আমি প্রশ্ন তুলতে চাই। আমরা সীমান্তে পুরোপুরি প্রস্তুত ছিলাম কি না, তা কি প্রধানমন্ত্রী জানতেন? জানা থাকলে প্রধানমন্ত্রী কেন বলেননি যে এ দেশের জমি থেকে চিনাদের উৎখাত করতে তিনি সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন? বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর অজানা থাকলে, কারা তাঁকে অন্ধকারে রেখেছিলেন? সরকার কি গ্যারান্টি দিচ্ছে, যা হয়ে গিয়েছে তার পুনরাবৃত্তি হবে না?”— না, রাহুল গাঁধী বা সনিয়া গাঁধী এ প্রশ্ন তোলেননি।
এই প্রশ্নকর্তার অভিযোগ, “এই সঙ্কটের সময়েও আমাদের সরকার স্পষ্ট করে মানতে রাজি নয় যে চিনের উদ্দেশ্য, চিনের সামরিক প্রস্তুতি এবং চিনের অনুপ্রবেশ ঠিক ভাবে বুঝতে গাফিলতি ঘটেছে। অথচ চিন গোটা দুনিয়ার সামনে, পড়শি দেশের সামনে, আমাদের নিজেদের চোখেই আমাদের খাটো করে দিয়েছে। এই হামলা চালিয়ে তারা প্রমাণ করে দিয়েছে যে সুরক্ষা ব্যবস্থার দিক থেকে আমরা কত দুর্বল ছিলাম। চিন এখন শান্তির অবতারের রূপ ধরবে। কিন্তু ওদের উদ্দেশ্য এক দিক থেকে পূরণ হয়ে গিয়েছে।” না, আজকের বিরোধী শিবিরের কোনও নেতা এমন কথা বলে মোদী সরকারের সমালোচনা করেননি।
তবে কে বলেছিলেন এই সব কথা? সংসদের পুরনো রেকর্ড ঘাঁটলে দেখা যাবে, ১৯৬২ সালের ৯ নভেম্বর এক তরুণ রাজনীতিক রাজ্যসভায় দাঁড়িয়ে সরকারকে এই ভাবেই কাঠগড়ায় তুলেছিলেন। তাঁর নাম? অটলবিহারী বাজপেয়ী। তাঁর বয়স তখন মাত্র ৩৮ বছর।
অটলবিহারী আজ এ সব প্রশ্ন করলে তাঁকে কী বলা হত? ‘জাতীয়তাবাদী’ বিজেপি নেতারা বলতেন, চিনের বিরুদ্ধে ভারতের এককাট্টা থাকার সময়ে বাজপেয়ী বিভাজন তৈরির চেষ্টা করছেন! সেনাবাহিনীর মনোবল ভেঙে দিচ্ছেন, সেনাকে অপমান করছেন! জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে রাজনৈতিক ফায়দা কুড়োতে চাইছেন।
লাদাখে চিনের অনুপ্রবেশ এবং চিনা সেনার হাতে এক কর্নেল-সহ ২০ জন জওয়ান নিহত হওয়ার ঘটনা নিয়ে বিরোধীরা প্রশ্ন তুললে বিজেপির উপর থেকে নিচুতলার নেতারা ঠিক এই কথাগুলিই বলছেন। বিরোধীদের অভিযোগ, চিনের সেনা গত ৫ মে থেকেই প্যাংগং লেকে ভারতের এলাকা দখল করে বসে রয়েছে। সরকার কি সেই তথ্য ধামাচাপা দিয়ে রেখেছিল? সত্যিটা কী?
