শান্তিনিকেতনে মাধবীবিতানে চলছে জগদানন্দের ক্লাস।
রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন তিরিশ বছর। পৈত্রিক জমিদারি তদারকি করার জন্য স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের নিয়ে শিলাইদহে বসবাস করছেন। সেখানে গিয়ে তিনি পড়লেন এক গুরুতর সমস্যায়। দেখলেন, সেখানে ছেলেমেয়েদের শিক্ষাদানের জন্য উপযুক্ত কোনও বিদ্যালয় নেই। ওই সমস্যার আশু সমাধানে নিজের বাড়িতেই ছেলেমেয়েদের বিদ্যাশিক্ষা দেওয়ার জন্য খুলে ফেললেন গৃহবিদ্যালয়। সেই বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য তিনি যে কয়েক জন শিক্ষক নিয়োগ করেছিলেন, তাঁদেরই এক জন হলেন গণিত ও বিজ্ঞানের শিক্ষক জগদানন্দ রায়। কৃষ্ণনাগরিক।
জগদানন্দ রায় আজ থেকে দেড়শো বছর আগে ১২৭৬ বঙ্গাব্দের ৩ আশ্বিন (ইংরাজি ১৮ সেপ্টেম্বর, ১৮৬৯ সাল) কৃষ্ণনগরের রায় পাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা অভয়ানন্দ রায় ছিলেন নদিয়ারাজের আত্মীয় এবং জমিদার বংশের সন্তান। জগদানন্দের বাবা অভয়ানন্দের পূর্বপুরুষ চন্দ্রশেখর মুখোপাধ্যায় ছিলেন মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের বোন যজ্ঞেশ্বরী দেবীর স্বামী। শৈশবে জগদানন্দ কৃষ্ণনগরেই তাঁর শিক্ষা সম্পূর্ণ করেন। এর পর ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে তিনি বিএ পাশ করেন। যদিও বর্তমানে বিএসসি বলে বিজ্ঞানের যে শাখা রয়েছে, সেই সময় এই ভাগটি ছিল না। বিজ্ঞান ছিল জগদানন্দের প্রিয় বিষয়। তিনি ‘শুক্রভ্রমণ’ প্রবন্ধে বলেছিলেন ‘‘বাল্যকাল হইতে বিজ্ঞানচর্চ্চায় আমার বড় আমোদ, এ জন্য বহুচেষ্টায় কতকগুলি বিজ্ঞানগ্রন্থ এবং পুরাতনদ্রব্য-বিক্রেতার দোকান হইতে দুই চারিটি জীর্ণ বৈজ্ঞানিক যন্ত্রও সংগ্রহ করিয়াছিলাম। একটি ভগ্ন পরকলা দাগী হাত দূরবীন, একটি ক্ষুদ্র আনিরয়েড্ ব্যারোমিটার এবং দুইটি ছোটবড় তাপমানযন্ত্র আমার বৈজ্ঞানিক গবেষণার অবলম্বন ছিলো; এতদ্ব্যতীত একটি তন্ত্রীহীন বৈদ্যুতিক ঘণ্টা, কয়েকটি কাচের নল, একটি সচ্ছিদ্র ইনকানডেসান্ট বৈদ্যুতিক দীপ, একটি বুনসেনের সেল্ এবং কয়েক হাত রেশম-মোড়া তার ইত্যাদিও সংগ্রহ ছিলো। আমার একটি বিজ্ঞানানুরাগী বন্ধুর সাহায্যে অবকাশকাল সুখেই কাটিত।’’
কলেজে পড়ার সময় থেকেই তিনি তৎকালীন বিভিন্ন সাময়িক পত্রপত্রিকায় বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ লিখতে শুরু করেন। এই সময় ‘সাধনা’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ‘সাধনা’ পত্রিকায় জগদানন্দের লেখা ছাপা হলে, তাঁর সহজ-সরল ভাষায় উৎকর্ষীয় লেখার গুণে তিনি কবিগুরুর নজরে পড়ে যান। জগদানন্দের লেখা পড়ে রবীন্দ্রনাথ পরবর্তী কালে তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন—‘‘আমি