আটলান্টার শহরতলি আলফারেটায় বদলি নিয়ে যখন ২০০০ সালের শুরুতে আসছি, তখন আমার কানাডার সহকর্মীরা হাসতে হাসতে বলেছিলেন, “এ বার তা হলে বাইবেল আর বন্দুকও কিনে ফেলো।” হাইওয়ে ৪০০-র ১১ নম্বর এগজ়িটে আমার টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানির অফিস। এক দিন আমার কৃষ্ণাঙ্গ বস বললেন, “আমরা কখনও এই এগজ়িটের উত্তরে যাই না।” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কেন? বললেন, “ওই ফোরসাইথ কাউন্টি প্রচণ্ড বর্ণবিদ্বেষী। ঐতিহাসিক ভাবে আমরা ওদের বিশ্বাস করতে পারি না।”
ফোরসাইথ কাউন্টির বাসিন্দারা এই সে দিন, ১৯৮৭ সালেও, দি ওপরা উইনফ্রে শো-র মতো জাতীয় টেলিভিশন অনুষ্ঠানে গিয়ে দাবি জানিয়েছিলেন, তাঁরা সেখানে কোনও কালো মানুষ চান না এবং এই বিশুদ্ধ সাদা এলাকার দাবিটা আমেরিকান হিসেবে তাঁদের ন্যায্য অধিকারের মধ্যেই পড়ে! ১৯১২ সালে সেখানকার আফ্রিকান-আমেরিকান অধিবাসীদের জোরপূর্বক উচ্ছেদ করা হয়। ১৯১০ সালের জনগণনায় ১০৯৮ জন কালো মানুষের নাম দেখা গেলেও পরবর্তী কালে তা শূন্যের কোঠায় পৌঁছোয়। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি আটলান্টা কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার আদায়ের সূতিকাগার হয়ে উঠলেও এই এলাকাগুলো মূলত সাদা এলাকা হিসেবেই টিকে থাকে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে প্রায় লাখখানেক আমেরিকান আদিবাসীকে দক্ষিণের যে সব এলাকা থেকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ করা হয়েছিল (ট্রেল অব টিয়ারস), তার মধ্যে জর্জিয়ার উত্তর-পশ্চিমের এই জায়গাগুলোও ছিল। ফোরসাইথ কাউন্টির মতো মফস্সল এবং গ্রামগুলোই মূলত এখন ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থক। বর্ণবিদ্বেষ এবং সাদা জাতীয়তাবাদের ভিত্তি আমেরিকায় গভীর। তবে গত কয়েক দশকে সাদা মধ্যবিত্ত শ্রেণির অর্থনৈতিক অবস্থার কথা উল্লেখ না করলে আলোচনাটা অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
গত শতকে বড় শিল্প এবং আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের বিকাশের ফলে এক বিশাল সচ্ছল সাদা মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে ওঠে, যাঁদের অনেকেই কৃষক, কারখানা কর্মী, ছোট ব্যবসায়ী। কিন্তু গত কয়েক দশকে বিশ্বায়ন, কর্পোরেট পুঁজি এবং উচ্চ-প্রযুক্তির বিকাশ ক্রমশ সেই জীবনব্যবস্থাকে নড়বড়ে করে দিতে শুরু করে। কর্পোরেশন এবং ধনীদের পৃষ্ঠপোষক নিয়ো-লিবারাল পলিসির বাস্তবায়নের সঙ্গে ভাল বেতনের চাকরিগুলো চিন, ভারত, ভিয়েতনাম বা বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে চলে যেতে শুরু করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ এমন বেড়ে যায় যে, উচ্চশিক্ষা মধ্যবিত্ত ছেলেমেয়েদের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায়, জীবনযাত্রার মান বাড়ে, বেতন বাড়ে না। ক্ষুদ্র এক অংশের হাতে সম্পদের পাহাড় গড়ে উঠলেও, আমেরিকার ভিত্তি সেই মধ্যবিত্ত শ্রেণি ক্রমশ সঙ্কুচিত হতে থাকে। ব্রুকিংস ইনস্টিটিউটের ২০১৬ সালের গবেষণা বলছে, বিশ্বায়ন, আউটসোর্সিং এবং অটোমেশন-এর কারণে ১৯৮০ সাল থেকে ৩৫ বছরে প্রায় ৭০ লক্ষ মানুষ শিল্প-কারখানার চাকরি হারিয়েছেন। ২০০৮ সালের চরম মন্দার জন্য দায়ী বড় কর্পোরেশনগুলোর কোনও সমস্যা না হলেও এবং ধনীরা দ্রুত বেরিয়ে আসতে পারলেও মধ্য ও নিম্নবিত্ত শ্রেণি তা পারেনি।
আবার বড় বড় কর্পোরেশন ও শহুরে শিক্ষিত অংশ, যাঁদের মধ্যে আবার হাজার হাজার অভিবাসীও আছেন, তাঁদের সম্পদ বেড়েই চলছে। ফলে বৈষম্য চরম আকার ধারণ করছে। শুধু তা-ই নয়, অভিবাসীদের মধ্যে জনসংখ্যা দ্রুত বাড়ার ফলে ২০৫০ সালের মধ্যে সাদারা হয়তো আমেরিকায় সংখ্যালঘু হয়ে যাবে। ফলে তাদের মধ্যে এক ব্যাপক নিরাপত্তাহীনতাও দেখা দিচ্ছে।
যেমন, আলফারেটা ঐতিহাসিক ভাবে সাদা অধ্যুষিত। এখানে এশিয়ান ২০%, কৃষ্ণাঙ্গ ১২%, হিস্প্যানিক ৮% এবং সাদা ৫৬%। লাগোয়া ফোরসাউথ কাউন্টিতেও গড়ে উঠেছে বহু এশীয়, হিস্প্যানিক পাড়া। ২০২০ সালের নভেম্বরের নির্বাচনে জর্জিয়ার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠ সাদা রক্ষণশীল স্টেটের, জো বাইডেনকে প্রেসিডেন্ট এবং দু’জন ডেমোক্র্যাটিক সেনেটর নির্বাচনের পিছনে কালোদের সঙ্গে এই অভিবাসীদেরও ভূমিকা ছিল।
৬ জানুয়ারি ক্যাপিটলে চরম ডানপন্থী এবং সাদা জাতীয়তাবাদীদের যে অভূতপূর্ব উন্মত্ততা দেখলাম, তা এক দিনে গড়ে ওঠেনি, শুধুমাত্র ট্রাম্পের কারণেও ঘটেনি। রাজনীতিবিদ, কর্পোরেশন, প্রতিষ্ঠিত মিডিয়া এবং রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতি চরম ঘৃণা এবং অবিশ্বাস বহু দিনের। ট্রাম্প জনমোহিনী স্বৈরশাসকের চিরাচরিত ছক মেনে বহু দিনের ক্ষোভ, জাত্যভিমান, নিরাপত্তাহীনতায় ঘৃতাহূতি দিয়ে ঘৃণাপূর্ণ সহিংসতাটা জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন।
বাইডেন হয়তো সাময়িক ভাবে ট্রাম্প এবং তাঁর সমর্থকদের উত্থান রোধ করেছেন। কিন্তু আমরা আজকে যে সঙ্কটকালে এসে দাঁড়িয়েছি, তাতে ক্ষমতার কাঠামো এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ছাড়া কি এই লিবারাল ডেমোক্র্যাসিকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে? প্রশ্নটা থেকেই যায়।