নরেন্দ্র মোদী
নরেন্দ্র মোদীর প্রধানমন্ত্রিত্বে একটি অদ্ভুত ঘটনা রোজকার বাস্তব হইয়া গিয়াছে। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরের ঘটনাগুলি একের পর এক আন্তঃরাষ্ট্র সম্পর্কে বিশেষ প্রাসঙ্গিক বিষয়ে পরিণত হইতেছে, এবং পাশাপাশি, রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি বৈদেশিক সম্পর্কের চার দিকে ঘূর্ণিত হইতেছে। পর পর কাশ্মীর, অযোধ্যা এবং নাগরিকত্ব আইন, তিনটি বিষয়ে ভারত সম্পর্কে বহির্বিশ্বে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হইয়াছে, এবং দেশের বিদেশ মন্ত্রক বাধ্য হইতেছে বিষয়গুলি লইয়া রীতিমতো সক্রিয় প্রচারে নামিতে। এই প্রচারে শেষ পর্যন্ত কাজ কতটুকু হইবে, জানা নাই। গণতন্ত্র ও নাগরিক অধিকারের গুরুত্ব বিশ্বময় দ্রুত হ্রাস পাইবার মুখে, সেই পরিবর্তনশীল বিশ্বে ভারত প্রকৃতই কতখানি উদ্বেগের তরঙ্গ তুলিবে, কে জানে। এমতাবস্থায় ভারতের বিজেপি সরকার সিদ্ধান্ত করিয়াছে, পাকিস্তান-বিরোধিতা-ভিত্তিক ‘জাতীয়তাবাদ’ দিয়াই তাহারা দেশের নাগরিক সমাজকে জিতিয়া লইবার চেষ্টা করিবে। তাই, কখনও প্রধানমন্ত্রী বলিতেছেন, ভারতবাসীকে যদি আন্দোলন করিতেই হয়, তাঁহারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে করুন। সেনাপ্রধান বারংবার মনে করাইতেছেন, কাশ্মীর সীমান্তে পাক-মদতে সন্ত্রাস কিন্তু সদাপ্রস্তুত। কখনও ত্রস্ত নাগরিককে দলীয় কর্মী ও প্রশাসনিক আধিকারিকেরা বুঝাইতেছেন যে, মুসলিম হইলে হয় পাকিস্তান গমন নয় মৃত্যুবরণ, এই দুইটিই পথ, আর প্রতিবাদী হইলে ভারতে না থাকিয়া পাকিস্তানে চলিয়া যাওয়াই বাঞ্ছনীয়।
এই পাকিস্তান-মনস্ক ভারততত্ত্বের শেষতম সংযোজন, ইংরাজি নববর্ষে প্রধানমন্ত্রী মোদী সমস্ত প্রতিবেশী দেশের প্রতি শুভেচ্ছাবার্তা হইতে বাদ পড়িল, পাকিস্তান। নিশ্চয় তাঁহার দলের একনিষ্ঠ সমর্থকেরা সাধু-সাধু রব তুলিলেন। এই পদক্ষেপের অনৈতিকতা কিংবা কূটনৈতিক মাত্রাজ্ঞানের লোপ ইত্যাদি যুক্তি তুলিয়া লাভ নাই। কেননা এই নূতন ভারতে কূটনীতির মাত্রাজ্ঞান বস্তুটির মূল্য লইয়াই সন্দেহ। কিন্তু অন্য একটি প্রসঙ্গ তোলা দরকার। প্রধানমন্ত্রী কি নিজের নীতিতেও পারম্পর্য রক্ষা করিবেন না? যখন প্রথম বার প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ লইয়াছিলেন, ঘটা করিয়া সমস্ত প্রতিবেশী দেশনেতাদের আমন্ত্রণ জানাইয়াছিলেন, পাকিস্তানকেও। পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রীর সহিত বিস্তর দহরম-মহরম করিবার চেষ্টা করিয়াছেন তিনি, তাঁহার কংগ্রেসি পূর্বসূরির অপেক্ষা অনেক বেশি। তাহার পর কি তিনি অকস্মাৎ পুনরাবিষ্কার করিলেন যে, পাকিস্তান ভারতের চরম ও চিরকালীন শত্রু? ২০১৪ সালে কি তিনি তাহা জানিতেন না? না কি, যখন তাঁহার যে ধরনের রাজনীতি প্রয়োজন, সেই অনুসারে তিনি কূটনৈতিক অবস্থান প্রদর্শন করেন? রাষ্ট্রের স্বার্থের অপেক্ষা নিজের এবং নিজের দলের স্বার্থেই তিনি ‘পাকিস্তান’-এর ব্যাখ্যা করেন?
প্রধানমন্ত্রী ও তাঁহার দলের এই ভাবনাচিন্তার কারণেই আজ ভারত ক্রমশ পাকিস্তানে পরিণত হইতেছে। স্বাধীনতা ও দেশভাগের পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিপুল পার্থক্য রচিত হইয়াছিল, দুইটি সম্পূর্ণ আলাদা চরিত্রের রাষ্ট্র নির্মিত হইয়াছিল। গণতন্ত্রের অনুপস্থিতিতে, আর্থ-সামাজিক স্থিতির অভাবে, নেতৃত্বের সীমাহীন দুর্নীতিতে, সামরিক শক্তির অঙ্গুলিচালনায় বিপন্ন-বিধ্বস্ত পাকিস্তানের রাজনীতিতে ভারত-বিরোধিতার জুজুকে চালু না রাখিয়া উপায় ছিল না, ইহাতেই যেন নাগরিক সমাজের মনোবল অটুট রাখিবার চেষ্টা হইত। ধুয়া তুলিতে হইত যে ‘ভারত’ একটি বিরাট বিপদ, তাই পাকিস্তানকে প্রতি মুহূর্ত সজাগ থাকিতে হইবে। ভারতও এখন সেই একই নিরাপত্তাহীনতার পথের পথিক। সেই বিপন্ন অর্থনীতির বাসিন্দা। সম্ভবত তাই তাহার সরকারকেও নিয়ত পাকিস্তান-বিরোধিতার চাবুকে নিজের রাষ্ট্রীয় অশ্বকে সচল রাখিতে হয়। এই ভারতের মডেল পাকিস্তানই, বলিলে ভুল হইবে না।