তখন ছিলাম ‘সাধনা’র লেখক এবং পরে তার সম্পাদক। সেই সময়ে তার সঙ্গে আমার পরিচয়ের সূত্রপাত। ‘সাধনা’য় পাঠকদের তরফ থেকে বৈজ্ঞানিক প্রশ্ন থাকতো। মাঝে মাঝে আমার কাছে তার এমন উত্তর এসেছে, যার ভাষা স্বচ্ছ সরল— বৈজ্ঞানিক প্রসঙ্গে এমন প্রাজ্ঞল বিবৃতি সর্বদা দেখতে পাওয়া যায় না। পরে জানতে পেরেছি, এগুলি জগদানন্দের লেখা। তিনি তাঁর স্ত্রীর নাম দিয়ে লেখা পাঠাতেন। একদিন যখন জগদানন্দের সঙ্গে পরিচয় হলো তখন তার দু:স্থ অবস্থা এবং শরীর রুগ্ন। আমি তখন শিলাইদহে বিষয়কর্মে রত। সাহায্য করিবার অভিপ্রায়ে তাঁকে জমিদারি কর্মে আহ্বান করলাম।.... মনে আক্ষেপ হলো— জমিদারি সেরেস্তা তাঁর উপযুক্ত কর্মক্ষেত্র নয়।.... তখন তাঁকে অধ্যাপনার ক্ষেত্রে আহ্বান করে নিলুম শান্তিনিকেতনে।’’
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে যখন তাঁর দেখা হয় তখন তাঁর দুঃস্থ হওয়ার কারণ হল জগদানন্দের পিতৃবিয়োগ। জমিদার বাড়ির ছেলে হয়েও পিতৃবিয়োগের ফলে তাঁর পরিবার প্রবল অভাব অনটনে দিন কাটাচ্ছিল। এর কারণ ছিল তাঁর বাবার দিলদরিয়া মেজাজ। তাঁর পিতৃদেব আয়ের থেকে ব্যয় বেশি করে ফেলতেন। এই স্বভাবের জন্য জীবিতকালেই তিনি তাঁর পৈত্রিক সম্পত্তি শেষ করে ফেলেছিলেন। এর পর যখন তাঁর মৃত্যু হয় তখন সংসারের সমস্ত ভার এসে পড়ে বড় ছেলে জগদানন্দের উপর। সংসারকে সচল রাখার অভিপ্রায়ে প্রথমে তিনি গোয়াড়িতে এক মিশনারি শিক্ষকতার কাজে যোগদান করেন। এখানে তাঁকে বেশিদিন থাকতে হয়নি। কিছু দিন পরেই রবীন্দ্রনাথের ডাকে চলে যেতে হয় শিলাইদহে, জমিদারি সেরেস্তার কাজে নিয়োগ হন আর শিলাইদহের গৃহবিদ্যালয়ে রবীন্দ্রনাথের ছেলেমেয়েদের গণিত ও বিজ্ঞানের পাঠ দেন। কিছুদিন বাদে রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পারেন জগদানন্দ যে মেধার অধিকারী, তাতে তাঁর সেরেস্তার কাজ উপযুক্ত নয়।
১৯০১ সালে ২২ ডিসেম্বর যখন শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রম গঠিত হলে সেখানে তিনি জগদানন্দকে বিজ্ঞান ও গণিতের অধ্যপক রূপে নিয়োগ করেন। ব্রহ্মচর্যাশ্রমে যোগদানের পর জগদানন্দ তাঁর পড়াশোনার জগতে ফিরে এসে দ্বিগুণ উৎসাহে ছাত্রদের পাঠ দিতে শুরু করেন। শিক্ষার্থী রূপে পেলেন রবীন্দ্রনাথের পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুধীরকুমার নান, গিরিন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, গৌরগোবিন্দ গুপ্ত এবং প্রেমকুমার গুপ্ত নামে পাঁচ জন আশ্রমিক বালককে। পরবর্তীকালে ‘পিতৃস্মৃতি’ গ্রন্থে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর বিজ্ঞান শিক্ষককে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে লিখেছিলেন— ‘‘সবচেয়ে ভালো লাগতো যখন জগদানন্দবাবু বিজ্ঞান পড়াতেন।.... গল্পচ্ছলে বিজ্ঞানের কথা বলার আশ্চর্য ক্ষমতা ছিলো জগদানন্দবাবুর। তারপর যখন যন্ত্রের সাহায্যে কোনো পরীক্ষা দেখাতেন, তখন আমরা মুগ্ধ হয়ে সেই দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকতুম। প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতুম, আমাদের কৌতুহল যতই অবান্তর হোক না, তিনি বিরক্ত হতেন না, হাসি মুখে সব প্রশ্নের জবাব দিতেন। হুগলির এক ভদ্রলোক নিজের হাতে টেলিস্কোপ তৈরী করেছেন শুনে বাবা তার কাছ থেকে একটি তিন ইঞ্চি টেলিস্কোপ তিনশো টাকা দিয়ে কিনে জগদানন্দবাবুকে দিলেন। এটি তাঁর খেলার জিনিস হলো। রাত হলেই তিনি টেলিস্কোপ নিয়ে বসে থাকতেন, কোনো গ্রহ নক্ষত্র দেখতে পেলেই আমাদের দেখে তা দেখাতেন।’’ জগদানন্দ রায়ের আরেক ছাত্র নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মাষ্টারমশাইয়ের স্মৃতিচারণায় বলেছেন— ‘‘খড়্গাকৃতি বক্রনাসা, চোখেমোটা কাঁচের চসমা, ঈষৎ চাপা দুই ঠোঁট, বিরক্তিপূর্ণ ভ্রুভঙ্গী এবং মোটা কম্বলের মতো এক গরম চাদর মুড়ি দিয়ে বসিবার ভঙ্গী---এই সমস্ত মিলিয়া বালকপ্রাণে যে অনুভূতির উদ্রেক হইয়াছিলো, তাহা নিতান্ত ভয়ংকর।’’ তিনি তাঁর শিক্ষকের ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে আরও বলেছেন— ‘‘মাষ্টারমশাইয়ের প্রতি ভয় শান্তিনিকেতন থাকিতে সম্পূর্ণ দূর হয় নাই। কিন্তু তাহার স্নেহের যে পরিচয় ক্রমশ পাইতে লাগিলাম তাহা পূর্বের অপরিচয়ের ভীতি অল্পদিনেই শ্রদ্ধায় পরিণত করিয়া দিলো। ভয় ও ভালোবাসার সংমিশ্রণে তাঁহার সহিত অপূর্ব সমন্ধের সৃষ্টি হইল।.... জগদানন্দবাবু শান্তভাবে লোকচক্ষুর অন্তরালে বাস করিতে ভালোবাসিতেন.... অথচ আশ্রম বালকদের সকল অভাব অনুযোগ ইত্যাদির খুঁটিনাটির তত্ত্বাবধানের ভিতর দিয়া এই দূরের মানুষটিই সকলের অন্তরের অতি কাছাকাছি বাসা বাঁধিয়াছিলেন।’’
ব্রক্ষচর্যাশ্রমে পড়ানোর অবকাশে জগদানন্দ কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথকে এন্ট্রান্স পরীক্ষার জন্য দিনের বেলায় কিছু ক্ষণের জন্য গণিত এবং সন্ধ্যাবেলায় হক্রালির বিজ্ঞানের ছোট বই পড়াতেন। এক দিন তিনি কবিপুত্রকে সন্ধ্যার সময় বিজ্ঞান পড়াচ্ছিলেন। অন্য বিষয়ের শিক্ষকেরা এন্ট্রান্সের জন্য রথীকে ইংরাজিতে পড়াতেন। সেটাকে অনুকরণ করে যখন জগদানন্দও রথীকে ইংরাজিতে পাঠ দিতে লাগলেন। তিনি ইংরাজিতে কত ভুল বলছেন বুঝতে পারলেন তখন, যখন রবীন্দ্রনাথ রথীকে বাংলায় পড়াতে বললেন। নিজের ভুল যখন জগদানন্দ বুঝতে পারলেন, তার পর থেকে আর কোনও দিন কখনও কোনও ছাত্রকে তিনি আর ইংরাজিতে পড়াননি।
(চলবে)
ঋণ: জগদানন্দ রায়: বিশ্বভারতী
উদ্ধৃতির ভিতরে বানান অপরিবর্তিত
শান্তিপুর হরিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক