বিপণনের দুনিয়ায় বিমান বসুর আসন অক্ষয় হইল। শ্যাম্পুর স্যাশের ন্যায়, টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের ন্যায়, তিনি ছয় ঘণ্টার বন্ধ বাজারে ছাড়িলেন। অতীতে যাহা কেবলমাত্র বড় বোতল বা পঞ্চাশ ওভারের মাপে পাওয়া যাইত, তাহাকেই ছাঁটিয়া ছোট প্যাকেটে বেচিবার পদ্ধতির সাফল্য বাজারে প্রমাণিত। ভারতে শ্যাম্পুর বাজারের ৭০ শতাংশই স্যাশের দখলে। টেলিভিশন স্বত্বের নিরিখে আইপিএল পঞ্চাশ ওভারের খেলাকে গোহারান হারাইতেছে। ২৪ ঘণ্টা, নিদেনপক্ষে ১২ ঘণ্টার বন্ধকে মাত্র ছয় ঘণ্টায় নামাইয়া আনিয়া বিমান বসুও কি সেই সাফল্য আশা করিতে পারেন? তাঁহাকে মুখের উপর ‘না’ বলিয়া দিতে রাজ্যবাসীর খারাপ লাগিবে নির্ঘাত— ‘জলসাঘর’-এ যেমন বিশ্বম্ভর রায়, মেটিয়াবুরুজে যেমন ওয়াজিদ আলি শাহ, আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে তেমনই বিমান বসু। একদা দোর্দণ্ডপ্রতাপ, অধুনা হৃতগৌরব, পরাজিত, সামর্থ্যহীন। বিশ্বম্ভর রায়দের প্রতি নির্মম হইতে মানুষের মায়া হয়। কিন্তু, তাহার পরেও, বিমান বসুকে আশার কথা শোনানো মুশকিল। শ্যাম্পুর স্যাশে হইতে আইপিএল, প্রতিটি সাফল্যের গল্পেই দুইটি উপাদান ছিল— এক, যে পণ্য বেচা হইতেছে, তাহার উপযোগিতা; দুই, যাঁহারা বেচিতেছেন, তাঁহাদের দক্ষতা। বিমানবাবু জানেন, তাঁহাদের সেই সোভিয়েত ইউনিয়নও নাই, সেই স্ট্যালিনও নাই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পশ্চিমবঙ্গে তাঁহাদের সফল হওয়ার সম্ভাবনা নরেন্দ্র মোদীর ধর্মনিরপেক্ষতার সমান।
বন্ধ বস্তুটি তাঁহাদের দীর্ঘ দিনের অস্ত্র। একদা ক্যালিফর্নিয়ায় অন্যায় হইলেও তাঁহারা কলিকাতায় বন্ধ ডাকিতেন, এবং তাহা বিলক্ষণ সফলও হইত। কিন্তু, সেই সাফল্য মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থনপুষ্ট ছিল না। এমনকী, এই কর্মবিমুখ বাংলাতেও মানুষের ইচ্ছায় বন্ধ সফল হইত না, হইত রাষ্ট্রযন্ত্রের কেরামতিতে। যবে হইতে সেই যন্ত্রের মালিকানা গিয়াছে, বিমানবাবুদের বন্ধও আর সফল হয় না। হয়তো তাঁহাদের মনে পড়িতে পারে, রাষ্ট্রযন্ত্রের শরিক না হইয়াও তাঁহাদের পূর্বসূরিরা দিব্য হরতাল ডাকিতে পারিতেন, তাহা সফলও হইত। সেই সাফল্যের এমনই তেজ ছিল যে পশ্চিমবঙ্গ বেবাক শিল্পহীন হইয়া গেল। বিমানবাবুরা ভাবিয়া দেখিতে পারেন, কেন। উত্তরটি হইল, তখন তাঁহাদের মানুষের নিকট যাওয়ার অভ্যাসটি ছিল। ৩৪ বৎসরের ক্ষমতায় সেই অভ্যাসটি হাওয়ায় মিলাইয়া গিয়াছে। কোনও বন্ধ-এরই সফল হওয়ার দরকার নাই— রাজ্যের পক্ষে তাহার অধিক ক্ষতিকর আর কিছু নহে— কিন্তু, রাজনীতি হইতে মানুষের সহিত সংযোগের অভ্যাসটি চলিয়া গেলে তাহার কী ফল হয়, বিমানবাবুরা ভাবুন।
বিমানবাবু জানাইয়াছেন, তাঁহাদের ধর্মঘটটি নিতান্তই প্রতীকী। কথাটি তাৎপর্যপূর্ণ। পঞ্চায়েত নির্বাচনকে কেন্দ্র করিয়া গোটা রাজ্যেই তাঁহাদের কর্মীরা আক্রান্ত বলিয়া আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের অভিযোগ। মুখ্যমন্ত্রী সেই অভিযোগটিকে উড়াইয়া দিয়াছেন। প্রশাসনও দৃশ্যত গা করিতেছে না। এ হেন পরিস্থিতিতে বিমানবাবুরা শেষ অবধি ‘প্রতীকী’ অস্ত্র বাছিয়া লইলেন? অবশ্য, বিমানবাবুরা প্রতীকেই পর্যবসিত হইয়াছেন। গত শতকের ক্ষয়িষ্ণু রাজনীতির প্রতীক। গণতন্ত্রকে অস্বীকার করিয়া, মানুষের রাজনীতি ভুলিয়া প্রশাসনিক যন্ত্রের উপর নির্ভর করিয়া দখলদারির পরিণতির প্রতীক। সমস্যা হইল, বিরোধী রাজনীতির পরিসরটি গুটিকয় প্রতীকের তুলনায় ঢের বড়। সেই পরিসরটিকে ব্যবহার করিবার শক্তি যে বামপন্থীদের আর নাই, তাহা স্পষ্ট হইয়াছে। প্রধান বিরোধী দল হইয়া উঠিতেছে বিজেপি। তাহার পরও আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের প্রতীকই ভরসা। আইপিএল-এর বাজারে ছয় ঘণ্টার বন্ধ। রাজনীতি না হউক, চমক তো হইল।