প্রতীক্ষা: কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে খরা-ত্রাণের দাবিতে আন্দোলনরত কৃষক। ৯ জুন, ২০১৭। চেন্নাই। ছবি: রয়টার্স
পুলিশের গুলিতে চাষির মৃত্যু। ধাক্কা লাগবেই বুকে। তেভাগা থেকে নন্দীগ্রাম দপদপ করে উঠবেই মাথায়। মধ্যপ্রদেশে ছয় চাষির মৃত্যুও তাই দেশ জুড়ে ক্ষোভের ঝড় তুলেছে। ফেসবুকে পোস্ট: ‘দেশপ্রেমিক বুলেট চেনে ছয় কৃষকের লাশ/ঋণ মকুবের দাবির জবাব রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস।’
কেবল তো গুলি নয়। দিল্লির যন্তরমন্তরে নরকরোটি নিয়ে বসলেন তামিলনাড়ুর চাষিরা। ওগুলো নাকি আত্মঘাতী চাষিদের। মহারাষ্ট্রে সব্জি ঢেলে রাস্তা অবরোধ চলছে। রাজ্য থেকে রাজ্যে ছড়াচ্ছে দাবি, কৃষিঋণ মকুব করতে হবে। দেখে মনে হয়, সত্যিই তো, কেন হবে না ঋণ মকুব? যে সরকার বড় বড় কর্পোরেট সংস্থার এক লক্ষ কোটি টাকারও বেশি অনাদায়ী ঋণ মাফ করতে পারে, সে কি চাষিকে বাঁচাতে কয়েক হাজার কোটি টাকার ক্ষতি স্বীকার করতে পারে না?
পারে বইকী। উত্তরপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্র, তিনটে রাজ্যে ঋণ মকুব তো হয়েই গিয়েছে, মধ্যপ্রদেশেও হব হব করছে। কিন্তু ...
এই ‘কিন্তু’-র ছায়াটা বড় হতে হতে প্রতিবাদের চড়া রঙের দৃশ্যগুলো ঢেকে দিচ্ছে মিশকালো আশঙ্কায়। চাষিরা যে দাবি তুলছেন, সেগুলো মেনে নিলে সত্যিই চাষের ভাল, চাষির ভাল হবে কি?
ধরা যাক কৃষি ঋণ মকুবের দাবিটাই। ভোটের লোভে নানা রাজ্যের সরকার ঋণ মকুব করে, কেন্দ্রও দু’বার করেছে (১৯৯০, ২০০৮)। প্রতিবার দেখা গিয়েছে, তাতে ক্ষতিই হয়েছে চাষের। মূল্যস্ফীতি হওয়ায় জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, ব্যাঙ্ক থেকে ফের ঋণ পেতে হয়রান হয়েছেন চাষি। কম সুদে, সহজ শর্তে ঋণ না পেয়ে মহাজনের চড়া সুদে ধার নিতে বাধ্য হয়েছেন ছোট চাষি। টাকা নেওয়া আর ফেরত দেওয়ার অভ্যাসটাও নষ্ট হয়েছে। ভোটের বছর কাছে এলেই চাষিরা টাকা ফেরত না দিয়ে ঋণ মকুবের ঘোষণার অপেক্ষা করেন, দেখা গিয়েছে সমীক্ষাতে। ঋণ মকুব যেন গরু মেরে জুতো দান। ব্যাঙ্কের, রাজকোষের বিপুল ক্ষতি করে সামান্য, সাময়িক স্বস্তি দেওয়া চাষিকে।
কিন্তু কোন চাষিকে? কৃষিঋণে ছোট চাষি কোণঠাসা। তাঁরা পঁচাশি শতাংশ জোতের মালিক, চুয়াল্লিশ শতাংশ জমি চাষ করেন, কিন্তু কৃষিঋণের মাত্র পাঁচ শতাংশ পান, বলছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। নাবার্ড-ও স্বীকার করে, ছোট চাষিরা বেশি ঋণ নেন মহাজনের থেকে। সরকার ঋণ মকুব করলে তাঁদের লাভ সামান্যই। লাভ বড় চাষিদের, ব্যাঙ্কের কাছে যাঁদের ঋণের পরিমাণ কয়েক কোটি টাকা। কারণ কৃষি ঋণ যখন মকুব করা হয়, তখন শুধু ছোট চাষিদের মধ্যে তাকে আটকানো যায় না। তামিলনাড়ুতে বড় চাষিরা হাই কোর্ট থেকে রায় আদায় করেছেন, তাঁদেরও ঋণ মকুব করতে হবে। চার লক্ষ বড় চাষির জন্য রাজ্য সরকার দেবে প্রায় দু’হাজার কোটি টাকা। মনমোহন সরকার যখন কৃষিঋণ মকুব করে, তখনও বাদ পড়েন প্রচুর ছোট চাষি, ঢুকেছিলেন বড় চাষিরা, বলছে কেন্দ্রীয় অডিট সংস্থার রিপোর্ট।
চাষের উপকরণের দাম দ্রুত বাড়ছে, ফসলের দাম সে হারে বাড়ছে না। তাই চাষির দাবি, পাম্প চালাতে ডিজেল, বিদ্যুতে ভর্তুকি চাই। সার-কীটনাশকে ভর্তুকি বাড়াতে হবে। চাপের মুখে রাষ্ট্র তা-ই করছে। সত্তরের দশকে সারে ভর্তুকি দেওয়া হত ৬০ কোটি টাকা, এখন দেওয়া হয় সত্তর হাজার কোটি টাকা। তাতে সারের ব্যবহার বেড়েছে, ফসল বেড়েছে, কিন্তু মাটি নষ্ট হয়েছে। ভারতে আটত্রিশ শতাংশ জমির মাটির মান মন্দ (ডিগ্রেডেড)। চাষিরাও তা বুঝছেন, কিন্তু সস্তার সারের উপর তাঁরা সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। দাম বাড়ার সম্ভাবনা দেখা দিলেই আন্দোলন করেন তাঁরা। জলের অপচয়েও ভারতের চাষি সেরা। সরকারি সেচ ব্যবস্থা বাড়ছে, পাম্প সেটে ভর্তুকি, বিদ্যুৎ সংযোগে ভর্তুকি মিলছে। নামছে জলের স্তর। দক্ষিণ ভারতের যে সব রাজ্যে এখন প্রবল খরা, সেখানে মাটির তলার জলের অতিরিক্ত ব্যবহার নিয়ে আগেই সতর্ক করেছিলেন কেন্দ্রীয় ভূগর্ভস্থ জল পরিষদের বিজ্ঞানীরা।
পশ্চিমবঙ্গের এক কৃষি আধিকারিকের অভিজ্ঞতা, যখনই শুকনো এলাকায় সেচের উন্নতি হয়, তখনই ডাল, তিল, সর্ষের মতো কম জলের চাষ ছেড়ে ধান চাষ শুরু করেন চাষিরা। দাম কমার সঙ্গে ব্যবহার বাড়ার যোগটা বোঝা যায়। কিন্তু আরও সার, আরও জল, আরও জল-পিপাসু ফসলের চাষ কি চাষির বিপন্নতা কমাবে? না কি, বিপুল ভর্তুকি আরও বড় সংকট তৈরি করছে?
ফসলের সহায়ক মূল্য বাড়াতে হবে, আরও বেশি ফসল কিনতে হবে সরকারকে, সেই দাবি নিয়েও একই সমস্যা। এক বিশেষজ্ঞের মতে, চাষিদের দশ শতাংশও সরকারকে ফসল বিক্রি করতে পারে না। সহায়ক মূল্য বাড়ালে নব্বই শতাংশের কী লাভ? অথচ ভারত এখন চাল আর গমের সহায়ক মূল্য দিতে যা খরচ করে, তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাইতে বেশি। ছোট চাষিরা নিজেরা বাজার ধরতে পারেন না, ফসল বিক্রি করেন ফড়ে, আড়তদারকে। সহায়ক মূল্যের গুড় তারাই খেয়ে যায়। শহরবাসী খেয়াল করেন না, আড়তদার, ব্যবসায়ীরও জমি রয়েছে, তাই পরিচয় ‘চাষি।’ যাঁরা রাস্তা অবরোধ করছেন, গাড়ি ভাঙচুর করছেন, রেল লাইন উপড়ে ফেলছেন, তাঁদের মধ্যে এঁরাও আছেন। আছেন কৃষিবিজ্ঞানে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট বেকার যুবকেরা। আমাদের চোখে সবাই ‘চাষি।’ কেমন চাষি, সে প্রশ্নটা করতে আমরা ভুলে যাই। কিন্তু নীতির জন্য সেটাই সব চাইতে জরুরি প্রশ্ন।
কী নীতি চাইছেন প্রতিবাদী চাষিরা? উৎপাদন-বিপণন দুটোতেই চাষির ঝুঁকি কমাতে হবে সরকারকে। সার, জল, কীটনাশক সস্তা তো করবেই, একশো দিনের কাজের শ্রমিককেও খেতের কাজে লাগাতে দেবে। ফসলের দাম না পেলে সরকারই কিনবে, উৎপাদনের খরচের দেড়গুণ দাম দিয়ে। কেন মুক্ত বাজারে ঠোক্কর খাবে চাষি? সরকার নিয়ন্ত্রণ করলে ক্ষতি কী?
ক্ষতি যে কী, তা-ই তো এবার টের পাওয়া গেল। পর পর দু’বছর খরার জন্য ডালের চাষ মার খেয়েছিল মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশে। কেন্দ্র ডালের সহায়ক মূল্য কুইন্টালে চারশো টাকার বেশি বাড়িয়ে দিল, বছরে এক লক্ষ টন ডাল আমদানির চুক্তি করল, ডাল মজুতের ঊর্ধ্বসীমা বেঁধে দেওয়া হল, রফতানি নিষিদ্ধ হল। এক কথায়, যত রকম ভাবে সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে ডালের বাজার, সবই করল। এ বছর ডালের বাম্পার উৎপাদন হয়েছে, দাম তলানিতে। অমনি রব উঠেছে, কেন রফতানি বন্ধ? কেন বেশি মজুত করা যাবে না? পশ্চিমবঙ্গে আলু নিয়ে এমনই হয়েছিল। যে সরকার অন্য রাজ্যে আলু যাওয়া আটকেছিল, সে-ই ফের ভর্তুকি দিয়েছিল রেলভাড়ায়। মানে চাষির দাবি মানলে ঢেঁকিতে চড়তে হবে সরকারকে। এ বছর নিয়ন্ত্রণ, ও বছর মুক্ত বাজার।
চাষের দীর্ঘমেয়াদি নীতি কেমন হওয়া উচিত, কেমন করে পরিবেশ, স্বাস্থ্য, পুষ্টির সুরক্ষা করেও চাষির রোজগার বাড়ানো যায়, তার অনেক প্রস্তাব উঠে এসেছে। ভাল রাস্তা, উন্নত পরিবহণ, ফসল সংরক্ষণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা, কোন বাজারে ফসলের কত দাম চাষিকে তার তথ্য সরবরাহ, জৈব চাষে উৎসাহ, ফসলে বৈচিত্র, কৃষিতে বেসরকারি লগ্নি, সেই সঙ্গে জমির মালিকানা-চাষের অধিকার-ফসল বিপণন সংক্রান্ত আইনের সংস্কার।
কিন্তু চাষিদের স্লোগানে এ সব কোনও কথা নেই। তার একটাই চিৎকৃত সুর, আমার ক্ষতি তুমি বইবে না কেন? রাজনীতির কাছে, নাগরিক সমাজের কাছে আজকের কৃষক আন্দোলন তাই একটা বড় চ্যালেঞ্জ। চাষির প্রতি সহানুভূতি মানেই তার দাবির সমর্থন, আর সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভের উদ্গিরণ, ও সব বাঁধা ফর্মুলা আর কাজ করবে না। কথা বলতে চাইলে ভাবতে হবে। চাষির স্বার্থেই।