পরিবেশ বাঁচাতে বাকি দুনিয়াকে এক হতেই হবে

হিলারি ক্লিন্টনের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট হওয়ার যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েই ট্রাম্প জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টিকে উড়িয়ে দিয়েছিলেন কখনও স্রেফ ধোঁকা, কখনও বিজ্ঞানীর ছদ্মবেশে থাকা কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তি ও চিনাদের ষড়যন্ত্র বলে।

Advertisement

জয়ন্ত বসু

শেষ আপডেট: ১০ জুন ২০১৭ ১৩:২৫
Share:

শপথ: ট্রাম্প জলবায়ু চুক্তি থেকে সরে দাঁড়ানোর পরে প্রতিবাদী নাগরিকদের সমাবেশ। কনেটিকাট, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ৪ জুন, ২০১৭। ছবি: এএফপি

ডো নাল্ড ট্রাম্প রাজ্যপাটে বসার অনেক আগেই জানা গিয়েছিল, জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপারে তাঁর ঘোর সংশয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও কারও কারও মনে আশা ছিল, হোয়াইট হাউসে পা রাখলে ট্রাম্প সাহেব, ক্লাসের সবচেয়ে দুষ্টু ছেলের মনিটার হওয়ার মতো, খানিকটা সমঝে চলবেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে তাঁর কথায় কাজে তফাত নেই। ওবামা জমানার যে যে বিষয়গুলিকে তিনি একেবারে একশো আশি ডিগ্রি ঘুরিয়ে দিতে বদ্ধপরিকর, তার অন্যতম হল জলবায়ু পরিবর্তন রোধের উদ্যোগ।

Advertisement

হিলারি ক্লিন্টনের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট হওয়ার যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েই ট্রাম্প জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টিকে উড়িয়ে দিয়েছিলেন কখনও স্রেফ ধোঁকা, কখনও বিজ্ঞানীর ছদ্মবেশে থাকা কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তি ও চিনাদের ষড়যন্ত্র বলে। প্রচারে স্পষ্ট বলেছিলেন যে প্রেসিডেন্ট হলে ওবামার জলবায়ু সংক্রান্ত নীতি পাল্টে দেবেন, প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে আমেরিকার অংশগ্রহণ বাতিল করবেন ও উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলিকে জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কা সামলাতে একটি ডলারও দেবেন না। ক্ষমতায় আসার পরেও ট্রাম্প, সারা বিশ্ব কী বলছে তা নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথা না ঘামিয়ে, দেশের কয়লা ও শক্তি লবির কথা ভেবে একের পর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ও নিচ্ছেন। দেশের পরিবেশ সংস্থার মাথায় জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে চূড়ান্ত সংশয়বাদী বিজ্ঞানীকে বসানো থেকে শুরু করে, গাড়ির গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন সংক্রান্ত বিধি বা কয়লা উত্তোলনের বিধিনিষেধ শিথিল করা, সেনাবাহিনীকে দিয়ে ডাকোটা পাইপ লাইন বসানোর কাজকে ত্বরান্বিত করা, বারাক ওবামার দূষণহীন শক্তির পরিকল্পনা বাতিল করে দেওয়া ও সাম্প্রতিকতম সিদ্ধান্ত— প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসা। পৃথিবী জুড়ে প্রশ্ন, পরবর্তী ধাপ কি জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে রাষ্ট্রপুঞ্জের ব্যবস্থাপনার জন্য গঠিত কাঠামো (ইউনাইটেড নেশনস্ ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অব ক্লাইমেট চেঞ্জ) থেকেই আমরিকাকে সরিয়ে নেওয়া? তবে এ বিষয়ে সবাই একমত যে, আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাপনায় থাকুক বা না থাকুক, ট্রাম্পের আমেরিকা এ বিষয়ে কোনও সদর্থক ভূমিকা নেবে না।

এই ভাবনা থেকেই উঠে আসছে প্রশ্ন, জলবায়ু সংক্রান্ত আগামী দিনের আলোচনায় আদৌ কি আমেরিকাকে রাখার কোনও প্রয়োজন আছে? এতে হিতে বিপরীত হওয়া সম্ভাবনা নেই তো? মনে রাখতে হবে, পৃথিবীব্যাপী কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরণে আমেরিকা এখন চিনের ঠিক পরে, মাথাপিছু নিঃসরণের হিসেবে ইউনাইটেড আরব এমিরেটস-এর পরে পরেই, আর ঐতিহাসিক নিঃসরণের কথা ধরলে সবার ওপরে। এমন দেশকে বাদ দিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের সমাধান খোঁজা অনেকটা বর বাদ দিয়ে বিয়ের মতোই। পাশাপাশি এই ভয়ও আছে যে বরের সঙ্গে বরযাত্রীরাও (অর্থাৎ আমেরিকার কিছু বন্ধু দেশ) প্যারিস চুক্তি থেকে সরে যেতে পারে।

Advertisement

উল্টো যুক্তি হল— যে বর পালিয়ে যেতেই চায়, তাকে গোড়া থেকেই বাদ দেওয়া ভাল। সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট-এর চন্দ্রভূষণের মতো যে বিশেষজ্ঞরা বহু দিন ধরে জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আলোচনার ওপর নজর রাখছেন তাঁদের অধিকাংশের মত হল, আমেরিকাকে আগামী দিনের আলোচনায় শরিক করলে তাতে ভালর থেকে খারাপই বেশি হবে, কারণ না তারা নিজেরা কোনও ব্যবস্থা নেবে, না কোনও আর্থিক সাহায্য করবে, বরং পদে পদে নানা দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও বিতর্ক সৃষ্টি করে পুরো বিষয়টিকে পিছনে টানার চেষ্টা করবে, যখন কিনা পৃথিবীর প্রয়োজন জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিহত করতে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া ও তা কার্যকর করা। সুতরাং ট্রাম্পকে সরিয়ে রেখেই বাকি দুনিয়াকে জলবায়ু পরিবর্তন থামানোর লক্ষ্যে দ্রুত নামতে হবে, কেননা পৃথিবী উষ্ণ থেকে উষ্ণতর হচ্ছে, বরফ গলছে সমুদ্রের জল বাড়ছে, এখনই ব্যবস্থা নেওয়া শুরু না করলে শেষের সে দিন আর খুব দূরে নয়।

আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘অ্যাকশনএড’-এর জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত বিভাগের প্রধান হরজিৎ সিংহের কথায়, বিশ্ব ইতিমধ্যেই আমেরিকাকে বাদ দিয়ে জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিহত করার ক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপ করেছে। মারাকেশ-এ গত নভেম্বরে প্রায় দুশোটি রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা অঙ্গীকার করেন, আমেরিকা সঙ্গে থাকুক বা না থাকুক, জলবায়ু পরিবর্তন আটকাতে তাঁদের সর্বোচ্চ স্তরে রাজনৈতিক সদিচ্ছা আছে ও থাকবে। সম্প্রতি জি৭ দেশগুলির আলোচনাতেও আমেরিকাকে বাদ দিয়ে বাকি দেশেরা প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী পৃথিবীর কার্বন নিঃসরণ কমাতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞা জানিয়েছে। অনেকে আবার মনে করাচ্ছেন, ট্রাম্পকে বাদ দেওয়া মানে আমেরিকাকে বাদ দেওয়া নয়। এটা ঘটনা যে আমেরিকার পঁচাত্তরটি প্রদেশের মেয়ররা জানিয়েছেন, ট্রাম্প যা-ই বলুন না কেন, জলবায়ু পরিবর্তনকে তাঁরা আগের মতোই গুরুত্ব দেবেন ও এই বিষয়ে ব্যবস্থা নেবেন। বিভিন্ন আমেরিকান ব্যবসায়িক সংস্থাও বার বার জলবায়ু পরিবর্তন আটকাতে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন স্বীকার করছেন। ট্রাম্পের একশো দিন পূর্ণ হওয়া উপলক্ষে জলবায়ু পরিবর্তন প্রশ্নে তাঁর অবস্থানের সমালোচনায় বিদ্বজ্জনদের এক বড় মিছিলও হয়ে গেছে হোয়াইট হাউসের সামনে।

ট্রাম্পের সাম্প্রতিক পদক্ষেপে ভারতের সুবিধা না অসুবিধা? সরাসরি তেমন কোনও প্রভাব না পড়লেও আন্তর্জাতিক আলোচনায় চিনের সঙ্গে সঙ্গে ভারতের গুরুত্ব বাড়বে। এত দিন ইউরোপীয় দেশগুলির একাংশ কার্বন নিঃসরণের ক্ষেত্রে ভারতকে ক্রমাগত ভিলেন সাজাবার চেষ্টা করে গেছে, এমনকী প্যারিসেও সংবাদপত্রে এই মর্মে পাতাজোড়া বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে যে, ভারত আন্তর্জাতিক জলবায়ু চুক্তিকে আটকানোর চেষ্টা করছে। এখন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভারতকে ভিলেন না সাজিয়ে হিরো সাজালেই বাকি বিশ্বের মঙ্গল। এই পরিস্থিতিতে ভবিষ্যতের জলবায়ু আলোচনায় ভারতের দরদাম করার ক্ষমতা বাড়তে পারে। এ প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে, নরেন্দ্র মোদীর সাম্প্রতিক রাশিয়া, জামার্নি ও ফ্রান্স সফরে অন্যান্য বিষয়গুলির সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের কথাও প্রথম সারিতে উটে এসেছে। এবং এটাও উল্লেখ্য যে প্রধানমন্ত্রী মোদী জানিয়েছেন যে ভারত প্যারিস চুক্তি পালনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ও এ ক্ষেত্রে প্রথম বিশ্বের কাছে উপযুক্ত সাহায্য প্রত্যাশা করে।

অন্য দিকে, ভারত ক্ষতিগ্রস্ত হবে যদি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পূর্বসূরি ওবামার প্রতিশ্রুত সৌর বিদ্যুৎ ও অন্যান্য জলবায়ুবান্ধব প্রকল্পগুলিতে সহযোগিতা থেকে সরে আসেন। সেই আশঙ্কা প্রবল বলেই অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ মনে করেন। তবে সরকারি সাহায্য কমলেও বেসরকারি সাহায্যে অধিকাংশই চলবে বলে মনে করা হচ্ছে, কেননা পরিবেশ সংক্রান্ত বাজার ভারতে অনেকটাই জমে উঠেছে। এবং আমেরিকার বড় শিল্পসংস্থাগুলি এমন বড় বাজার হাতছাড়া করার যুক্তি মেনে নেবে না বলেই মনে করা হচ্ছে। এই যোগবিয়োগের খেলায় শেষ অবধি ভারত কী পায়, কী হারায়, সেটাই দেখার।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement