‘গম্ভীরাসম্রাট’: যোগেন্দ্রনাথ চৌধুরী, ছবি রৌদ্র মিত্র
মালদহ জেলার নামের সঙ্গে যেমন আম জড়িয়ে, ঠিক তেমনই সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে মালদহের সঙ্গে জড়িয়ে গম্ভীরার নাম। ধর্মীয় উৎসব থেকে এর সৃষ্টি হলেও বাস্তবে সমসাময়িক সমাজ, জীবন এবং রাষ্ট্রের বিষয় গম্ভীরা গান বা লোকনাটকের প্রতিপাদ্য। লোকসংস্কৃতির ইতিহাসে যে সমস্ত আঙ্গিক রয়েছে, তাদের মধ্যে গম্ভীরা লোকনাট্যের আঙ্গিক একেবারেই ব্যতিক্রমী। ব্যঙ্গাত্মক ভঙ্গিতে সামাজিক চালচিত্রের প্রতিচ্ছবি গম্ভীরার মাধ্যমে প্রতিফলিত হওয়ায় তা বরাবরই জীবন্ত এবং প্রাণবন্ত। শুধু তাই নয়, সমাজজীবনের উন্নয়ন ও কল্যাণের জন্য গম্ভীরা বিশেষ ভূমিকাও পালন করে আসছে স্মরণাতীত কাল ধরে। কিন্তু কালক্রমে নানা ঘাত-প্রতিঘাতে মালদহের ঐতিহ্যবাহী গম্ভীরা এখন কার্যত সঙ্কটের মুখে। বিশেষ করে এই করোনা-আবহে গম্ভীরার আসর কার্যত বন্ধ হয়ে যাওয়ায় রুটিরুজির প্রশ্নে বড় ধরনের সমস্যার মুখে গম্ভীরা শিল্পীরা।
প্রাচীন ও মধ্যযুগে ‘গৌড়’ এবং ‘বঙ্গ’ শব্দ দু’টি সমার্থক ছিল। এই গৌড় তথা বর্তমানের মালদহ অনেক যুগ অতিক্রম করে এসেছে। পাল সাম্রাজ্য, সেন সাম্রাজ্য, নবাবি আমল এবং ব্রিটিশ শাসন অতিক্রম করে মালদহ বা গৌড় প্রাচীন ঐতিহ্য গম্ভীরাকে নিয়ে সদর্পে মাথা উচু করে আছে। ধর্ম ও সংস্কৃতির নানা বিবর্তনের মধ্যে শৈব, বৈষ্ণব এবং তান্ত্রিক শক্তির পরস্পরার সহযোগ এই এলাকায় বরাবর লক্ষ করা গিয়েছে। গম্ভীরা পুজো ও গান সেই সংস্কৃতিতে তার প্রতিফলন ফেলেছে। বলতে গেলে, আবহমানকাল ধরে যে সমাজব্যবস্থা চলে আসছে এবং সমাজের অভ্যন্তরে যে পরিবর্তন ঘটছে, তার প্রতিফলন ঘটেছে গম্ভীরার মধ্যে। সমাজ, রাজনীতি এবং রাষ্ট্রনীতির মতো গুরুগম্ভীর বিষয়কে সহজ ভাবে গম্ভীরা শিল্পীরা মানুষের কাছে নিবেদন করে আসছেন। মালদহে শিক্ষার আলোকবর্তিকাকে ছড়িয়ে দেওয়ার অন্যতম পথিকৃৎ বিনয় সরকারের কথায়— ‘গম্ভীরা অমর, গম্ভীরাই জীবনের আসল বুনিয়াদ’।
গম্ভীরাকে মূলত পুজো বা উৎসবের বিষয় বলা চলে। এই পুজোর শেষ পর্বে অভিনয় থাকে। এই অভিনয় অংশটির পরিচয় গম্ভীরা লোকনাট্য রূপে। কথিত আছে, প্রায় হাজার বছরের পুরনো গম্ভীরা উৎসব এবং তার ধারাবাহিকতা মালদহ জেলার জীবনকে প্রভাবিত করে এসেছে। ‘গম্ভীরা’ শব্দের অর্থ বোঝাতে সাধারণত শিবের স্থান বোঝায়। পণ্ডিতেরা বিষয়টি নানা ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ অনুযায়ী, গম্ভীরায় রাত্রিবাসের জন্য চৈতন্যদেবকে আমন্ত্রণ করা হয়েছিল। প্রাচীন গৌড় অঞ্চলের দ্বিতীয় ধর্মপাল দেব ও গোবিন্দচন্দ্র দাসের আমলে চণ্ডীমণ্ডপের মতো এক রকম পূজাগৃহ বা প্রকোষ্ঠ দেখা যেত, তার নামও গম্ভীরা। এই গম্ভীরা পুজো বরাবর বছরের শেষ দিনে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। আবার এলাকা বিশেষে বছরের প্রথম দিকের মাসগুলিতেও এই পুজো হয়ে থাকে। সাধারণত উৎসব শুরু হয় চৈত্র সংক্রান্তিতে এবং শিব পুজোকে কেন্দ্র করেই গম্ভীরা পুজো বা উৎসব। এই গম্ভীরা পুজোর রয়েছে একাধিক পর্ব। প্রত্যেকটি পর্বে রয়েছে উৎসবের আঙ্গিক। শেষ পর্বে গম্ভীরা গান পরিবেশিত হয়। এই গানের মধ্য দিয়েই সমকালীন জীবনের ও সমাজের প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে। গম্ভীরা উৎসব মালদহ জেলার প্রধানত চার দিনের উৎসব। গম্ভীরা পুজোকে কেন্দ্র করে গম্ভীরা মণ্ডপ তৈরি করা হয়। প্রথম দিনের উৎসবের নাম ‘ঘর ভরা’। সে দিন শিব ঠাকুরের উদ্দেশে ঢাকঢোল বাজিয়ে নদী থেকে ঘটে জল নিয়ে সে সেই ঘট স্থাপন করা হয় মণ্ডপে। দ্বিতীয় দিনের উৎসব ‘ছোট তামাশা’। এই দিনে শিব ও পার্বতীর পুজো হয়। পুজোর অনুষ্ঠান রং, তামাশা, আনন্দ, রসিকতার মধ্যে কাটে। তৃতীয় দিনের উৎসব ‘বড় তামাশা’। সে দিন হয় মুখোশনৃত্য উৎসব। চামুণ্ডা, নরসিংহী, কালীর মুখোশ পড়ে ঢাকের তালে তালে নৃত্য হয়। মুখোশ পড়ে উদ্দাম নৃত্যের মধ্য দিয়ে গম্ভীরার বিশেষ রূপ প্রকাশ পায়। আর, চতুর্থ দিনের উৎসবের নাম ‘আহারা’। সে দিন বিকেলে সঙ বেরোয়। বিভিন্ন সাজে সেজে সঙ গ্রাম-শহর পরিক্রমা করে। এই সঙ আবার দুই ভাগে বিভক্ত। প্রথম রীতিতে গান গেয়ে অভিনয় করা হয়। নাটকীয় গুণ সব রকম ভাবে প্রকাশ পায় এখানে। এই রীতিটিই গম্ভীরা লোকনাট্য। গম্ভীরা গানের শুরুতে দেবাদিদেব শিবকে বন্দনা করার রেওয়াজ আছে। শিবরূপী অভিনেতাকে মঞ্চে নিয়ে এসে তাঁকে সমস্ত বিষয়ে জানানো হয়। সমাজের মঙ্গলের জন্য কী করণীয় বা কোনও সমস্যা থাকলে কী ভাবে তার সমাধান করা যেতে পারে, তার প্রতিকারের নিদান দেন শিব।
পরিবেশনা: সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গিয়েছে উপস্থাপনার ধরন
গম্ভীরা লোকনাট্যের উপস্থাপনের কৌশলেও একাধিক ভাগ রয়েছে। প্রথম ভাগ ‘বন্দনা’। এই অংশে মঞ্চে শিব আসেন। শিবকে উদ্দেশ্য করে নানা সমস্যার কথা তুলে ধরে দু’টি চরিত্র। শিব তার প্রতিকারের উপায় বাতলে দিয়ে প্রস্থান করেন। এর পর আসে ‘দ্বৈত’ চরিত্র। পুরুষ ও মহিলা দু’টি চরিত্র সংলাপ ও গানের মধ্য দিয়ে সমাজজীবন, রাজনীতি থেকে শুরু করে ঘটনাবহুল নানা বিষয় তুলে ধরেন। পরে ‘চার ইয়ারি’ হিসেবে চারজন অভিনেতা মঞ্চে আসেন। এর মধ্যে একজন উচিত বক্তা থাকেন। সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি হয়ে তিনি স্পষ্ট বক্তব্য গান ও কথার মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করেন। এই চার ইয়ারি বা বন্ধুর বাক্যালাপের মধ্য দিয়ে সামাজিক সমস্যা মেটানোর পথ বেরিয়ে আসে। এর পরের পর্ব ‘ব্যঙ্গ’। একটি চরিত্র ব্যঙ্গের মাধ্যমে জরুরি কিছু কথা বলে। আর শেষে ‘সালতামামি’ বা রিপোর্টিং। সারা বছরের নানা ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণই হচ্ছে এই সালতামামি। এখানে সারা বছরের কাজের নানা সমালোচনা হয়। শেষে একটি সমাধানের রাস্তা হার করে গম্ভীরা গান শেষ হয়। গম্ভীরা গান বা লোকনাট্যে বিশেষ ভূমিকা বহন করে তালবাদ্য। হারমোনিয়াম, তবলা, করতাল, ট্রাম্পেট প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার করা হয় গম্ভীরা পরিবেশনায়।
