উহান থেকে নিউ ইয়র্ক, সাও পাওলো থেকে মুম্বই— পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে অতিমারির কেন্দ্রবিন্দু শহর থেকে মহানগর। রোগের বিস্তারের মূলে কি তা হলে নগরায়ণ? জনঘনত্বের নিরিখে এশিয়ার তুলনীয় শহর সিঙ্গাপুর, শাংহাই বা টোকিয়ো, যেখানে যাদের সংক্রমণের সূচনা হয়েছিল নিউ ইয়র্কের সঙ্গে সঙ্গেই, সেখানে স্থানীয় প্রশাসন নাগরিকদের সহায়তায় উচ্চ ঝুঁকির অঞ্চল চিহ্নিত করে রোগীদের পরীক্ষা, সংক্রমিতদের অনুসরণ ও কোয়রান্টিনের মাধ্যমে পরিস্থিতি অনেকটা সামাল দিয়েছে।
কেন এক শহর কোভিড-১৯ সামলাতে সফল, অন্য শহর ব্যর্থ, তার সহজ ব্যাখ্যা নেই। জনসংখ্যা, প্রবীণ ও কমবয়সিদের অনুপাত, শিক্ষার তারতম্য, সমাজে বৈভব ও বৈষম্য, ধর্মীয় আচার, কর্মক্ষেত্র, জনস্বাস্থ্যের সুবিধা, স্থানীয় পরিবেশ, গোষ্ঠীচেতনা এবং সামাজিক পুঁজির মতো আন্তঃসম্পর্কিত বিষয়। এক শহরের মধ্যে আছে অনেক শহর।
ভারতে কোভিড-১৯’এর মৃত্যুসংখ্যায় মহারাষ্ট্র ও গুজরাত যথাক্রমে প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানে। বৃহৎ জনসংখ্যার রাজ্যগুলির মধ্যে এই দুই রাজ্যেই নগরায়ণের হার জাতীয় গড়ের থেকে অনেক বেশি। মহারাষ্ট্রের পঞ্চাশ শতাংশের বেশি মৃত্যু মুম্বইয়ে, গুজরাতের পঁচাত্তর শতাংশ আমদাবাদে। আমদাবাদে ঘরবন্দির নিয়মাবলি কঠোর করা হয়েছে। ওষুধের দোকান আর এটিএম ছাড়া সবই বন্ধ। এক কোটি পঁচিশ লক্ষ মুম্বইবাসীর মধ্যে বস্তিবাসী বাহান্ন লক্ষ। কিন্তু, শহরের মাত্র সাত শতাংশ জমিতে অধিকার বস্তিবাসী মানুষের। সমুদ্রমুখী দক্ষিণ ও মধ্য মুম্বই। সেখানে বৈভব ও দারিদ্রের প্রতিযোগিতামূলক সহাবস্থান। ‘নিউ ওয়র্ল্ড ওয়েলথ’-এর ২০১৯ সালের তথ্য অনুসারে, বিশ্বের ধনীতম কুড়িটি শহরের তালিকায় একমাত্র ভারতীয় প্রতিনিধি মুম্বই। আবার এখানেই আছে ধারাভি, মদনপুরা, গ্রান্ট রোডের ঘিঞ্জি বস্তি। করোনা সংক্রমণের কেন্দ্রস্থল।
এশিয়ার বৃহত্তম বস্তি মুম্বইয়ের ধারাভি। সাত লক্ষ মানুষের বসবাস। বিভিন্ন ভাষা, সংস্কৃতি ও ধারণার বৈচিত্রে বহমান জীবন। পরিবারভিত্তিক উদ্যোগের অবদান একশো কোটি ডলারের বার্ষিক অর্থনীতি। এখানে উৎপন্ন চামড়ার দ্রব্য, জামাকাপড় বা মৃৎশিল্প বিদেশের বাজারে রফতানিযোগ্য পণ্য। এলাকাটা পৃথিবীর সব থেকে ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলও বটে। দারিদ্রের ঘনবসতি। নেই পর্যাপ্ত খোলা জায়গা বা খেলার মাঠ। আলো হাওয়া অপ্রতুল। দেড়শো বর্গফুটের ঘরে থাকেন ছ’জন। মাথাপিছু মাত্র পঁচিশ বর্গফুট। করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে নিয়ম মতো মাথাপিছু চল্লিশ বর্গফুট জায়গা প্রয়োজন। বস্তিবাসীরা চাইলেও শারীরিক দূরত্ব রক্ষা করা অসম্ভব। রোগের সংক্রমণ ঠেকাতে ঘন ঘন হাত ধোওয়া সুনিশ্চিত করতে যে পরিমাণ জলের প্রয়োজন, তা এখানে আকাশকুসুম কল্পনা। চল্লিশ শতাংশ বাড়িতে নেই শৌচাগার। একটি গোষ্ঠী শৌচাগার ব্যবহার করেন অন্তত একশো পরিবার।
কেন্দ্রের ‘বেসিক সার্ভিসেস ফর আরবান পুওর’ বা ‘হাউজ়িং ফর অল’ প্রকল্পে মুম্বই পৌরনিগমের উদ্যোগে বেসরকারি অংশীদারিত্বে বস্তি পুনর্বাসনের কাজ চলছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রকল্পগুলিকে বাণিজ্যিক ভাবে সফল করতে গিয়ে অতিরিক্ত ‘ফ্লোর এরিয়া রেশিয়ো’ ব্যবহার করে নির্মিত হয়েছে বহুতল বসতি। বেসরকারি সংস্থার মুনাফার অঙ্ক ঠিক করেছে দুটি বাড়ির মধ্যে দূরত্ব। অনুভূমিক বস্তি পরিবর্তিত হয়েছে পঁচিশ বা ত্রিশ তলা বস্তিতে। খোলা জায়গা আগের থেকে কমেছে। কমেছে বস্তিপিছু জমির পরিমাণ। পরিবার ও সামাজিক জীবনযাত্রার সঙ্গে বাড়ির নকশার সংযোগ ক্ষীণ।
