শান্তিনিকেতনে শেষ জন্মোৎসব, ১৪ এপ্রিল, ১৯৪১। আলোকচিত্রী শম্ভু সাহা। ছবি: বিশ্বভারতী রবীন্দ্রভবন সংগ্রহ
১৮৮৫-র ডিসেম্বর মাসের ২৯ তারিখে রবীন্দ্রনাথ ‘জন্মতিথির উপহার’ নামে একটি কবিতা লিখলেন। কবিতার সঙ্গে ‘একটি কাঠের বাক্স’ উপহার দিলেন তেরো বর্ষীয় ভাইঝি, ‘বিবি’কে। বিবি হলেন জ্ঞানদানন্দিনী দেবী এবং সত্যেন্দ্রনাথের একমাত্র কন্যা, ইন্দিরা। জ্ঞানদানন্দিনী দেবী বিলেত থেকে ফিরে দুই সন্তান, সুরেন্দ্রনাথ এবং ইন্দিরার জন্মদিন পালনের প্রথা চালু করলেন। এর আগে ঠাকুর পরিবারে ধূমধাম করে জন্মদিন পালনের কোনো খবর জানা যায় না। ১৮৮৫ সালের ২৯ ডিসেম্বর ছিল ইন্দিরার ত্রয়োদশতম জন্মদিন। ‘রবীন্দ্রস্মৃতি’ গ্রন্থে ইন্দিরা এই উপহার প্রসঙ্গে লিখেছিলেন, ‘আমার জন্মদিনে একটি সুন্দর পিয়ানোর মতো গড়নের দোয়াতদানি উপহার দিয়ে তার সঙ্গে যে কয়েক ছত্র লিখেছিলেন সেও তাঁর হাতের স্পর্শে উজ্জ্বল।’ বিবির এই জন্মদিন পালনের ঘটনা হয়তো কবির চিত্তকে উতলা করে তুলেছিল, যেন ‘নাচে জন্ম, নাচে মৃত্যু পাছে পাছে’র পরশ পেলেন তিনি। বিবির থেকে বারো বছরের বড় এই পিতৃব্যকে এর আগে নিজের জন্মদিনের ব্যাপারে কখনও পুলকিত হতে দেখা যায়নি। বিবির জন্মদিনের ছ’মাস পর কবির অন্তরের সেই সুপ্ত বাসনা ধরা দিল বন্ধুবর শ্রীশচন্দ্র মজুমদারকে লেখা একটি চিঠিতে। ১৮৮৬ সালের ৭ মে অর্থাৎ পঁচিশে বৈশাখ বিশেষভাবে পুলকিত হয়ে জীবনে প্রথমবার নিজের জন্মদিন নিয়ে দু-কলম লিখে ফেললেন!
‘আজ আমার জন্মদিন — পঁচিশে বৈশাখ — পঁচিশ বৎসর পূর্ব্বে এই পঁচিশে বৈশাখে আমি ধরণীকে বাধিত করতে অবতীর্ণ হয়েছিলুম — জীবনে এমন আরও অনেকগুলো পঁচিশে বৈশাখ আসে এই আশীর্ব্বাদ করুন।..’
ততদিনে পঁচিশ বছরের যুবক রবিঠাকুর নিজগুণে পরিবারের সদস্যদের কাছে অত্যন্ত প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। ফলস্বরূপ পরের বছর তাঁর বোনঝি, ‘সল্লি’ একটি ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটিয়ে ফেললেন।
সেই বছর রবীন্দ্রনাথ ২৭ বছরে পা দিয়েছেন। সস্ত্রীক তিনি ৪৯ নং পার্ক স্ট্রিটে মেজদা সত্যেন্দ্রনাথ এবং মেজবউঠান জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর সঙ্গে থাকতেন। বিপত্নীক জ্যোতিরিন্দ্রনাথও থাকতেন সেই বাড়িতে। এদিকে কবির ন’দিদি স্বর্ণকুমারী দেবী তখন উল্টোডাঙার কাশিয়াবাগানে থাকেন। ১৮৮৭ সালের মে মাসের সাত তারিখ সেদিনটি ছিল শনিবার স্বর্ণকুমারী দেবীর কন্যা সরলা দেবী খুব ভোরে কাশিয়াবাগান থেকে দাদা জ্যোৎস্নানাথকে সঙ্গে নিয়ে চলে গিয়েছিলেন পার্ক স্ট্রিটের বাড়িতে। সঙ্গে নিয়েছিলেন বাড়ির বকুল ফুলের নিজের হাতে গাঁথা মালা। পথে কিনে নিয়েছিলেন বেল ফুলের মালাসহ অন্যান্য আরো ফুল। এছাড়া একজোড়া ধুতি-চাদর এবং একটি ইংরেজি কবিতার বই, The Poems of Heine. এরপর ৪৯ নং পার্ক স্ট্রিটের বাড়িতে নিঃশব্দে ঢুকে সোজা চলে গেলেন রবীন্দ্রনাথের ঘরে। ঘুমন্ত রবীন্দ্রনাথকে জাগিয়ে ফুল মালা ধুতি চাদর - এই নৈবেদ্য তাঁর পায়ের কাছে