প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ বলেছেন, তিনি সব প্রশ্নের জবাব সংসদে দেবেন। কিন্তু করোনাভাইরাসের ভয় কাটিয়ে কবে সংসদের অধিবেশন ডাকা হবে, কেউ জানে না। অধিবেশন দূরে থাক, বিরোধীরা সংসদীয় কমিটির বৈঠক ডাকার দাবি তুলছেন, সে আর্জিও কানে তোলা হচ্ছে না। বলা হচ্ছে, ভিডিয়ো কনফারেন্সে সংসদীয় কমিটির বৈঠকে গোপনীয়তা থাকবে না। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু কিন্তু সংসদের অধিবেশন ডাকতে দেরি করেননি।
১৯৬২-র অক্টোবরে চিনা সেনা আজকের অরুণাচল প্রদেশ, সে দিনের ‘নেফা’য় ঢুকে পড়ার পরে নেহরু সরকার দেশে জরুরি অবস্থা জারি করে। দিনটা ২৬ অক্টোবর। সে দিনই বাজপেয়ী নেহরুর সঙ্গে দেখা করে দাবি তোলেন, এখনই সংসদের অধিবেশন ডাকা হোক।
মনে রাখা দরকার, জন সঙ্ঘের সাংসদ সংখ্যা তখন মাত্র চার। আর নেহরুর রয়েছে লোকসভায় দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। তবু নেহরু অটলের দাবি মেনে নেন। তিনি অজুহাত দেখাননি যে অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে যখন সংঘাত চলছে, তখন বিরোধীদের উচিত সরকারের পাশে দাঁড়ানো, সরকারের সমালোচনা করা নয়। ৮ নভেম্বর সংসদের অধিবেশন ডাকা হয়। তার আগেই প্রতিরক্ষামন্ত্রী ভি কে কৃষ্ণ মেননের ইস্তফা হয়ে গিয়েছে।
নেহরু চাইলে গোপন রুদ্ধদ্বার অধিবেশন ডাকতে পারতেন। সেই প্রস্তাবও ছিল। কিন্তু তিনি বলেছিলেন, গোটা দেশ এ বিষয়ে চিন্তিত। সংসদের আলোচনা গোপনে হলে ভুল বার্তা যাবে। লোকসভায় টানা এক সপ্তাহ বিতর্ক চলে। বাজপেয়ী তখন রাজ্যসভায়। তিনি বলার সুযোগ পান বিতর্কের দ্বিতীয় দিনে— ৯ নভেম্বর। যুদ্ধ তখনও থামেনি। বাজপেয়ী যখন দিল্লির সংসদে নেহরুকে নিশানা করছেন, তখন চিনের সেনা নেফায় একের পর এক পর্বত ডিঙিয়ে ঢুকে আসছে।
আজ লাদাখে চিন ভারতের এলাকা দখল করে বসে রয়েছে, ভারতের মাটিতেই ভারতীয় সেনার নজরদারিতে বাধা দিচ্ছে, বাঙ্কার তৈরি করে ঘাঁটি গাড়ার চেষ্টা করছে। বিদেশ মন্ত্রক বা সেনাবাহিনী তা খোলাখুলিই বলছে। বস্তুত, চিনের সঙ্গে দর কষাকষিতে ভারতের প্রধান দাবিই হল, চিন পিছু হঠে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার উল্টো দিকে নিজের এলাকায় ফিরে যাক। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সর্বদলীয় বৈঠক ডেকে দাবি করে বসলেন, কেউ ভারতের এলাকায় ঢোকেনি, কেউ ভারতের এলাকায় বসেও নেই। পরে প্রধানমন্ত্রীর দফতর তাঁর মন্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়ে সর্বদলীয় বৈঠকের বিবৃতি থেকে ওই অংশটুকু মুছে দিয়েছে।
সরকারের বাস্তব স্বীকারের অনীহা নিয়ে ৬২-তে বাজপেয়ী আক্ষেপ করেছিলেন। রাজ্যসভায় তিনি বলেছিলেন, “আমাদের এ কথা স্বীকার করতে সঙ্কোচ হওয়া উচিত নয় যে জাতীয় নিরাপত্তার দিকটি অবহেলা করে দেশের প্রতি বড় অপরাধ করেছি।” গণতান্ত্রিক ভারতের সংসদে সে দিন বাজপেয়ীকে কেউ বাধা দেননি, শোরগোল করে তাঁকে থামিয়ে দেওয়া হয়নি। বাজপেয়ীকে তখন কেউ ‘অ্যান্টি-ন্যাশনাল’ বলেও দাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেননি।
সেই যুদ্ধে ভারতের পরাজয়ের রাজনৈতিক ফায়দা কি বিরোধীরা তোলার চেষ্টা করেননি? অবশ্যই করেছিলেন। যুদ্ধের পরে চারটি উপনির্বাচনে জন সঙ্ঘ এবং অন্যান্য বিরোধীরা কংগ্রেসের বিরুদ্ধে এককাট্টা হয়ে লড়েছিলেন। দুই সমাজবাদী নেতা জে বি কৃপালনী ও রাম মনোহর লোহিয়া, স্বতন্ত্র পার্টির মিনু মাসানি ও জন সঙ্ঘের তৎকালীন সভাপতি দীনদয়াল উপাধ্যায় প্রার্থী হয়েছিলেন। দীনদয়াল ছাড়া বাকি তিন জনই ভোটে জিতেছিলেন। চিনের সঙ্গে যুদ্ধে দেশের পরাজয়কে হাতিয়ার করেই।
এটাই এ দেশের গণতন্ত্রের ইতিহাস। এটা চিন নয়। এ দেশে তাই বিরোধীরা প্রশ্ন তুলবেন, সরকারকে জবাবদিহি করতে হবে, এটাই রীতি। নেহরুর আমলে যেমন বাজপেয়ী প্রশ্ন তুলেছেন, বাজপেয়ীর জমানায় তেমনই কারগিলে পাকিস্তানের অনুপ্রবেশ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল কংগ্রেস। হালফিলে মনমোহনের সময় পাকিস্তান বা চিন অনুপ্রবেশের চেষ্টা করলে, বিজেপির অরুণ জেটলি, সুষমা স্বরাজরাও সরকারের ব্যর্থতার দিকে আঙুল তুলেছেন। দেশের ঐক্য বা সেনার মনোবলে ধাক্কা লাগতে পারে ভেবে হাত গুটিয়ে বসে থাকেননি।
প্রশ্ন হল, আজ বিরোধী শিবিরে এক জন অটলবিহারী বাজপেয়ী আছেন কি? প্রশ্নটা সহজ, উত্তরও জানা। বিরোধী শিবিরে এখন কোনও বাজপেয়ী নেই।
রাহুল গাঁধী নিয়মিত ভাবে মোদী সরকারকে প্রশ্ন ছুড়ছেন। কিন্তু তাঁর আসল তাগিদ, বিরোধী শিবিরের প্রধান নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা। তাঁকে কংগ্রেস সভাপতি পদে ফেরানোর চেষ্টা শুরু হয়েছে। কিন্তু কংগ্রেস নিজেই এখন দুর্বল। উপরন্তু বিরোধী শিবিরের বেশির ভাগ দলই কংগ্রেসের পাশে নেই। তামিলনাড়ুতে এডিএমকে, ওড়িশায় বিজু জনতা দল, অন্ধ্রপ্রদেশে ওয়াইএসআর কংগ্রেসের জগন্মোহন রেড্ডি, তেলঙ্গানায় চন্দ্রশেখর রাও বিজেপির দিকেই ঝুঁকে রয়েছেন। মায়াবতীও ক্রমশ বিজেপির দিকেই ঝুঁকে পড়ছেন। এমনকি এনসিপি, ডিএমকে-র মতো কংগ্রেসের শরিক দলগুলিও অন্য দেশের সঙ্গে সংঘাতের আবহে সরকারের কড়া সমালোচনা করতে নারাজ।
নেহরুর একটা মস্ত সুবিধা ছিল, সে সময় বিরোধী শিবির কার্যত ছত্রভঙ্গ ছিল। এখনও বিরোধী শিবির একই রকম ছত্রভঙ্গ। মোদী সরকারকে তাই কোনও জবাবদিহি করতে হচ্ছে না। লাদাখে কী ভাবে সমস্যা তৈরি হল, কী ভাবেই বা তার সমাধান হবে, তার জবাব দিতে কেউই সরকারকে বাধ্য করতে পারছে না। কারণ বাজপেয়ীর মতো কেউ প্রশ্ন তুলছেন না— “চিন যে ভাবে আমাদের ধোঁকা দিয়েছে, বিশাল সংখ্যায় সেনা পাঠিয়ে আক্রমণ করেছে, তার পরে আমরাই প্রথমে আক্রমণ করেছি বলে অভিযোগ তুলেছে, আমরা কি তা ভুলে যাব? ভুলে গেলে দেশের মানুষের, সেনার মনোবলের উপরে কি তার প্রভাব পড়বে না? চিন আমাদের এলাকা ছেড়ে বেরিয়ে গেলেও ফের ঢুকবে না, তার কী গ্যারান্টি?”