বৈষম্যে বসতে লক্ষ্মী?

ভারতে অর্থনৈতিক অসাম্য কমার কোনও লক্ষণ নেই

এই বিপুল বৈষম্য বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে যা নির্ণয় করা জরুরি তা হল ভারতে ‘ইকনমিক মোবিলিটি’ বা অর্থনৈতিক শ্রেণিবিন্যাসে ওঠানামার হার।

Advertisement

পুনরজিৎ রায়চৌধুরী

শেষ আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০০:০১
Share:

গত দু’দশকে ভারতে অর্থনৈতিক বৈষম্য বিপুল ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৭ সালে ক্রেডিট সুইস সংস্থা প্রকাশিত ‘গ্লোবাল ওয়েলথ রিপোর্ট’-এ দাবি করা হয়েছে, ভারতের সবচেয়ে সম্পদশালী পরিবারটিকে প্রথম স্থানে রেখে অন্য পরিবারগুলিকে তাঁদের সম্পদের ভিত্তিতে ক্রমানুসারে সাজালে দেখা যাবে যে, ২০০২ থেকে ২০১২’র মধ্যে এই ক্রমবিন্যাসের প্রথম ১ শতাংশ পরিবারের সম্পদ ভারতের মোট সম্পদের ১৫.৭ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫.৭ শতাংশ, শেষ ৫০ শতাংশ পরিবারের সম্পদ মোট সম্পদের ৮.১ শতাংশ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ৪.২ শতাংশ। ২০১৮-১৯’এ সম্পদ বণ্টনে বৈষম্যের চেহারা আরও ভয়াবহ। অক্সফ্যাম-এর সাম্প্রতিক এক রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতের সবচেয়ে ধনী ১ শতাংশ পরিবারের কুক্ষিগত দেশের মোট সম্পদের অর্ধেকেরও কিছু বেশি! উল্লেখ্য, সম্প্রতি এক গবেষণায় ফরাসি অর্থনীতিবিদ টমাস পিকেটি (ক্যাপিটাল ইন দ্য টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি গ্রন্থের লেখক) দেখিয়েছেন, ভারতে অর্থনৈতিক বৈষম্য এখন ৯৬ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি!

Advertisement

এই বিপুল বৈষম্য বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে যা নির্ণয় করা জরুরি তা হল ভারতে ‘ইকনমিক মোবিলিটি’ বা অর্থনৈতিক শ্রেণিবিন্যাসে ওঠানামার হার। সহজ ভাষায় বললে, এই হার দেখায়— একটি নির্দিষ্ট সময়কালে সমাজে কত জন মানুষ (বা ক’টি পরিবার) বিভিন্ন অর্থনৈতিক শ্রেণির (যেমন, দরিদ্র, মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত) মধ্যে ওঠানামা করছেন, যা বুঝতে সাহায্য করে— সেই সমাজ অর্থনৈতিক ভাবে কতটা গতিশীল। অর্থনৈতিক শ্রেণিবিন্যাসে ওঠানামার হার নির্ণয় করা জরুরি, কারণ ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব নির্ভর করে অর্থনৈতিক গতিশীলতার উপর। অর্থনৈতিক গতিশীলতা (বা তার অভাব) অসমতার বিরূপ প্রভাবের মাত্রা কমাতে (বা বাড়াতে) পারে। প্রবল ভাবে অর্থনৈতিক গতিশীল একটি অর্থনীতিতে, যেখানে পরিবারগুলি আয় বা খরচের বণ্টনে অবাধে ওঠানামা করে, সেখানে স্থায়ী আয় ও খরচের বণ্টন কম গতিশীলতাযুক্ত অর্থনীতির তুলনায় সুষম হবে।

ভারতে অর্থনৈতিক গতিশীলতা ঠিক কতটা এবং ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের পরিপ্রেক্ষিতে তা সমাজের জন্য ঠিক কী অর্থ বহন করে, সেটা বুঝতেই সাম্প্রতিক এক গবেষণায় আমি ও আমার সহগবেষকরা ভারতে অর্থনৈতিক শ্রেণিবিন্যাসে ওঠানামার হার হিসেব করার চেষ্টা করি ইন্ডিয়ান হিউমান ডেভেলপমেন্ট সার্ভে-র (আইএইচডিএস) দু’টি রাউন্ডের তথ্যের ভিত্তিতে। আইএইচডিএস একটি জাতীয় প্রতিনিধিমূলক বহু-বিষয়ক গৃহস্থালি-সমীক্ষা, যা ২০০৫ আর ২০১২-য় ভারত জুড়ে প্রায় ৪০,০০০-এরও বেশি পরিবারকে সমীক্ষা করে। উল্লেখ্য, এর দ্বিতীয় রাউন্ডে যে পরিবারগুলির উপর সমীক্ষা চালানো হয়, তাদের বেশির ভাগই সমীক্ষার প্রথম রাউন্ডে অংশগ্রহণ করেছিল।