রেখে প্রণাম করলেন। জ্যোৎস্নানাথ রবিমামাকে প্রণাম করে কবিতার বইটি উপহার দিলেন, যা কিনা রবীন্দ্রনাথের জীবনে জন্মদিনে পাওয়া প্রথম উপহার হিসেবে স্বীকৃত। এরপর আশপাশের ঘর থেকে পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও বেরিয়ে এসে রবীন্দ্রনাথকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা আশীর্বাদ প্রণাম জানালেন। সারা বাড়িতে ‘‘রবির জন্মদিন” বলে সাড়া পড়ে গেল। ভাগ্নি সল্লির মাধ্যমে ‘রইমা’র প্রথম জন্মদিন পালনের সেই শুরু। সরলা দেবী তাঁর রবিমামাকে ‘রইমা’ বলে ডাকতেন।
এরপর কবির জীবনে অনেক জন্মদিন এসেছে। পরবর্তী বেশ কয়েক বছর পরিবারের মধ্যেই তাঁর জন্মদিন পালনের ধারা অব্যাহত ছিল। বেশিরভাগ সময়ে ভাইপো ভাইঝি ভাগ্নে ভাগ্নিরা উৎসাহিত হয়ে তাঁদের রবিকাকা বা রবিমামার জন্মদিন পালন করতেন। ১৮৯৫ সালে, ৩৫-তম জন্মদিনের কথা প্রসঙ্গে ‘রবীন্দ্রস্মৃতি’র পাতায় ইন্দিরাদেবী লিখেছিলেন, ‘একটি খাতায় আমাদের প্রিয় ইংরেজ কবিদের বিখ্যাত কবিতাগুলি নকল করে তাঁকে উপহার দিয়েছিলাম।’ এটি ইন্দিরাদেবীর ভাষায়, ‘তাঁর প্রতি আমাদের ভাইবোনের ভক্তি ও ভালোবাসার নিদর্শন’। কিটস, শেলি, ব্রাউনিং, টেনিসনসহ বায়রন, ওয়ার্ডসওয়ার্থ প্রমুখ সর্বজন পরিচিত ইংরেজ কবিদের ৭২-টি কবিতা ইন্দিরা নিজের হাতে নকল করে ২৮০ পাতার একটি সুদৃশ্য বাঁধানো খাতা উপহার দিয়েছিলেন তাঁদের প্রিয়তম রবিকাকে। এছাড়াও পরবর্তী দুটি জন্মদিনে রবীন্দ্রনাথ দুটি কবিতা উপহার পান প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় এবং প্রিয়নাথ সেনের কাছ থেকে।
এরপর ৪২ বছরের জন্মদিন পালন করা হয় শান্তিনিকেতনে। লক্ষ্য করার বিষয় ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল থেকে তিনি তখন বাহিরমহলে সমাদৃত হচ্ছেন। এরমধ্যে ১৯০২ সালের নভেম্বর মাসের উনত্রিশ তারিখে মৃণালিনী দেবী চলে গেলেন। এরপর গেলেন কন্যা রেণুকা। চলে গেলেন শমীও। শমীসহ কাদম্বরী, মৃণালিনী, রেণুকা এই তিন নারীর মৃত্যূশোক তাঁর পারিবারিক বন্ধনকে যেন আরো আলগা করে দিল। পরিবারের মায়া কাটিয়ে বিশ্বের দরবারে তখন তাঁর ক্রমশ আবির্ভূত হওয়ার পালা। পঞ্চাশতম জন্মদিনে আশ্রমবাসিরা রবীন্দ্রনাথকে আগে থেকে না জানিয়ে মহাসমারোহে জন্মদিন পালন করলেন। কবি এতটাই আপ্লুত হয়েছিলেন যে আনন্দবাজার পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক প্রফুল্লকুমার সরকারের স্ত্রী নির্ঝরিণী সরকারকে চিঠি লিখে জানালেন তাঁর সেই খুশির কথা। এরপর তাঁর মুকুটে সাহিত্যে এশিয়ার প্রথম নোবেল পুরস্কার জুটল। তখন তিনি বিশ্বকবি। স্বভাবতই জন্মদিন পালনের ঢেউ সাত সমুদ্র তের নদী পেরিয়ে আছড়ে পড়ল দেশ-বিদেশের মাটিতে।
