লড়াইয়ের শুরু বঙ্গভঙ্গের সময়ে

মানভূমের বাংলাভাষী মানুষজন ভাষাভিত্তিক সীমানা, সাংস্কৃতিক রেখা ও ভৌগোলিক অবস্থানে বাংলা তথা পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার যে লড়াই শুরু করেছিলেন, তারই ফলশ্রুতিতে পুরুলিয়া পশ্চিমবঙ্গের অংশীভূত হয়। সেই ইতিহাস ফিরে দেখলেন বিভাসকান্তি মণ্ডল। আজ প্রথম পর্বমানভূমের বাংলাভাষী মানুষজন ভাষাভিত্তিক সীমানা, সাংস্কৃতিক রেখা ও ভৌগোলিক অবস্থানে বাংলা তথা পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার যে লড়াই শুরু করেছিলেন, তারই ফলশ্রুতিতে ১৯৫৬-এর ১ নভেম্বর পুরুলিয়া পশ্চিমবঙ্গের অংশীভূত হয়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০১ নভেম্বর ২০১৯ ০২:৩২
Share:

ইতিহাস: বঙ্গভুক্তির দাবিতে পুঞ্চার পাকবিড়রায় জমায়েত (২৪ এপ্রিল, ১৯৫৫)। ফাইল চিত্র

বছর পনেরোর এক অন্ধ কিশোর গাইছিল তার শেকড়-সঙ্গীত, টুসু গান। গায়ে তার মানভূমের পাথর-মাটির গন্ধ। গাইতে গাইতে সে চলেছে রঘুনাথপুরের দিকে। আচমকাই তার পথ আগলে দাঁড়ায় প্রশাসক। আদেশ, এ ভাষা বলা চলবে না। বিহার প্রদেশের ভাষা না বলার অপরাধে কারারুদ্ধ হয় সে। সে দিনের সেই কিশোরের নাম বাবুলাল মাহাতো। দিনটা ছিল ৪ মার্চ, ১৯৫৪।

Advertisement

মানভূমের বাংলাভাষী মানুষজন ভাষাভিত্তিক সীমানা, সাংস্কৃতিক রেখা ও ভৌগোলিক অবস্থানে বাংলা তথা পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার যে লড়াই শুরু করেছিলেন, তারই ফলশ্রুতিতে ১৯৫৬-এর ১ নভেম্বর পুরুলিয়া পশ্চিমবঙ্গের অংশীভূত হয়। ইতিহাস বলে, বাবুলাল, অরুণ চন্দ্র, ভজহরিদের পূর্বপুরুষদের লড়াইটা যদিও শুরু হয়েছিল বঙ্গভঙ্গের সময় থেকেই। পূর্ববঙ্গ ও অসম নিয়ে পৃথক প্রদেশ এবং বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা নিয়ে বাংলা প্রদেশ তৈরির যে চেষ্টা লর্ড কার্জন ১৯০৫-এ করেছিলেন, তাতে প্রকারান্তরে বিহারবাসীদের সঙ্গে বাংলার লড়াইয়ের আবহ তৈরি হয়। পরে, ১৯১১-তে বাংলা থেকে বিহারকে বিচ্ছিন্ন করার কথাও বলা হয়। বঙ্গভঙ্গ রদের পরে দিল্লিতে রাজধানী সরে যাওয়ার সঙ্গে বিহার, উড়িষ্যা ও ছোটনাগপুরের অঞ্চলকে নিয়ে পৃথক প্রদেশ তৈরি হয়, যার মধ্যে আশ্চর্যজনক ভাবে বাংলাভাষী মানভূমের বিস্তীর্ণ অংশও ছিল।

১ এপ্রিল, ১৯১২ সালে মানভূম জেলা সরকারি সিলমোহর-সহ বিহার প্রদেশে যুক্ত হয়। তখন থেকেই বলা চলে মানভূমের বাংলাভাষীদের ভাষার জন্য লড়াইয়ের সূচনা। ওই সময়ে মানভূম ও ধলভূম অঞ্চলকে ভাষার কারণে বাংলার সঙ্গে যুক্ত করার জন্য বিহারের যে কয়েকজন নেতা সওয়াল করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে মহম্মদ ফকরুদ্দিন, পরমেশ্বরলাল, নন্দকিশোরলাল, দীপনারায়ণ সিংহ, সচ্চিদানন্দ সিংহ অন্যতম। যদিও ভাষাভিত্তিক সেই অন্তর্ভুক্তির চেষ্টা সফল হয়নি।

Advertisement

এর পরে বহু মানুষ নানা ভাবে আন্দোলন শুরু করেন। আইনজীবী শরৎচন্দ্র সেন, রজনীকান্ত সরকার-সহ অনেক শিক্ষিত মানুষজন, জমিদার, ব্যবসায়ী, কয়লাখনির মালিকেরাও তাতে যোগ দেন। তবে কয়েক হাজার বর্গমাইল এলাকার বাংলাভাষী মানুষের এই আবেগ তৎকালীন বাংলার মানুষজনকে সে ভাবে নাড়া দিতে পারেনি। তাঁরা সে সময়ে বঙ্গভঙ্গ রদের আনন্দে মশগুল।

তবে তুষের আগুনের মতো জ্বলতে থাকে ভাষার জন্য লড়াই। বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চার আরও বিস্তৃত ক্ষেত্র গড়ে ওঠে। স্বাধীনতা সংগ্রামেও বাংলার নেতৃত্বাধীন ছিলেন ভাষা আন্দোলনের কর্মী ভজহরি মাহাতো, কৃষ্ণপদ চৌধুরী, জগবন্ধু ভট্টাচার্য, চিত্তভূষণ দাশগুপ্ত, ভীম মাহাতো প্রমুখ। নিবারণচন্দ্র দাশগুপ্ত, অতুলচন্দ্র ঘোষদের নেতৃত্বে সংগঠিত হয়েছিল বিয়াল্লিশের বিপ্লব। এরও প্রেক্ষাপটে রয়েছে ভাষা। ১৯৩১-এর জনগণনায় ১৮১০৮৯০ জনের মধ্যে ১২২২৬৮৯ জনই বাংলাভাষী। ১৯৪১-এর গণনায় ২০৩২১৪৬ জনের মধ্যে ১৩৫৭২৮৪ জন বাংলাভাষী ছিলেন। বাকিদের মধ্যে সানতালি, হিন্দি আর কিছু আদিবাসী ভাষাভাষী মানুষ ছিলেন।

এই হিসেব বিহার প্রদেশের নেতাদের মাথাব্যথার কারণ ছিল। বিশেষত ১৯৩৬ সালে উড়িষ্যা পৃথক রাজ্য হলে বিহার প্রদেশের কংগ্রেস নেতাদের বড় অংশ মনে করতে থাকেন যে, মানভূমও ভাষার কারণে বিহার থেকে আলাদা হয়ে যাবে। এতে ধানবাদ সমেত বিস্তীর্ণ খনি ও শিল্পাঞ্চল হাতছাড়া হবে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ড. রাজেন্দ্রপ্রসাদের সভাপতিত্বে ‘মানভূম বিহারী সমিতি’ গঠিত হয়। হিন্দি ভাষা প্রচার ও প্রসারের লক্ষ্যে স্কুল তৈরির কাজও হাওয়া পায়।

ফলশ্রুতিতে, বাংলা ভাষা প্রচার ও প্রসার এবং স্কুল তৈরির জন্য তৈরি হয় ‘বাঙালী সমিতি’ও। প্রফুল্লরঞ্জন দাসের নেতৃত্বে বাংলাভাষীদের যে সংগঠন গড়ে ওঠে, তার মুখপত্র হিসেবে ‘মানভূম সমিতি’ পত্রিকার সূচনা হয় ১৯৩৫ সালে। পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন অন্নদাপ্রসাদ চক্রবর্তী। পরে তিনি ‘সংগঠন’ নামে আরও একটি পত্রিকা চালু করেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের পাশাপাশি চলতে থাকে ভাষার দ্বৈরথ।

১৯৩৭ সালে বিহারের কংগ্রেস মন্ত্রিসভা ‘ডেসিমাইল সার্টিফিকেট’ প্রথার মাধ্যমে বাংলাভাষীদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করলে ভাষা আন্দোলন আরও জোরাল হয়। ১৯৩৯-এ অবশ্য কংগ্রেস মন্ত্রিসভা ভেঙে যায়। অন্য দিকে, সতীশচন্দ্র সিংহ, নীলকণ্ঠ চট্টোপাধ্যায়, সুরেশচন্দ্র সরকার প্রমুখ ব্যক্তিরা রাঁচী, সিংভূম, পালামৌ, হাজারিবাগ ও মানভূম নিয়ে ‘ছোটনাগপুর’ রাজ্য তৈরির প্রয়াস করেন। এ ভাবেই চলতে থাকে টানাপড়েন। ভাষা আন্দোলন তখনকার মতো ভাষার জন্য লড়াই রূপে থেকে গেলেও স্বাধীনতার পরে তা জোরদার মাতৃভাষা আন্দোলনের রূপ নেয়।

১৯৪৮ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের জয়পুর অধিবেশনে ভাষানীতির উপরে আলোচনা হলেও মানভূমের ক্ষেত্রে তা কার্যকর হয়নি। কারণ, স্বাধীনতার প্রাক্কালে ভারত বিভাজনের সময়ে বিহার প্রদেশের বাংলাভাষী অঞ্চলকে পশ্চিমবঙ্গে আনার দাবিকে জাতীয় নেতারা ‘সেপারেশন মুভমেন্ট’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। স্বাধীনতার চার দিনের মাথায় জামসেদপুরে ‘বিহার বাঙালী সমিতি’র বাৎসরিক সভা হয়। সেখানে উদ্বোধনী ভাষণে নগেন্দ্রনাথ রক্ষিত ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন বাংলার বাঙালি জাতিকে তার গৌরবময় ঐতিহ্য নিয়ে বেঁচে থাকার লক্ষ্যে পশ্চিমবঙ্গকে শক্তিশালী হিসেবে গড়ে তুলতে সিংভূম, মানভূম, সাঁওতাল পরগনা ও ভাগলপুরের বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল ও পূর্ণিয়া জেলাকে বাংলার অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানান। ওই সভায় প্রমথনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ-সহ বহু ভাষাকর্মী বিহারীদের হাতে আক্রান্ত হন।

এর সঙ্গে শুরু হয় সরকারি দমন-পীড়নও। হিন্দি শিক্ষা না দিলে স্কুলের অনুদান বন্ধের নোটিস জারি হয়। আদিবাসী স্কুলগুলিকে হিন্দি স্কুলে পরিণত করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। ১৯৪৮-এ এমন ৩০০টি স্কুল পরিবর্তিত হয়, ২৩টি স্কুলের অনুমোদন বাতিল হয়। বাংলা মাধ্যমে পড়ালে শিক্ষকদের শাস্তির বিধান দেওয়া হয়। বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলনের কারণে হেমচন্দ্র মাহাতোর বিরুদ্ধে ১০৭ ধারায় মামলা রুজু করে পুলিশ।

লেখক কাশীপুর মাইকেল মধুসূদন মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement