ফরাসি গণবিদ্রোহ বিপন্নতায় ঠেলে দিচ্ছে ফ্রান্সকে, ইউরোপকেও

‘ক্ষিপ্ত’ মানুষের আন্দোলন

আমাদের দেশের মতোই বিগত কয়েক সপ্তাহ যাবৎ ফ্রান্সে পেট্রল-ডিজ়েলের দাম বেড়ে চলেছে। তার একটা কারণ যেমন আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যারেলপ্রতি অশোধিত তেলের মূল্য বৃদ্ধি, অন্য কারণ তেল বিক্রয়ের ওপর সরকারি শুল্ক, বিশেষত পরিবেশ শুল্কের উপর্যুপরি চাপ।

Advertisement

তৃণাঞ্জন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০৬ ডিসেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share:

বিস্ফোরণ: ‘হলুদ জ্যাকেট থাকুক আর না থাকুক, আমরা সবাই একই কথা বলছি!’ বিদ্রোহী জনতা, লিল, উত্তর ফ্রান্স, ১ ডিসেম্বর। এএফপি

গত ১৭ নভেম্বরের শনিবার থেকে পয়লা ডিসেম্বর অবধি পর পর তিন শনিবার গোটা ফ্রান্স জুড়ে লক্ষাধিক মানুষ পথে নেমেছেন এক আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। তৃতীয় সপ্তাহে পা দেওয়া এই গণবিদ্রোহের জনসমর্থন ক্রমবর্ধমান, দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ার উপক্রম।

Advertisement

আমাদের দেশের মতোই বিগত কয়েক সপ্তাহ যাবৎ ফ্রান্সে পেট্রল-ডিজ়েলের দাম বেড়ে চলেছে। তার একটা কারণ যেমন আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যারেলপ্রতি অশোধিত তেলের মূল্য বৃদ্ধি, অন্য কারণ তেল বিক্রয়ের ওপর সরকারি শুল্ক, বিশেষত পরিবেশ শুল্কের উপর্যুপরি চাপ। এর আঁচ পোহাতে হচ্ছে প্রধানত বড় শহরের বাইরে বসবাসকারী, গ্রাম বা শহরতলির মানুষকে। এ সব জায়গায়, এমনিতেই গণ-পরিবহণ ব্যবস্থা অপ্রতুল, তার ওপর দৈনন্দিন কর্ম ও পরিষেবাস্থল দূরবর্তী। অতএব নিজস্ব যান ও জ্বালানির খরচ গগনচুম্বী।

এ ছাড়া, বিষফোড়ার মতো রয়েছে সাধারণ দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি। বিশেষত বাড়িভাড়া, গ্যাস, বিদ্যুৎ, তেলের মতো অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বাবদ জাতীয় ব্যয়, যা ১৯৫৯-এ ছিল সাড়ে তিন বিলিয়ন ইউরো, ২০১৮-য় তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪১০ বিলিয়ন ইউরো। পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছেছে, সাধারণ ফরাসিরা ঘটিবাটি হারানোর ভয়ে কণ্টকিত হয়ে পড়ছেন। অথচ ফরাসি প্রেসিডেন্ট বা তাঁর দল পরিচালিত সরকারের সাধারণ মানুষের এই শিরঃপীড়া নিয়ে কোনও হেলদোল নেই। জনগণের প্রশ্ন: এই সব চাপানো শুল্কের অর্থ তবে কি প্রেসিডেন্ট ভবনের কাপ-ডিশের জন্য ব্যয় হচ্ছে?

Advertisement

এমতাবস্থায় আগুনে ঘিয়ের মতো একটি ভিডিয়ো সোশ্যাল মিডিয়ায় এসে পড়ে। জাকলিন মোরো নামের এক জন ভিডিয়ো ব্লগার পরিবেশ শুল্কের দোহাই দিয়ে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির জন্য প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাকরঁকে রীতিমতো তুলোধোনা করে একটি ভিডিয়ো ছেড়েছেন অন্তর্জাল মাধ্যমে। সেটি ভাইরাল হতে শুরু করে। ফেসবুক টুইটারের মাধ্যমে মানুষ সঙ্ঘবদ্ধ হতে শুরু করেন। ক্ষিপ্ত হয়ে পথে নেমে পড়েন।