মুম্বইয়ে কয়েকটি পুনর্বাসন প্রকল্পের সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে মানুষ যক্ষ্মায় আক্রান্ত। বহুতলের বদ্ধ ঘেরাটোপ, অপ্রশস্ত বারান্দা, লিফটে স্পর্শবাহী জীবাণু সংক্রমণে বাড়তি বিপদ ডেকে আনছে। আমদাবাদে পরিস্থিতি কিছুটা অন্য রকম। সংক্রমণের কেন্দ্র প্রাচীর ঘেরা পুরনো শহর ও পূর্ব আমদাবাদের ঘিঞ্জি অঞ্চল। সংক্রমণের হার বেশি জামালপুর, দানিলিমদা, দরিয়াপুর এবং বেরহামপুরে। ঘিঞ্জি পরিবেশ, খোলা জায়গার অভাব, বাড়িতে শৌচাগারের অনুপস্থিতি ও পরিশোধিত জলের ঘাটতি রোগের অনুঘটক। শিক্ষার অভাব, আর্থিক অক্ষমতা, ধর্মীয় সংস্কার ও রক্ষণশীল মানসিকতা স্বাস্থ্য সচেতনতার পথে দুর্লঙ্ঘ্য বাধা। বস্তিবাসীদের স্থানীয় প্রশাসনের প্রতি ঘোর অবিশ্বাস। সব মিলিয়ে উদ্বেগজনক অবস্থা।
জনবসতির ঘনত্ব নিঃসন্দেহে শহরে সংক্রামক রোগের অনুঘটক। এখানে সমস্যাটা মূলত জমি ও পরিষেবা বণ্টনের। উচ্চবিত্তের এনক্লেভ সুপরিকল্পিত, গরিবের মহল্লায় সব কিছুই অকুলান। জনস্বাস্থ্যের প্রসঙ্গ সেখানে বিলাসিতার নামান্তর। এই বিভাজন ক্রমবর্ধমান। নিম্নবিত্ত মহল্লা ও বস্তি পুনর্বাসন প্রকল্পে দায়সারা ভাব স্পষ্ট। এ বিষয়ে প্রশাসনিক মনোযোগ এবং সম্পদের সংস্থান ক্ৰমশ অপস্রিয়মাণ। এ ভাবে চলতে থাকলে গরিবের স্বাস্থ্যের কোল্যাটারাল ড্যামেজ ঠেকানো অসাধ্য।
সোশ্যাল হাউজ়িং অর্থাৎ সামাজিক আবাসনে সরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। কেরল অনেক দিন ধরে কাজটা করে চলেছে। সে রাজ্য সংক্রমণ ঠেকাতে গণপরিষেবা বণ্টনের নিরিখে অনেক উন্নত দেশকে পিছনে ফেলে দিয়েছে। কোভিড-১৯’পরবর্তী সময়ে দিল্লি, মুম্বই, কলকাতার মতো মহানগরে পরিকল্পনার অভিমুখ কী হবে, তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। বৃহত্তর নাগরিক সমাজ সহমত— উন্নয়নের দৃষ্টিভঙ্গিতে নিয়ে আসতে হবে আমূল পরিবর্তন। জনস্বাস্থ্য সুনিশ্চিত করতে প্রয়োজন বস্তির মানুষের মধ্যে শহরের জমি ও নাগরিক পরিষেবার সুষম বণ্টন। সামগ্রিক পরিকল্পনার জন্য সংগ্রহ করতে হবে প্রামাণ্য তথ্য। ড্রোন, উপগ্রহ চিত্র, ভৌগোলিক তথ্য ব্যবস্থার মতো প্রযুক্তির সাহায্যে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের ঝুঁকিপূর্ণ বসতি ও জনসমষ্টির সমীক্ষা ও মানচিত্রায়ণ আজকের দিনে মোটেও কঠিন কাজ নয়। উল্লেখ্য, ভুবনেশ্বর এ বিষয়ে অনেকটা এগিয়েছে। এই তথ্য বিশ্লেষণ করে জনস্বাস্থ্যের অগ্রাধিকার বিবেচনায় রেখে শহরে ভবিষ্যৎ বসতির ঘনত্ব এবং জমি ও পরিষেবা পুনর্বণ্টনের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে হবে। উদ্দেশ্য, শহরের গরিব ও নিম্ন আয়ের মানুষের আবাসনে সীমিত বিকল্পের ক্ষেত্রটি আর একটু প্রসারিত করা। যাতে তাঁরা সমৃদ্ধ শহর নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হতে পারেন। পরিকল্পনার রূপায়ণ নির্ভর করবে বৃহত্তর নাগরিক সমাজের সম্মতি ও প্রশাসনিক সদিচ্ছার ওপর।
আইআইইএসটি, শিবপুর