হলিউডে গত বৎসরে সর্বাধিক লাভ ঘরে তুলিয়াছে যে তিনটি ছবি, প্রতিটিই নারীচরিত্রকেন্দ্রিক। হইহই চলিতেছে। যে বৎসর #আমিও আন্দোলনটি বিশ্বব্যাপী ভার্চুয়াল জগতে ছড়াইয়া পড়িয়াছিল, যে বৎসর হলিউডের দুর্ধর্ষ নিয়ন্ত্রক ও নিয়ামকরাও নারীদের বিরুদ্ধে যৌন নিগ্রহের অভিযোগে থতমত খাইয়া গুটাইয়া গিয়াছেন, এবং উহার প্রেরণায় নারীদের নিজ জীবনের যৌন নিগ্রহ লইয়া কথা বলিবার পরিসর উন্মুক্ত হইয়া পড়িয়াছে, সেই বৎসরই নায়িকাচালিত ছবি লাভ-তালিকার তুঙ্গে অবস্থান করায়, ইহা এক প্রকার ন্যায়বিচারের মর্যাদা পাইয়াছে। এক ছবিতে নায়িকা অতিমানবীর ভূমিকায় অভিনয় করিয়াছেন, তাঁহার উল্লম্ফন, তীব্র লড়াই এবং অন্তে অবধারিত জয় দেখিয়া অনেকে ইহাকে নারীর জয়, নারীবাদের জয় বলিয়া উল্লাসে মাতিয়াছেন। অন্য এক ছবি রূপকথার কাহিনির গীতিনির্ভর রূপ, তাহাতে নারী এক বদখত জীবকে ভালবাসিয়া ফেলে, সেই জীব অবশ্য তাহাকে নেকড়েদের কবল হইতে বাঁচায়, কাহিনির বহু মোচড়ের শেষে উহাদের মিলন হয়, অবশ্যই বিকটদর্শন জীবটি অভিশাপ-অন্তে হইয়া যায় এক সুদর্শন রাজপুত্র। অন্য ছবিটি প্রখর কল্পবিজ্ঞান, তাহাতে এক নারীচরিত্র প্রেমের নিকটবর্তী হয় ও বিবিধ লড়াইও তুমুল করে। লক্ষ করিবার, তিনটি ছবিই অবাস্তব, ফ্যান্টাসি-আবৃত। এবং কোনওটির মধ্যেই নিজ আঙ্গিক ব্যবহার করিয়া পৃথিবীর বা আমেরিকার বাস্তবতা সম্পর্কিত মন্তব্য করিবার ন্যূনতম আগ্রহ নাই। কেবল অভাবনীয় চমকপ্রদ ঘটনা ও দৃশ্য দেখাইয়া বাজিমাত করিবার চেষ্টা। ফলে ইহাদের মধ্যে নারীচরিত্রের প্রাধান্য হলিউডের প্রচলিত ক্ষমতাবিন্যাসকে ভাঙিয়াছে হয়তো, কিন্তু ছবি হিসাবে ওইগুলি কোনও নারীত্বের জয় বা নারীর অবস্থান লইয়া আদৌ ভাবিত নহে।
এই নায়িকাগণ প্রত্যেকেই পুরুষতন্ত্রের নির্ধারিত ছাঁচে, পুংতন্ত্রের নিয়ম মানিয়া খেলিয়াছেন। যে অতিমানবীকে বাধ্যতামূলক ভাবে সুন্দরী ও আবেদনময়ী হইতে হয় ও সংক্ষিপ্ত পোশাকে দিগ্বিজয় করিতে বাহির হইতে হয়, তিনি প্রকৃত পক্ষে পুরুষের আকাঙ্ক্ষারই পুত্তলি। বিখ্যাত পরিচালক জেমস ক্যামেরন, যাঁহার এক কল্পবিজ্ঞানের ছবিতে নায়িকা ছিলেন প্রথাগত অর্থে কুদর্শনা কিন্তু যাঁহার চরিত্র তীব্র জেদ ও অধ্যবসায় দর্শাইয়া খ্যাত হইয়াছিল, তিনি এই কমিক্স হইতে উৎসারিত ছবি লইয়া বলিয়াছেন, নায়িকা নারী বলিয়া লাফাইবার কিছু নাই, সে পুরুষের মনোমত নারী মাত্র। অবশ্য