গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ‘খামার-ভিত্তিক কাজে প্রাপ্যতার চলমান হ্রাসের ফলে নারীরা তাদের পরিবারের অভ্যন্তরের কর্মকাণ্ডে মনোযোগ দিচ্ছে।’ তাই গ্রামীণ শ্রম-বাজারে নারীদের এবং তাদের পরিবারের জন্য গ্রহণযোগ্য ও আকর্ষণীয় চাকরির প্রয়োজন। আবার শহুরে এলাকায় জরুরি কর্মক্ষেত্রে উপযুক্ত নিরাপত্তা, পদোন্নতি ও বেতন বৃদ্ধি।
অসম প্রতিযোগিতায় কাজ না পাওয়ার উদাহরণ অনেক। মায়রা স্ট্রোবার তাঁর বই ‘শেয়ারিং দ্য ওয়ার্ক’-এ এটা স্পষ্ট দেখিয়েছেন। শ্রমের বাজারে প্রায় সমান বেতনে কিছু ক্ষেত্রে ছেলে ও মেয়ে নিয়োগ হয়। কিন্তু পারিশ্রমিকের ফারাক আসে ধীরে ধীরে। ছেলেদের এক রকম ‘প্রোমোট’ করা হয়। মেয়েরা পারিবারিক দায়িত্ব পালনের কারণে কাজের বাইরে চলে আসে। তাঁদের ‘মামি পেনাল্টি’ (মা হওয়ার শাস্তি ) পেতে হয় কর্মজীবনে। ওই বইয়ে স্পষ্ট বলা আছে, বাচ্চা-সহ মহিলার উপার্জন কম। বাচ্চা নেই এমন বা ‘সিঙ্গল ওম্যান’ অনেক ক্ষেত্রেই পুরুষদের সমান উপার্জন করতে সক্ষম। সারুমাথি জয়ারামনের ‘বিহাইন্ড দ্য কিচেন ডোর’ বইয়ে পেশাদার সংস্থায় পরিবর্তন ও মেয়েদের অংশগ্রহণের বিষয়টি অন্য ভাবে দেখিয়েছেন। মেয়েদের সব রকম পেশায় অংশগ্রহণ করানোর জন্য সমাজের সেই নৈতিক সাহসের প্রয়োজন।
চলচ্চিত্রে বা সাহিত্যে মহিলাদের শ্রমদানকে সাংসারিক দায়িত্ব হিসেবেই দেখানো হয়ে থাকে। ‘মাদার ইন্ডিয়া’ সিনেমার রাধা ও ‘মন্থন’-এর বিন্দু দাগ কাটে। আবার ‘নর্থ কান্ট্রি’ সিনেমায় মাইন ফ্যাক্টরিতে কর্মরত মেয়েদের কাজ ও সম্মান প্রতিষ্ঠার দাবিতে এগিয়ে আসে জোশি। বাংলা সিনেমায় আগে দেখা যেত, কঙ্কালসার মা অবসরপ্রাপ্ত স্বামীর বদলে বাড়ির বেকার ছেলেকে বলছে, ‘দে না একটা গ্যাস এনে! উনুনের ধোঁয়ায় আর পারছি না’। এর বাইরে রান্নাঘরে মা-ঠাকুমা নিজেদের কর্মী নয়, সংসারী ভাবতে অভ্যস্ত। পরিবারের কাজ দাসত্বের নয়, দায়িত্বের। তাই এর বিরুদ্ধে সরব হয় না তারা। ‘যাও পহেলে উস আদমি কা সাইন লেকে আও’ বলেন না। ‘দিওয়ার’ সিনেমায় ধন সম্পদ ও বাড়ি-গাড়ি, এক দিকে। এ সব তুচ্ছ করে মা অন্য দিকে। মা অমূল্য। তাই বলে মায়েদের আজীবন ত্যাগ-তিতিক্ষার কথা বলে ভুলিয়ে রাখা মুশকিল। বছরের বেশিরভাগ সময়ে দিনে চার ঘণ্টা কাজে নিযুক্ত হলে তাকে পূর্ণ সময়ের শ্রমিক বলে। তবে মা? নিজের সংসারে জ্বালানি আনে, জল আনে, রান্না করে, ঘর মোছে, কাপড় কাচে। এটাই তো স্বাভাবিক। তার জন্য পারিশ্রমিক? এটা মূল্যবোধে আটকায়। কারণ, এই মূল্যবোধ নিরপেক্ষ কোনও বোধ নয়। অসাড় এক অহঙ্কারী সামাজিক বোধ। দর্প আছে। যুক্তি নেই। অসাম্য বাতিল করার প্রয়োজন আছে। কিন্তু ভিতর থেকে লড়াই করার তাগিদ নেই।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
মেয়েদের প্রাপ্য গড় মজুরি কম। কৃষি, শিল্প-ফ্যাশন, সিনেমা, মিডিয়া সবক্ষেত্রে নিয়ম করে মজুরির ফারাক রয়েছে। কৃষিক্ষেত্রে সবথেকে বেশি মেয়ে নিযুক্ত। অথচ সেখানেও মেয়েদের গড় মজুরি অনেক কম। মেয়েদের নিয়মিত অনুপস্থিত থাকার অভ্যাস, দুর্ঘটনার হার, মাতৃত্বকালীন ছুটি, প্রশিক্ষণের কাজে বাইরে না যাওয়ার অজুহাতে কম যোগ্যতা আর কম দক্ষতার পদে তাদের বসানো হয়। কাজের অভিমুখও বেঁধে দেওয়া হয়। শ্রমের মূল্য ও মর্যাদার সঙ্গে এ ভাবে রফা হতে থাকে। কিন্তু দানা বাঁধে না কোনও আন্দোলন। দাবি ও অধিকার আদায়ের বিষয়টি অপ্রাসঙ্গিক হতে থাকে। কারণ, ঘর ও বাইরের কাজের ভারসাম্য রক্ষা ও নিজেদের কাজ টিকিয়ে রাখতেই মহিলাকর্মী মরিয়া। কাজ বা দায়িত্ব চলে যাওয়ার ভয়ও কাজ করে সেখানে। বহু আন্তর্জাতিক সংস্থা মেয়েদের কর্মী হিসেবে রাখার ব্যাপারে একটু বেশি সাবধানতা নেয়। সেখানে এক রকম ধরেই নেওয়া হয়, মেয়েদের উন্নতির সূচক অন্যদের তুলনায় মন্থর। তাদের অফিসের মধ্যে থেকে ম্যানেজমেন্টকে সাহায্য করার দক্ষতা বেশি। তাই তাদের পদোন্নতি ও বেতন বাড়ানোর বিষয়ে শিথিলতা দেখানো হয়। বিশ্ব ব্যাঙ্কের গবেষণায় দেখা যায় যে, মহিলাদের চারপাশে সামাজিক মান এবং পুরুষের কাজের পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত অর্থনৈতিক লাভগুলি উপলব্ধি করা যাবে না। সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ কথা, মহিলারা বেতনভোগী চাকরি চায়। জাতীয় নমুনা জরিপে পাওয়া গিয়েছে, শহুরে ভারতের এক তৃতীয়াংশ নারী চাকরি চায়। এবং অর্ধেক গ্রামীণ এলাকায় গৃহকর্মের কাজে নিয়োজিত মহিলারাও একটি চাকরি চায়। এক গ্লোবাল ইনস্টিটিউটের এক গবেষক দল জানায়, পুরুষদের মতো সমান ভাবে মেয়েদেরও যদি অর্থনীতিতে অংশগ্রহণ হয় তবে ভারত ২০২৫ সালের মধ্যে জিডিপি ৬০ শতাংশ বাড়াতে পারবে।
২০১৭ সালে বিশ্ব ব্যাঙ্কের রিপোর্ট এক বিপজ্জনক অবনতির কথা বলে। ভারতীয় শ্রমশক্তি প্রতিযোগিতার পুনর্মূল্যায়নের পদ্ধতি অনুযায়ী নিরক্ষর নারী এবং স্নাতকোত্তর দুই দলের মধ্যে সবথেকে বড় পতন হয়েছে কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে। আবার সারা বিশ্ব জুড়ে মহিলারা বেশি সময় ব্যয় করে অবৈতনিক কাজে। প্রতিদিন মহিলারা বেতনহীন কাজে তিন থেকে ছ’ঘণ্টা সময় কাটায়। তাদের প্রদেয় এবং অবৈতনিক কাজের সমষ্টি বিবেচনা করে দেখা যায়, মহিলারা অন্যদের তুলনায় গড়ে প্রতি সপ্তাহে অতিরিক্ত ২.৬ ঘণ্টা পরিশ্রম অবৈতনিক কাজে ব্যয় করে। মহিলাদের অবৈতনিক কাজের সময় ব্যয়ের তালিকার সর্বোচ্চ স্থানে ভারত নিজের জায়গা করে নিয়েছে।
নাটাল এনজিয়ার তাঁর ‘উইমেন: অ্যান ইন্টিমেট জিওগ্রাফি’ বইয়ে লিখেছেন, অন্যদের সঙ্গে নারীর মৌলিক পার্থক্যটুকু হল সৃষ্টির বৈচিত্র্য, রহস্যের অপার বিস্ময়। এক্স ক্রোমোজোমে ‘অতি বৃহত্তর জিন সমৃদ্ধি আছে’। অন্যদের সঙ্গে মেয়েদের শারীরিক ক্ষমতা ও মেধার দক্ষতায় ফারাক তাই অবান্তর। ‘টাইম ইউজ স্টাডি’-র মাধ্যমে মানুষের শ্রমের ধরন ও শ্রমে ব্যয় করা সময়ের হিসেব এই তথ্য দেয় যে, মেয়েদের অবসর বিনোদনে বা নিজের শখে সময় কম কাটে। অনেক ক্ষেত্রেই পরিবারে অর্থনৈতিক সাচ্ছন্দ্য মেয়েদের বিনা মজুরির শ্রমের মাধ্যমেই অর্জিত হয়। পূর্ব ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়াতে কর্মরত মহিলারা রান্না করা খাবারের প্যাকেট নিয়ে বাড়ি ফেরে। কিন্তু ভারতের উন্নয়নের বৃত্তে ও প্রান্তে থাকা বহু পরিবারগুলির কল্পনাতেও এমন ভাবনা আসা বারণ। এ ভাবেই পারিবারিক মূল্যবোধের গেরোয় আটকে থাকে মেয়েদের গৃহস্থালি শ্রমের অধিকারের দাবি।
বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে শ্রমজীবি মেয়েদের এই স্লোগান একটি বড় জয়—‘গতর খাটিয়ে খাই, শ্রমিকের অধিকার চাই’। তাই কাজের অধিকার, শ্রমের মূল্য, মহিলা বেকারত্বের অবসান জরুরি। কাজের বিনিময়ে উপযুক্ত উপার্জন দাবি করতে শেখায় শ্রমের মর্যাদাবোধ। সেটা কথা দিয়ে নয়, আসে আর্থিক মূল্য দিয়ে। কারণ, পারিশ্রমিক অর্থমূল্যেই হয়। ফলে কাজ পাওয়া, স্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও উপযুক্ত পারিশ্রমিকের দাবিতে আরও একটি ঐতিহাসিক লাল দাগের অপেক্ষা। শ্রমজীবী মেয়েদের ঘরে বাইরে একজোট হয়ে পারিশ্রমিক আদায় নিশ্চিত করার পালা।
(শেষ)
শিক্ষিকা, রঘুনাথগঞ্জ হাইস্কুল