দেখতে দেখতে কবিকে এক নতুন ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখা গেল। ইন্দিরাদেবীকে ১৯৩০ সালের ২৬ এপ্রিল জানালেন তাঁর সেই নবরূপের কথা। সদ্য ৭০ বছরে পদার্পণ করা কবি লিখেছিলেন, ‘ধরাতলে যে রবিঠাকুর বিগত শতাব্দীর ২৫শে বৈশাখ অবতীর্ণ হয়েছেন তাঁর কবিত্ব সম্প্রতি আচ্ছন্ন তিনি এখন চিত্রকর রূপে প্রকাশমান।’ আর্জেন্টিনীয় সখা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর বদান্যতায় প্যারিসের ‘গ্যালারি পিগ্যালে’ কবির আঁকা ১২৫-টি ছবির প্রদর্শনী শুরু হয় মে মাসের দুই তারিখ। সুদূর প্যারিস থেকে চিত্রকর রবীন্দ্রনাথ, নির্মলকুমারী মহলানবিশকে লিখলেন যে চিঠি সেখানে বাহিরমহলের রবীন্দ্রনাথকেই তিনি মান্যতা দিচ্ছেন। জন্মদিনের দিন লিখছেন, ‘এখানে যে রবীন্দ্রনাথ আছে সে এখানকার উপকরণ নিয়ে নিজেকে একটা সম্পূর্ণতা দিয়েছে। তার সঙ্গে পঁচিশে বৈশাখের রবি ঠাকুরের মিল হবে না। দেশে ফিরে গেলে তবে আমি তাকে ফিরে পাব, সেখানকার সবকিছুর সঙ্গে।’ এও স্পষ্ট করে উচ্চারণ করেছেন, ‘ আমার বিশ্বপ্রকৃতি আছে সমুদ্রের ওপারে, মানব-প্রকৃতি আছে এপারে।’ এরপর দেশে ফিরে এলে তাঁর জন্মদিন পালন প্রথম জাতীয় উৎসবে পরিণত হল। কলকাতার টাউন হলে সপ্তাহব্যাপী রবীন্দ্র-জয়ন্তী পালিত হল ‘ঠাকুর সপ্তাহ’ শিরোনামে। পূজার ছলে ভুলে থাকার আয়োজনের বোধহয় সেই শুরু! এতবড় আয়োজনে অনেক মনোমালিন্য ভুল বোঝাবুঝি দেখা দিল। কবি অমল হোমকে হতাশার কথা জানালেন, ‘অনেক পাপের জন্যই বাংলাদেশে জন্মেছি, তাই আজ সত্তর বছরে পুণ্য অর্জনে লেগে গিয়েছি মহা আড়ম্বরে জন্মোৎসব সম্বর্ধনায়।’
কবির বয়স বাড়ছে। শান্তিনিকেতনে তখন প্রচণ্ড দাবদাহ। গ্রীষ্মাবকাশের ছুটির কারণে পঁচিশে বৈশাখ নাগাদ আশ্রম চত্বর খাঁ খাঁ করে। কবির সম্মতি নিয়েই আশ্রমিকরা ঠিক করেন ১৯৩৬ সালের নববর্ষের দিন বর্ষবরণের পর কবির জন্মদিন পালন করা হবে। উদারমনা কবি এই প্রস্তাবকে সাদরে গ্রহণ করলেন। এরপর থেকে নববর্ষের দিনই শান্তিনিকেতনে কবির জন্মদিন পালিত হত। এমনকী ১৯৪১ সালের পয়লা বৈশাখেও পঁচিশের শঙ্খধ্বনি বেজেছিল। নাতি সৌমেন্দ্রনাথের দাবি রক্ষায় কবি লিখলেন মানবের জয়গান, ‘ঐ মহামানব আসে’। পরদিন ১৫ এপ্রিল আনন্দবাজার পত্রিকায় খবর ছাপা হল, ‘সূর্য্যোদয়ের কিঞ্চিৎ পূর্ব্বে মন্দিরে উপাসনা আরম্ভ হয়। অধ্যাপক ক্ষিতিমোহন সেন আচার্য্যের আসন গ্রহণ করেন।...অনুষ্ঠানে কয়েকটি সঙ্গীত গান করা হয়। ইহার মধ্যে দুইটি কবিগুরু কর্ত্তৃক এই অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে বিশেষভাবে রচিত — ‘হে পুরুষোত্তম’ এবং ‘এস হে মহামানব’। (ঐ মহামানব আসে)। সেদিন রবীন্দ্রনাথের জন্মোৎসবের ভাষণ ছিল ‘সভ্যতার সংকট’।
ঋণ: রবীন্দ্রজীবনী (১ম - ৪র্থ খণ্ড) - প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, রবিজীবনী (১ম - ৯ম খণ্ড) - প্রশান্তকুমার পাল, রবীন্দ্রস্মৃতি - ইন্দিরাদেবী চৌধুরানী, জীবনের ঝরাপাতা - সরলাদেবী, ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল - চিত্রা দেব, চিঠিপত্র ( ১ম - ১৮তম খণ্ড ) - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জন্মদিনে রবীন্দ্রনাথ - কৃষ্ণপ্রিয় দাশগুপ্ত, অধ্যাপক অর্মত্য মুখোপাধ্যায়।
লেখক রবীন্দ্র গবেষক ও সাহিত্যকর্মী, মতামত নিজস্ব