Advertisement

ভারতে অর্থনৈতিক শ্রেণিবিন্যাসে ওঠানামার হার হিসেব করার জন্য আমরা আইএইচডিএস-এর ২০০৫ ও ২০১২-র সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারী পরিবারগুলির পুরো নমুনাটিকে তিনটি ভাগে ভাগ করি দু’টি বছরের জন্য আলাদা আলাদা করে। প্রথম ভাগে অন্তর্ভুক্ত করি সেই পরিবারগুলিকে যাদের মাসিক খরচ সরকারি (অর্থনীতিবিদ সুরেশ তেন্ডুলকর কমিটি দ্বারা প্রস্তাবিত) দারিদ্রসীমার নীচে (এই পরিবারগুলি দরিদ্র শ্রেণির অন্তর্গত), দ্বিতীয় ভাগে অন্তর্ভুক্ত করি সেই সমস্ত পরিবারকে যাদের মাসিক খরচ দারিদ্রসীমার ১০০ শতাংশ থেকে ২০০ শতাংশের মধ্যে (এরা দারিদ্রসীমার ঠিক উপরে, তাই এদের অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল বলা যায়), তৃতীয় ভাগের অন্তর্ভুক্ত করি সেই পরিবারগুলিকে যাদের মাসিক খরচ দারিদ্রসীমার ২০০ শতাংশের উপরে (এদের অর্থনৈতিক ভাবে সুরক্ষিত বলা যায়)। তার পর ২০০৫-এর নমুনাটির তিনটি ভাগের প্রতিটির জন্য আমরা অঙ্ক কষে বার করি— ২০০৫-এ একটি নির্দিষ্ট ভাগের অন্তর্ভুক্ত পরিবারগুলির ২০১২-য় একই ভাগে থাকার এবং অন্য দু’টি ভাগের প্রতিটিতে পৌঁছানোর সম্ভাবনা কতটা। অঙ্ক কষে বার করা এই সম্ভাবনাগুলিকে, অর্থনীতির ভাষায়, বলা হয় ‘ট্রানজ়িশন প্রবাবিলিটিজ়’ বা রূপান্তরের সম্ভাবনা। এর সমগ্র সেটটি আমাদের ভারতে দারিদ্রের সঙ্গে সম্পর্কিত অর্থনৈতিক গতিশীলতা সম্বন্ধে একটি পরিপূর্ণ ধারণা দেয়।

গবেষণায় দেখছি, গোটা ভারতের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক শ্রেণিবিন্যাসে ওঠানামার হার চোখে পড়ার মতো কম। সাত-আট বছরের সময়কালে দশটি দরিদ্র পরিবারের মধ্যে অন্তত সাতটি হয় দারিদ্রসীমা পেরোতে পারে না, বা সীমা পেরোলেও অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল থেকে যায় এবং দশটির মধ্যে খুব বেশি হলে দু’টি পরিবার অর্থনৈতিক ভাবে সুরক্ষিত হয়ে উঠতে পারে। অন্য দিকে, অর্থনৈতিক ভাবে সুরক্ষিত দশটি পরিবারের মধ্যে খুব বেশি হলে দু’টি পরিবারের দারিদ্রসীমার নীচে নেমে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।

অর্থাৎ, আমাদের দেশে যাঁরা নীচের তলার বাসিন্দা, তাঁদের উপরে ওঠার সম্ভাবনা, পাঁচ বছরেরও বেশি সময়কালে, প্রায় নেই বললেই চলে। নীচের তলার যাঁরা, মোটের ওপর তাঁদের ওঠার পথ বন্ধ। তেমনই, যাঁরা উপরের তলার বাসিন্দা তাঁদের নীচে পড়ে যাওয়ার বিশেষ ভয় নেই।

আমাদের গবেষণার কাল ২০০৫ থেকে ২০১২, যখন ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির হার ছিল বেশি। সেই সময়ের তথ্যের ভিত্তিতেই অর্থনৈতিক গতিশীলতার অভাবের স্পষ্ট ইঙ্গিত পাচ্ছি। সুতরাং ধরে নেওয়া যেতেই পারে, গত কয়েক বছরে, যখন আমাদের দেশে আর্থিক বৃদ্ধির হার ছিল ২০০৫-১২’র তুলনায় অনেকটাই কম, সেই সময় অর্থনৈতিক গতিশীলতার অভাব আরও প্রকট হয়েছে। সে ক্ষেত্রে গরিবদের গরিব এবং বড়লোকদের বড়লোক থাকার সম্ভাবনা আজ হয়তো আগের থেকেও বেশি।

আমরা বিভিন্ন জাতি ও জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক শ্রেণিবিন্যাসে ওঠানামার হারও আলাদা আলাদা ভাবে গণনা করি তুল্যমূল্য বিচারের জন্য। আমরা যা দেখতে পাচ্ছি তা হল এই রকম।

প্রথমত, সাত-আট বছরের সময়কালে, হিন্দু বা অন্য ধর্মাবলম্বীদের তুলনায় মুসলমানদের দারিদ্রসীমার নীচে নেমে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেকটা বেশি। অন্য দিকে, মুসলমানদের দারিদ্রসীমার নীচ থেকে অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল শ্রেণিতে পৌঁছানোর সম্ভাবনা ও অর্থনৈতিক ভাবে সুরক্ষিত হিসেবে থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা অন্যান্য ধর্মের মানুষদের তুলনায় কম।

দ্বিতীয়ত, এই সময়কালে উচ্চবর্ণ ও অন্যান্য পিছিয়ে পড়া শ্রেণির (ওবিসি) তুলনায় তফসিলিভুক্ত জাতি ও জনজাতীয় মানুষদের দারিদ্রসীমার উপরে ওঠার সম্ভাবনা অনেক কম, দারিদ্রসীমার নীচে নেমে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। আবার, উচ্চবর্ণের তুলনায় ওবিসি-ভুক্ত মানুষদের দারিদ্রসীমার নীচে নেমে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি এবং সীমার নীচ থেকে অর্থনৈতিক ভাবে সুরক্ষিত হয়ে ওঠার, বা অর্থনৈতিক ভাবে সুরক্ষিতদের সেই বর্গেই থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক কম।

তৃতীয়ত, শহরের বাসিন্দাদের তুলনায় গ্রামীণ এলাকায় বসবাসকারী মানুষদের দারিদ্রসীমার নীচে থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। শহরের মানুষদের তুলনায় গ্রামীণ এলাকায় বসবাসকারী মানুষদের দারিদ্রসীমার উপরে ওঠার সম্ভাবনা কম এবং সীমার নীচে নেমে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

আমাদের গবেষণার ফলাফলের ভিত্তিতে সামগ্রিক ভাবে ভারতে অর্থনৈতিক বৈষম্যকে দীর্ঘস্থায়ী হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে, যে হেতু দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত পরিবারগুলির দারিদ্রের জালে আটকে পড়ার সম্ভাবনা খুব বেশি। ফলে, দারিদ্র কমানোর জন্য সরকারের ও নীতিনির্ধারক সংগঠনগুলির উচিত অস্থায়ী অর্থনৈতিক অস্থিরতার সঙ্গে মোকাবিলা করার উপায়গুলির পরিবর্তে, সম্পদ এবং ক্ষমতা অর্জনের মাধ্যমে দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত পরিবারগুলির স্থায়ী অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতির উপায়গুলিতে মনোনিবেশ করা।

ভারতে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীগুলি অর্থনৈতিক ভাবে উঠে আসছে— প্রচলিত এই ধারণাটিকেও চ্যালেঞ্জ জানায় আমাদের গবেষণার ফলাফল। ভারতে প্রান্তিক গোষ্ঠীগুলির অর্থনৈতিক অবস্থান উন্নয়নে প্রচলিত স্বীকৃতিমূলক ব্যবস্থা (যেমন উচ্চশিক্ষায় বা সরকারি চাকরিতে জাতিভিত্তিক সংরক্ষণ) ও সামাজিক কর্মসূচিগুলির কার্যকারিতা সম্পর্কেও এই গবেষণা বড়সড় প্রশ্ন তুলে দেয়।

ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট, ইনদওর

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement