও প্রসারিত হচ্ছে অটোবাহিনীতে। তাই অটোকে নিয়মের বাঁধনে বাঁধতে হলে শুধুমাত্র টোল-ফ্রি নম্বরে পুলিশকে ফোন করার বার্তা দিলে হবে না। একটা অসুস্থ পরিবহণ ব্যবস্থা যে গোটা সমাজকেই আরও বড় অসুখের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, সেটা বুঝতে হবে।
দ্বিতীয়ত, মানতেই হবে যে নারীর ক্ষমতায়ন পর্বে শহরের পরিবহণে অটোর বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এই সময়কালে অটোযাত্রী হিসেবে উত্তরোত্তর মহিলা ও ছাত্রীদের সংখ্যা বেড়েছে, যাঁরা লেখাপড়া বা কাজের প্রয়োজনে অটোকে বেছে নিয়েছেন বাহন হিসেবে। উদ্বেগের বিষয় হল, অটোর মহিলা যাত্রীদের ক্রমবর্ধমান হেনস্থা। সম্প্রতি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে মানবীবিদ্যার এক গবেষণায় উঠে এসেছে যে শহরের ৭২ শতাংশ অটোচালকের গৃহিণীরা ঘরকন্নায় নিয়োজিত। চালকরা বিশ্বাস করেন সংসারের স্বার্থে ‘ঘরের বৌ’ বাইরে কাজে যোগ না দিলেই শ্রেয়। এমন মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ চালকরা, ও তুলনায় অল্পবয়সি চালকরা মহিলা যাত্রীদের প্রতি বাড়তি অসহিষ্ণু আচরণ করেন কেন, তা সহজেই অনুমেয়। এই প্রেক্ষিতে যানসমস্যার বাইরে গিয়েও অটো-শাসনের সামাজিক গুরুত্বটা ভাবতে হবে।
তৃতীয়ত, ব্যক্তিগত মোটরগাড়ি ব্যবহারে যাত্রী পিছু দূষণের পরিমাণ অটোর চেয়ে বেশি। কিন্তু অটোর সেই দূষণ বাসের তুলনায় ছয় গুণ বেশি। ফলে গণপরিবহণে বাসের বিকল্প হিসেবে অটোর ভাবনা সমীচীন নয়। কলকাতা পুলিশের এক সাম্প্রতিক রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে গত দু’বছরে শহরে বাস-মিনিবাস বৃদ্ধির হার মাত্র তিন শতাংশ, যা যাত্রী চাহিদার তুলনায় অতি নগণ্য। পাশাপাশি শহরে মোট যানসংখ্যার নিরিখে অটোর পরিমাণ ৩.০৫ শতাংশ থেকে নেমে দাঁড়িয়েছে ২.৭ শতাংশ। এই অবস্থায় বিকল্প হিসেবে ব্যক্তি-মালিকানা নির্ভর পরিবহণে জোর বাড়ছে। গত তিন বছরে শহরে মোটরবাইক ও চার-চাকা গাড়ির সংখ্যা বেড়েছে যথাক্রমে ২০.৩ শতাংশ ও ৮.৫ শতাংশ। তাই শুধুমাত্র যান-শাসন পরিকল্পনাই যথেষ্ট নয়, পাশাপাশি চাই উন্নত পরিবহণ পরিকাঠামো গড়ার বিকল্প ভাবনাও। শহরের রাস্তার ধারণক্ষমতা কমছে, কমছে যান-চলাচলের গতি। ফলে বাড়ছে গতিমন্দার কারণে যান-দূষণও। অটোতে কাটা তেলের ব্যবহারও দূষণের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিচ্ছে। আরও আশ্চর্যের, রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডার দিয়ে অবাধে শহরে চলছে অটো, বিস্ফোরণের বিশাল ঝুঁকি সঙ্গে নিয়েই। ফলে বহুমাত্রিক দৃষ্টিতেই এই সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হতে হবে। নয়তো কানাগলিতে ঘুরপাক খাওয়াই আমাদের ভবিষ্যৎ।