এই গম্ভীরা গান শুধু ধর্মীয় মোড়কে পরিবেশিত মনোরঞ্জনের উপাদান নয়, সাধারণ মানুষকে সচেতন করার জন্য প্রধান ভূমিকা পালন কর এই লোককৃষ্টি। এ দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে, গণজাগরণে গম্ভীরা শিল্পীদের বিশেষ অবদান আছে। যে সমস্ত প্রথিতযশা শিল্পীদের হাত ধরে গম্ভীরা স্বমহিমায় বিরাজমান ছিল, তাঁদের বেশির ভাগই আজ প্রয়াত। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ধনকৃষ্ণ অধিকারী, কৃষ্ণধনদাস গোস্বামী, মহম্মদ সুফি, গোপালচন্দ্র দাস, সতীশ্চন্দ্র গুপ্ত, গোলাম গুপ্ত, কিশোরীকান্ত চৌধুরী প্রমুখ। তবে, গম্ভীরা গানকে বিশেষ মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছিলেন যোগেন্দ্রনাথ চৌধুরী। যাঁকে ‘গম্ভীরাসম্রাট’ নামে আখ্যায়িত করা হয়। পুরাতন মালদহের ইটখোলা গ্রামে তিনি জন্মেছিলেন। পরবর্তী কালে ইংরেজবাজার শহরের কুতুবপুর বাবুপাড়ায় বসবাস করতেন। গম্ভীরায় কৌতুক সৃষ্টিকারী অভিনেতা ও গায়ক শিল্পী হিসেবে তাঁর স্থান ছিল অদ্বিতীয়। তাঁর ডাকনাম ছিল মটরা। একটা সময় এমন হয়েছিল যে, মালদহ তো বটেই, অবিভক্ত দিনাজপুর তথা গোটা বাংলায় তাঁর অভিনীত গম্ভীরা ‘মটরার গান’ হিসেবে অভিহিত হত। এ ছাড়া গোবিন্দলাল শেঠ, গোপীনাথ শেঠ, অনিল চৌধুরী, রামেশ্বর রায় পণ্ডিতদের মতো অসংখ্য শিল্পী গম্ভীরাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে গিয়েছেন মালদহ জেলায়।
গম্ভীরার ইতিহাস যত পুরনোই হোক না কেন, সমসাময়িক জীবনের প্রত্যেকটি ঘাত-প্রতিঘাতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গম্ভীরা আজ অনেকাংশে বদলে গিয়েছে। আধুনিকতার দিকে অনেকটাই এগিয়েছে এই লোকশিল্প। গম্ভীরা বাংলা প্রসেনিয়াম থিয়েটারের জগতকে প্রভাবিত করেছে। আবার সময়ের তালে আধুনিক যাত্রা ও নাটকের ভাবধারাও কখনও কখনও গম্ভীরা লোকনাট্যে প্রভাবিত হয়েছে। এই পরিবর্তন শুধু লোকনাট্যের ক্ষেত্রেই নয়, সমস্ত লোকসংস্কৃতির মধ্যেই এসে যায়। সেই সুূত্রে বিষয়ভাবনাতেও পরিবর্ততন ঘটেছে গম্ভীরার। স্মরণাতীত কাল থেকে গম্ভীরা মানুষের মন জয় করে আসছে। আশা করা যায়, নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের হাত ধরে গম্ভীরা এগিয়ে যাবে আপন গতিতে। কিন্তু অবশ্যই তার জন্য জরুরি এই লোকধারাকে বাঁচিয়ে রাখার প্রয়াস। এই শিল্প যদি হারিয়ে যায়, ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না।
অঙ্কন: রৌদ্র মিত্র