ফাইল চিত্র।
সুপ্রিম কোর্টের নিষেধ সত্ত্বেও অসাধু কাঠ ব্যবসায়ী, লোভী বনকর্মী এবং এলাকাবিশেষে বেশ কিছু কেষ্ট-বিষ্টুর স্বার্থের বন্দোবস্তের পরিণামে সুন্দরবনে বহু দিন ধরেই চলছে অবাধ বৃক্ষচ্ছেদন। এ অঞ্চলে রয়েছে দুর্লভ কিছু গাছ যেমন— ধুধুঁল, পশুর, গরান, হেঁতাল, শাল, সেগুন। নিয়মিত ভাবে এই সব গাছ কাটার ফলে পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য আজ বিপন্ন। এবং এ ভাবে চলতে থাকলে অচিরেই হয়তো এটি ধ্বংসের পথে এগিয়ে যাবে।
চোখের সামনে এই যে বৃক্ষনিধন-পর্ব চলছে, তা নিয়ে প্রশাসনের কোনও উদ্বেগ নেই কেন? কেন নেই কোনও কড়া শাসন? তারা কি জেগে ঘুমোচ্ছে?
সুন্দরবনের অমূল্য বনসম্পদের এই হাল হওয়ায় পরিবেশের ভারসাম্যও নষ্ট হচ্ছে। এর ফলও হাতে হাতে মিলছে। দেখা যাচ্ছে, এখানে আছড়ে পড়ছে একের পর এক ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়। আবহাওয়ার পরিবর্তনের জেরে জলোচ্ছ্বাস বাড়ছে।
পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ এলাকা সুন্দরবনের নাম সমগ্র বিশ্বের কাছে সুপরিচিত ও আকর্ষণীয়। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এখানকার পরিবেশ পরিস্থিতির পরিবর্তন হচ্ছে। সেটা সাধারণ মানুষের কাছে অজানা থেকে যাচ্ছে। বিশেষ সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, উনিশ শতকের প্রথম ভাগের জরিপ অনুযায়ী, সুন্দরবনের আয়তন ৯৬৩০ বর্গ কিলোমিটার। যার বিস্তার দক্ষিণবঙ্গের নিম্ন প্রান্ত দক্ষিণ ২৪ পরগনার কাকদ্বীপ থেকে উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাট পর্যন্ত। দীর্ঘদিন ধরে এ অঞ্চলে জনবসতি গড়ে ওঠায় এখানকার আদি বনভূমির অনেকটাই নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। ৫৩৬৬ বর্গ কিলোমিটার জঙ্গল আগেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। বাদবাকি ৪২৬৪ বর্গ কিলোমিটারের মধ্যে ৪১ ভাগ জল। তবে, সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, জলের এলাকার অনুপাত বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৫০ শতাংশে। অর্থাৎ, বনভূমি রইল মাত্র ২০০০ বর্গ কিলোমিটারের কিছু বেশি।
পশ্চিমবঙ্গের বন দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, সুন্দরবন থেকে কাঠ কাটার জন্য কম-বেশি ৩৪০টির মতো নৌকাকে লাইসেন্স দেওয়া হয়ে থাকে। এবং এ জন্য বারো-তেরো হাজার টন কাঠ কাটার অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবে নির্দিষ্ট এই পরিমাণের থেকে একশো গুণ বেশি কাঠ চোরাপথে জঙ্গল থেকে কেটে নিয়ে আসছে এক ধরনের অসাধু চক্র। এই চক্রগুলি বিশেষ করে ধ্বংস করছে বিরল প্রজাতির বিভিন্ন গাছ। যদিও ওই সমস্ত গাছ কাটা নিষিদ্ধ। আকাশ ছোঁয়া দামের জন্য শাল-সেগুন কাঠের ব্যবহার আজ সাধারণ মানুষের আয়ত্তের বাইরে। সুন্দরবন এলাকার বসিরহাট, হিঙ্গলগঞ্জ, সন্দেশখালি, গোসাবা, স্যান্ডেলের বিল, শামসেরনগর, বাসন্তী, ঝড়খালি প্রভৃতি স্থানের হাটে গেলে দেখা যাবে, প্রচুর পরিমাণে বড় বড় গাছের গুঁড়ি সেখানে বিক্রি হচ্ছে। গাছগুলি বিক্রি হয়ে চলে যাচ্ছে এলাকার কাঠ চেরাই কলগুলিতে। তারপর সেগুলি থেকে নানারকম আসবাবপত্র তৈরি হয়ে চলে যাচ্ছে কলকাতার বড় বড় আসবাবের দোকানে। এ বিষয়ে গ্রামবাসীদের অভিযোগ, এই কাজে এক শ্রেণির বনকর্মী, পুলিশ এবং রাজনৈতিক দলের কেষ্ট-বিষ্টুদের প্রত্যক্ষ মদত রয়েছে। জানা গিয়েছে, সুন্দরবন এলাকার মূল্যবান কাঠ পাচারের বিষয়ে একটি অত্যন্ত শক্তিশালী দুষ্ট চক্র বরাবরই সক্রিয় রয়েছে। এই বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ফরেস্ট রেঞ্জ অফিসার অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করে নিয়ে জানান, এত বিশাল অরণ্য পাহারা দেওয়ার জন্য যথেষ্ট সংখ্যক বনকর্মীর অভাব রয়েছে। এ দিকে, নির্বিচার অরণ্য ধ্বংসের ফলে বাঘেদের নিরাপদে থাকার জায়গার পরিমাণও কমছে। ফলে এরা নদী সাঁতরে ঢুকে পড়ছে লোকালয়ে। হিঙ্গলগঞ্জের কৃষিজীবী বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, বাঘের হামলার ভয়ে প্রায় প্রতি রাতেই তাঁদের আলো নিয়ে বাড়ি-ঘর পাহারা দিতে হয়।
বসিরহাট, হাসনাবাদ, হিঙ্গলগঞ্জ, টাকি প্রভৃতি গ্রামীণ এলাকায় প্রচুর পরিমাণে খেজুর গাছ রয়েছে। এই খেজুর গাছ থেকে শীতকালে প্রচুর পরিমাণে উন্নত মানের সুস্বাদু খেজুর রস পাওয়া যায়। এর থেকে পাটালি গুড়, মিষ্টি তৈরি হয়। কিন্তু এক ধরনের অসাধু চক্রের হাতে পড়ে এই সব খেজুর গাছগুলি কেটেছেঁটে চলে যাচ্ছে স্থানীয় ইটভাটাগুলিতে। ইটভাটায় ভাল জ্বালানি হিসেবে খেজুর গাছের বিশেষ চাহিদা রয়েছে। এ দিকে দীর্ঘদিন ধরে অবলীলায় খেজুর গাছ কেটে নেওয়ার ফলে টাকির বিখ্যাত পাটালি গুড়ের অভাব দেখা যাচ্ছে। এ দিকে, ওয়াকিবহাল মহল মাত্রেই জানে, সুপ্রিম কোর্টের নিষেধ আছে, অপরিণত গাছ কাটা যাবে না। অথচ বসিরহাটের রাস্তার ধারে ধারে দেখা যায়, এই ধরনের গাছগুলি সারিবদ্ধ অবস্থায় পড়ে আছে। কারও কোনও প্রতিবাদ নেই!
এ বার কিন্তু আমাদের সচেতন হওয়ার সময় এসে গিয়েছে। এ বার আমরা একেবারে খাদের ধারে চলে এসেছি। এখনই সচেতন হলে হয়তো তবুও খানিকটা প্রাকৃতিক সম্পদ বাঁচাতে পারব। এই সময়টা চলে গেলে তখন আর বিপদের শেষ থাকবে না। আঙুল কামড়ানো ছাড়া কিছু করারও থাকবে না!