‘ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠো!’ ‘অ্যাঁদিনিয়ে-ভু!’ এই রচনার রচয়িতা কূটনীতিজ্ঞ ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জার্মান আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলনের সৈনিক স্তেফান এসেল (১৯১৭-২০১৩)। পাতা ত্রিশের ক্ষুদ্র পুস্তিকাটি ফ্রান্সে ২০১০ সালের ‘বেস্ট সেলার’। সেই থেকে ফ্রান্সে একটা শব্দবন্ধ চালু হয়েছে, ‘মুভমঁ দেজ্যাঁদিনিয়ে’, ‘ক্ষিপ্ত মানুষের আন্দোলন’। যে আন্দোলনের পিছনে কোনও ইউনিয়ন বা রাজনৈতিক দলের মদত নেই। যে আন্দোলনের মাথায় কোনও নেতা বা পলিটব্যুরো নেই। যে আন্দোলন একান্তই স্বতঃস্ফূর্ত, এলাকাভিত্তিক ছোট ছোট অ্যাকশন কমিটি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।

কিন্তু সহসা মানুষ এ ভাবে খেপে উঠছেন কেন? পিছনের দিকে তাকানো যাক। ২০০০ থেকে ২০০৭ অবধি ফ্রান্সে ৬৩% চাকরি কমেছে। উৎপাদনের ব্যয় কমাতে কলকারখানাগুলি পাততাড়ি গুটিয়ে চলে গিয়েছে ফ্রান্স ছেড়ে। কলকারখানার অভাবে শ্রমিক শ্রেণিই যেন আজ ফ্রান্সে অবলুপ্ত-প্রায় প্রজাতি। কোনও সরকারের পক্ষেই সম্ভব হয়নি বিশিল্পায়নের রক্তক্ষরণ থামানোর। ফ্রান্সের কৃষিক্ষেত্রে গড়ে দুই দিন অন্তর এক জন কৃষক আত্মহত্যা করছেন। শ্রম, বীজ, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি সমেত কৃষি বা পশুপালনের খরচ এতটাই বেলাগাম যে কৃষকের পেট ভরা দূরস্থান, ঋণভারে জর্জরিত অবস্থা। এ দিকে আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকার কৃষকদের সঙ্গে পাল্লা দিতে কৃষিপণ্যের মূল্যের ওপর মারতে হচ্ছে কোপ।

মধ্যবিত্ত জীবনের ওপরও নেমে এসেছে খাঁড়ার ঘা— বিশেষত ছোট শহর বা শহরতলির বাসিন্দা যাঁরা। মজার কথা হল ফ্রান্সে মধ্যবিত্তের সংজ্ঞায় অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষ করা গিয়েছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে দেখা হত এক দিকে ধনিক শ্রেণি ও অপর দিকে শ্রমিকদের মধ্যবর্তী স্তর হিসেবে। অর্থাৎ নির্ণয়ের মানদণ্ডটি ছিল অর্থনৈতিক। এখন শহরতলির মধ্যবিত্ত ধরা হয় তাঁদের, যাঁরা বসবাস করেন অভিবাসী-অধ্যুষিত পল্লির চৌহদ্দির বাইরে, যাঁরা প্রায় প্রত্যেকেই ছোটখাটো বাড়ির মালিক আর যাঁদের গায়ের রং প্রধানত সাদা। অর্থাৎ মানদণ্ডটি হয়ে দাঁড়িয়েছে অনেকটাই জাতিসত্তা-ভিত্তিক। এই সব শহরতলিতে গ্রাম থেকে এসে মানুষ ভিড় জমিয়েছিলেন চাকরির আশায়। ঊনবিংশ ও বিংশ শতকের শিল্পবিপ্লবের যুগে, বিশেষত মহাযুদ্ধ-পরবর্তী শিল্প উৎপাদনের তিন স্বর্ণদশক জুড়ে এগুলিই হয়ে উঠেছিল সচ্ছল শিল্প-উৎপাদনকেন্দ্র। ১৯৯০ দশকের থেকে উপেক্ষিত হতে হতে তাঁরাই ক্রমশ প্রান্তিক হয়ে পড়লেন। ফ্রান্সের মাটিতে ফাটল ধরল, এক দেশের মধ্যে যেন জন্ম নিল আলাদা দু’টি দেশ; জনসংখ্যার ৪০% নিয়ে বিশ্বায়নের প্রসাদ-পুষ্ট মহানগর-ভিত্তিক কেন্দ্রীয় ফ্রান্স এবং ৬০% নিয়ে গ্রাম-শহরতলির প্রান্তিক ফ্রান্স।

