অসিতকুমার হালদার-এর ‘রবিতীর্থে’ নামক সুপাঠ্য বইটিতে মার্চ ১৯১৫-য় শান্তিনিকেতনে ছোটলাট লর্ড কারমাইকেলের আগমন বিষয়ে একটি বর্ণনা আছে। কবির নাইটহুড লাভের কয়েক মাস আগের ঘটনা। শিল্পরসিক লাটসাহেবকে আম্রকুঞ্জে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে গিয়েছিলেন ছাতিমতলার বেদিতে। সেখানে কবির বক্তৃতা শুরু হওয়ার কিছু ক্ষণের মধ্যেই দেখা গেল বিভিন্ন জেলে বাংলার রাজনৈতিক বন্দিদের ওপর ঘটে চলা অন্যায়ের তীব্র প্রতিবাদ করছেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে ছোটলাটের ব্যক্তিগত সচিব রবার্ট গুরলে ঘড়ি দেখিয়ে জানালেন সরকার বাহাদুরের ফেরার সময় হয়ে গিয়েছে। রবীন্দ্রনাথের কথার কোনও জবাব সে দিন দিতে দেওয়া হয়নি লর্ড কারমাইকেলকে।
এই দৃষ্টান্তটির মধ্যে লুকিয়ে আছে সরকারি আনুকূল্য ও খেতাবের তোয়াক্কা না করে সব সময়েই সাম্রাজ্যবাদী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কবির প্রতিবাদ এবং সেই সঙ্গে এর জবাব এড়িয়ে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে ইংরেজ শাসকের রাজনৈতিক কৌশল। এই কৌশলই প্রকট হয়ে ওঠে প্রশাসনের আচরণে ও বিলেতের কাগজগুলোর প্রায় পরিকল্পিত নৈঃশব্দ্যের মধ্যে দিয়ে যখন জালিয়ানওয়ালা বাগ হত্যাকাণ্ড ও পঞ্জাবে সামরিক শাসনকে ধিক্কার জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ ‘স্যর’ উপাধি ফিরিয়ে দেন।
নাইটহুড ফিরিয়ে-দেওয়া চিঠি ইংরেজ কেমন ভাবে গ্রহণ করেছিল, সেই আখ্যানের দিকে বোধ হয় আজ নজর দেওয়া দরকার। নইলে শাসক-নির্মিত বয়ানের সূত্র ধরে অনেকের মনে হতে পারে যে রবীন্দ্রনাথের চিঠিটা খুব জরুরি হলেও সে সময়ে তেমন গুরুত্ব পায়নি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পীঠস্থানে, যেমন ভেবেছেন কিম ওয়াগনার জালিয়ানওয়ালা বাগের শতবর্ষে সম্প্রতি প্রকাশিত তাঁর ‘অ্যান এম্পায়ার অব ফিয়ার’ বইতে।
১৯১৯ সালের ৩১ মে বড়লাট চেমসফোর্ডকে চিঠি-টেলিগ্রাম পাঠানোর পর প্রথমে ১২ জুন প্রাপ্তিস্বীকার ও তার পর ২০ জুন আর একটি চিঠি মারফত রবীন্দ্রনাথকে জানানো হয় যে, নাইট খেতাব প্রত্যাহার করে নেওয়ার ক্ষমতা বড়লাটের নেই, একমাত্র সম্রাটেরই আছে এবং স্বয়ং সম্রাটের কাছে তিনি এ বিষয়ে কোনও সুপারিশ করতে চান না। এ ভাবেই এড়িয়ে যাওয়া হয় খেতাব ফিরিয়ে নেওয়ার অনুরোধ। কিন্তু যদি আমরা ১৯১৯-এর গোপন নথি দেখি, তা হলে কিন্তু স্পষ্ট হবে যে বড়লাটকে টেলিগ্রাম পাঠানোর পরে জোড়াসাঁকো থেকে খবরের কাগজগুলোয় সরাসরি চিঠির কপি চলে যাওয়ায় এবং পুরো চিঠিটা এক দিন পরেই কলকাতার ‘দি ইংলিশম্যান’ কাগজে প্রকাশ হওয়ায় সরকার বিশেষ অস্বস্তির মধ্যে পড়ে। যদিও ‘দি ইংলিশম্যান’ বলেছিল যে রবীন্দ্রনাথ ‘স্যর’-এর বদলে ‘বাবু’ হয়ে থাকলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কানাকড়িও এসে যাবে না— কবির চিঠির প্রভাব নিয়ে সাম্রাজ্যের কপালে ভাঁজ দেখা গেল। বাংলার বাইরে দেশের অন্যত্র তখন সাম্রাজ্যবিরোধী ইংরেজি কাগজ/পত্রিকাগুলো রবীন্দ্রনাথের নাইট খেতাব ত্যাগ নিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে। ‘ইন্ডিয়ান সোশ্যাল রিফর্মার’ লেখে, সারা পৃথিবীর মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে কবির চিঠি। ‘এভরিম্যান’স রিভিউ’ পত্রিকা মন্তব্য করে যে, এই রকম খেতাবত্যাগের কোনও পূর্ব দৃষ্টান্ত খুঁজতে হলে আমাদের ফিরতে হবে রবীন্দ্রনাথের কাছেই, কারণ ১৯১৬ সালে কানাডায় বক্তৃতা দেওয়ার আমন্ত্রণ গ্রহণ না করে তিনি আগেই প্রতিবাদ করেছিলেন সেখানকার বর্ণবিদ্বেষী নীতির বিরুদ্ধে! ‘দি ইন্ডিপেন্ডেন্ট’ প্রস্তাব দেয় যে যাঁরা কোনও না কোনও ছোট-মেজো-বড় উপাধি পেয়েছেন, তাঁদের সকলেরই উচিত রবীন্দ্রনাথের অনুসরণে সেগুলো ফেরত দেওয়া।
সরকার ঠিক করে নিল, কবির খেতাব ফিরিয়ে নিলে তাঁর এই প্রতিবাদ যে পরিমাণ প্রচার পাবে—নথির ভাষায় ‘ইন ভিউ অব দি অ্যাডভারটাইজ়মেন্ট দ্যাট উড বি গিভন টু টেগোর’, তা কখনওই অভিপ্রেত নয়। সবচেয়ে বড় কথা, স্বীকার করা হল যে তাঁর অনুরোধ রাখলে পরোক্ষে মেনে নেওয়া হবে পঞ্জাবে অসহনীয় দমননীতি চালানো হয়।
অতএব বিলেতের কাগজগুলোয় খেতাব ত্যাগের চিঠিটা এক রকম চেপে দেওয়া হয়েছিল। অথচ ১৯১২-১৩ থেকে ওখানকার কাগজে কাগজে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কম চর্চা তো হয়নি! হাওয়া ঘুরে গেল ১৯১৬-১৭ সালে পূর্ব ও পশ্চিমে তাঁর বক্তৃতা-সফরে ‘ন্যাশনালিজ়ম’-এর বিরুদ্ধ সমালোচনা করার সময়ে। ১৯১৯-এর জুনে দু’তিনটে দৈনিকে অতি সংক্ষেপে নাইটহুড ত্যাগের খবর ছিল বটে, কিন্তু চিঠির উদ্ধৃতি বা সারাংশ দিয়ে খবরটা চোখে পড়ার মতো জায়গায় পৌঁছতে দেওয়া হয়নি।
সম্ভবত এর একমাত্র ব্যতিক্রম ঘটে ‘দ্য নেশন’ কাগজে সাংবাদিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার আন্দোলন কর্মী হেনরি নেভিনসন-এর কলমে। ১৯১৯-এ পঞ্জাবে দমন-পীড়ন প্রসঙ্গে নেভিনসন অন্তত দু’টি লেখা লিখলেন। তাঁর মনে হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের চিঠির বাণী মর্মে মর্মে উপলব্ধি করা যায় ভারত থেকে ‘স্বাধীন’ সূত্রে পাওয়া তথ্যপ্রমাণের নিরিখে। চিঠির উদ্ধৃতি দিয়ে নেভিনসন লিখেছিলেন, এই পরিত্যাগ তীব্র বেদনা ও আতঙ্কের প্রকাশ— ‘অা সিম্পল জেসচার অব হরর অ্যান্ড পেন!’
সে বছরের শেষে ওলন্দাজ কবি ফ্রেডরিক ভ্যান এডেন-এর রবীন্দ্রনাথকে লেখা চিঠি থেকে জানা যায় ইউরোপে অনেক মানুষের নজর আকর্ষণ করেছিল কবির মর্মস্পর্শী প্রতিবাদ।
কবির প্রতিবাদ ধ্বনিত হওয়ার দিন দশেক আগে ভাইসরয়ের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল থেকে স্যর শঙ্করন নায়ার পদত্যাগ করেন পঞ্জাবে সামরিক শাসনের অবসান চেয়ে। এই দুটো খবরই বিদেশে দেশের মানুষের মনে আশার সঞ্চার করে। কেমব্রিজে ভারতীয় ছাত্ররা রবীন্দ্রনাথের চিঠি পড়ে উজ্জীবিত হয়ে ওঠে এবং লন্ডনে গোটা দুই সভা হয় এই দুই দেশপ্রেমিককে অভিনন্দন জানিয়ে।
রাজনৈতিক কৌশল ও সাম্রাজ্যবাদী কাগজগুলোর প্রায় সেন্সর করার পরিকল্পনা সত্ত্বেও কালাপানি পার হয়ে নানা দিকে ছড়িয়েছিল চিঠির খবরটা। পরের বছর বিলেতে কয়েক সপ্তাহ বেশ অস্বস্তির মধ্যে কেটেছিল রবীন্দ্রনাথের। এর চরম নিদর্শন অক্সফোর্ডে বক্তৃতা দিতে গিয়ে জানতে পারেন যে রাজকবি রবার্ট ব্রিজেস ওই বক্তৃতা-সভায় সভাপতিত্ব করার আমন্ত্রণ পেয়েও গ্রহণ করেননি। এর পর আমেরিকায় তাঁর দীর্ঘ বক্তৃতা-সফরে বিশ্বভারতীর জন্য অর্থসংগ্রহ অনেকটাই ব্যাহত হয়েছিল ব্রিটিশ অভিসন্ধির ফলে।
যারা নিস্পৃহতা দেখাতে চেয়েছিল রবীন্দ্রনাথের অগ্নিবর্ষী পরিত্যাগ-পত্রের প্রতি, তারা একশো বছর আগে পঞ্জাবের গ্রামে গ্রামে অত্যাচারিত, অপমানিত মানুষ কী ভাবে গ্রহণ করেছিল নাইটহুড ফিরিয়ে দেওয়ার খবর, সে কথাও সম্ভবত গোয়েন্দা মারফত জানত। পঞ্জাব থেকে রবীন্দ্রনাথকে লেখা অ্যান্ড্রুজ়ের চিঠি জানায়, সেখানকার মানুষের মন কতখানি অভয় বোধ করেছিল ওই খবরে। আশ্চর্য কী যে শাসিতের কাছে যা অভয়বাণী, শাসক কৌশল করে তা আড়ালে রাখতে চাইবে!