ক্যামেরনের উক্ত ছবিতেও প্রকৃত মনোযোগের কেন্দ্র ছিলেন অলৌকিক পেশিবিশিষ্ট পুরুষ তারকা। রূপকথানির্ভর ছবিতেও নারীটি পিতার প্রতি ভালবাসা ও প্রেমিকের প্রতি ভালবাসার বৃত্তে ঘুরিয়া চলে, তাহার নিজের প্রতি মনোযোগ কম। তাই নারী হইয়া পরদায় পুরুষ চরিত্রকে বা তাহার চক্রান্তকে ইঁহারা পরাজিত করিতেছেন অবশ্যই, কিন্তু বাস্তব নারীবিরোধী সমাজে নারীর আপন ভাগ্য জয় করিবার দ্যোতনা তাহাতে নাই, থাকিলেও অতি সরলীকৃত।
ইহাও লক্ষণীয়, অভিনন্দনের কারণ হইতেছে ব্যবসায়িক সাফল্য। উচ্চ গুণমান নহে। ছবিগুলি জনপ্রিয় হইয়াছে বিলক্ষণ, কিন্তু ওইগুলি নিতান্ত হলিউডি মূলস্রোতের আমোদসর্বস্ব অগভীর ছবি, উহারা নূতন দিগন্ত উন্মোচন করিয়া চিত্রোৎসবে পুরস্কার জয় করে নাই। ফলে সেই ‘টাকা করিলেই জয়ী’ মতেরই সমর্থনে তালি বাজানো হইল, যাহা আগামী কাল টাকা করে নাই বলিয়া যথার্থ নারীবাদী ছবিকে আঁস্তাকুড়ে ফেলিয়া দিবে। অনেকে বলিতেছেন, হলিউডে নায়কদের তুলনায় নায়িকাগণ কম পারিশ্রমিক পান, তাহা লইয়া আন্দোলন চলিতেছে, নায়িকাদের লড়াই এই বার শক্তিশালী হইবে। এক বিখ্যাত হলিউডি নায়িকা বলিয়াছেন, উহার জন্য পূর্বে প্রয়োজন মহাতারকা পুরুষ অভিনেতাগণের অহং বিসর্জন দিয়া, পারিশ্রমিকের সমতা মানিয়া লওয়া। তাঁহারা যদি বলেন, কোনও অভিনেত্রীর তুলনায় কম পারিশ্রমিক লইতে রাজি নহেন, তাহা হইলে নায়িকাপ্রধান ছবি রচনাই বরং বাতিল হইয়া যাইবে। ইহাও মনে রাখিতে হইবে, আজ অবধি (৮৯ বারের মধ্যে) শ্রেষ্ঠ পরিচালকের অস্কার কেবল এক জন মহিলা পাইয়াছেন। নায়িকাকে নিজ ফ্যান্টাসির বস্তু ভাবিয়া পুরুষ চির কাল আরাম পাইয়াছে, তাহাকে সাজাইয়া গুছাইয়া পুং-নেত্রভঙ্গির উপযোগী করিয়া উপস্থাপিত করিয়াছে, কিন্তু নারীকে সমগ্র চলচ্চিত্রটির স্রষ্টা হিসাবে স্বীকার করিতে তাহার অস্বস্তি রহিয়াছে। এই বৎসরে তাহাও ভাঙিবে কি?
যৎকিঞ্চিৎ
যে কোনও বাড়ি এ বার ধাঁ করে গেরুয়া রং হয়ে যেতে পারে। অবশ্য উত্তরপ্রদেশ হলে সম্ভাবনাটা বেশি। প্রিয় রঙের প্রতি পক্ষপাত নতুন নয়, এর আগেও হয়েছে: বাড়ি নীল-সাদা করলে কর ছাড়। তবে সেখানে গা-জোয়ারি ছিল না। এখন বলা হচ্ছে গেরুয়া নির্দিষ্ট দলের রং কেন হবে, তা সুখের রং, সূর্যোদয়ের রং। জাতীয় পতাকাতেও তো আছে। ঠিকই, এ বার তাজমহলকে না রাতারাতি গেরুয়ায় ছুপিয়ে দেওয়া হয়! তা হলে আর ‘জাতীয় সুখের সূর্যোদয়’-এর বাকি থাকে না!