সংখ্যাগুরু প্রান্তিক ফ্রান্স যেমন নিজেকে গুটিয়ে ঢুকে পড়ে জাতিসত্তার খোলসের মধ্যে, তেমনই সংখ্যালঘু ও বিশ্বায়িত এই ফ্রান্স নিজেকে আরও প্রসারিত করে, প্রেসিডেন্ট মাকরঁর সঙ্গে গলা মিলিয়ে তুলে ধরতে চায় সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদকে। নিন্দুকেরা অবশ্য বলেন, বহুত্ববাদের আড়ালে মাকরঁ আসলে মান্যতা দিচ্ছেন ফ্রান্সের ওপর ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের খবরদারিকে। তার কাছে মাথা নুইয়ে ফ্রান্সের রাজনৈতিক নেতারা পুর পরিষেবার সঙ্কোচ ঘটান, জিনিসপত্র, পরিষেবা বা সম্পত্তির ওপর অন্যায্য কর চাপিয়ে দেন, সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থার অবলুপ্তির পরিকল্পনা করেন, শ্রমিক-কর্মচারীর অধিকার খর্ব করেন।

অন্য দিকে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভাবে ক্ষয়িষ্ণু ফরাসির আশাভরসার স্থল হয়ে উঠছেন ‘ফ্রোঁ নাসিয়োনাল’ বা জাতীয় ফ্রন্টের মতো দক্ষিণপন্থী উগ্র জাতীয়তাবাদী দল ও নেত্রী মারিন ল্য পেন। শ্রমিক, কৃষক, মধ্যবিত্তের বৃহদংশ নিয়ে যেন নিম্নগামী লিফটের সওয়ারি। প্রান্তিক ফ্রান্সের গায়ের রং যে হেতু প্রধানত সাদা— হলুদ জ্যাকেট আন্দোলনের মধ্যে কিছু বর্ণবিদ্বেষী ঝোঁক আছেই। এই শ্বেতাঙ্গ ‘প্রান্তিক’ ফ্রান্সকে বোঝানো গিয়েছে, যত নষ্টের গোড়া ওই কালো ও বাদামি অভিবাসীরা।

এই ‘প্রান্তিক’ ফ্রান্স আপাতত ফুঁসে উঠছে। মিশরের ‘আরব বসন্ত’, স্পেনের ‘পদেমস’ থেকে মার্কিন দেশের ‘অকুপাই’ আন্দোলন বা ফ্রান্সের ‘লা ন্যুই দ্যবু’ হয়ে আজকের ‘হলুদ জ্যাকেট’ বা ‘ক্ষিপ্ত মানুষের আন্দোলন’ দ্বিতীয় সহস্রাব্দের নানা দেশে অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছে। প্রথাগত রাজনৈতিক পরিসরে সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর যখনই অবহেলিত হচ্ছে, মানুষ প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের বয়ান পরিত্যাগ করে আইন অমান্য বা সরাসরি অংশগ্রহণের পথ বেছে নিচ্ছেন। তবে কি আমরা এই আন্দোলনের উৎস খুঁজতে পৌঁছে যাব প্যারিসের ১৯৬৮ সালের ছাত্রবিদ্রোহে? যেখানে সাবেকি রাজনীতি ও প্রাতিষ্ঠানিক সংগঠন ছেড়ে দিয়ে স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের নতুন ধারা তৈরি হয়েছিল? অনেকে এই আন্দোলনকে ১৯৫০-এর দশকের পুজাদিস্ত আন্দোলনের আলোকে বুঝতে চাইছেন। শপিং মল, সুপারমার্কেটের মালিক বড় পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে ছোট দোকানদার ও কারিগর শ্রেণির বিদ্রোহের প্রেক্ষিতে।

প্রেক্ষিত যা-ই হোক, আপাতত সরকারকে মাথা নোয়াতেই হবে গণরোষের কাছে। প্রায় রাজতন্ত্রের সমার্থক হয়ে ওঠা ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টতন্ত্র আজ গভীর সঙ্কটের মুখে দাঁড়িয়ে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement