পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাব্যবস্থার একটি ঐতিহ্যপূর্ণ স্বকীয় ইতিহাস রয়েছে। ভারতীয় সংবিধানের ৪২তম সংশোধনের (১৯৭৬) দ্বারা শিক্ষাকে যুগ্ম তালিকায় অন্তর্ভুক্তির পর থেকে জাতীয় শিক্ষানীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রেখে রাজ্য সরকার রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জন করতে সক্ষম হয়েছে।
সেই সক্ষমতার সুবাদে বিভিন্ন সময়ে রাজ্য সরকার বিভিন্ন শিক্ষা কমিটি ও কমিশন গঠন করেছে। যার মূল কাজ ছিল তৎকালীন শিক্ষা ব্যবস্থার মূল্যায়ন করে শিক্ষা সংক্রান্ত প্রস্তাব পেশ করা। সংস্কার প্রস্তাবের বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থায় কিছু স্বতন্ত্রতা বজায় রাখা। আর এই স্বতন্ত্রতা বজায় রাখার উদ্দেশ্য নিয়ে মূলত পাঠক্রমের কাঠামোগত ও বিষয়গত পরিবর্তন, পরীক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার এবং পাঠ্যপুস্তকের প্রকাশনা ও বণ্টনকে সুষম করার প্রস্তাব পেশ করা হয়েছিল।
শিক্ষার্থীর সংখ্যার নিরিখে ভারতে উচ্চ শিক্ষাক্ষেত্র বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম উচ্চ শিক্ষাক্ষেত্র। আর ভারতের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের স্থান চতুর্থ। উচ্চশিক্ষা বলতে আমরা বুঝি, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকে এবং গবেষণা কেন্দ্রগুলির শিক্ষাকে। দ্বাদশ শ্রেণি বা ইন্টারমিডিয়েট পর্যায়ের পাঠ শেষ করে এক জন শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার প্রাঙ্গণে পা রাখে। উচ্চশিক্ষার প্রথম ধাপে তিন বছর বা চার বছর বা পাঁচ বছর পড়াশোনা করার পর শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি ডিগ্রি পায়। এবং তাকে একটি শংসাপত্র দেওয়া হয়। জ্ঞানের প্রসারে এবং গভীরতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় এক গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। তাই শিক্ষার সামগ্রিক মান উন্নত করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা অপরিসীম।
এক একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা ব্যবস্থা, মোট নম্বর ও সিলেবাস এক এক রকম। কোনও কোনও বিশ্ববিদ্যালয় আবার মূল্যায়নের ক্ষেত্রে গ্রেড সিস্টেম চালু করেছে। সে ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্যে সামঞ্জস্য থাকা অত্যন্ত জরুরি। বরাবরই পশ্চিমবঙ্গ ভারতের শিক্ষা ক্ষেত্রে একটি সম্মানজনক জায়গা অধিকার করতে সক্ষম হয়েছিল। এর মূলে ছিল শিক্ষার্থীদের জ্ঞানদানের ক্ষেত্রে এবং জ্ঞান আহরণের ক্ষেত্রে একটি সুনির্দিষ্ট মান বজায় রাখা। এই মান বজায় রাখতে গিয়ে মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় যে কঠোরতা অবলম্বন করা হয়েছিল, তার বিরুদ্ধে এক সময়ে প্রবল ঝড় উঠতে শুরু করে। অন্য রাজ্যের বোর্ড বা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল্যায়নের উদাহরণ তুলে ধরে পশ্চিমবঙ্গের মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার সমালোচনা করা হয় এবং সমগ্র দেশের জন্য একটি ইউনিফর্ম মূল্যায়ন মান বজায় রাখার দাবি জানানো হয়। যুক্তি দেখানো হয়, মূল্যায়নে কঠোরতার দরুন পশ্চিমবঙ্গের ছাত্রছাত্রীরা সর্বভারতীয় পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে অনেকাংশে ব্যর্থ হচ্ছে। তাদেরকে বঞ্চিত বঞ্চিত করা হচ্ছে। ফল হিসেবে আমরা দেখতে পেলাম পশ্চিমবঙ্গ নম্বরের ইঁদুর দৌড়ে অংশগ্রহণ করল। মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে কেবলমাত্র সর্বশেষ বছরের সিলেবাসের উপর চূড়ান্ত পর্বের পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা করা হল। যাতে ছাত্র-ছাত্রীদের বোঝা হালকা হয় এবং তারা পরীক্ষায় বেশি বেশি নম্বর পায়। একই যুক্তিতে রাজ্যের কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের বোঝা হালকা করল স্নাতকোত্তর পর্যায়ে সেমিস্টার সিস্টেম চালু করে। সেমিস্টার সিস্টেমের পক্ষে যে যুক্তিই দেখানো হোক না কেন, তা শিক্ষার্থীর পরীক্ষার বোঝা হালকা করে বেশি বেশি নম্বর পাওয়ার সুযোগ করে দেবে। বিদ্যালয় ও কলেজ স্তরে শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষায় এমসিকিউ টাইপের প্রশ্নের অনুপ্রবেশ যে বোঝা কমানোর পদক্ষেপের অনুসারী পদ্ধতি, তাতে কোনও সংশয় নেই ।
বর্তমানে আবার স্নাতক পর্যায়ে সব বিশ্ববিদ্যালয় সেমিস্টার পদ্ধতিতে সিবিসিএস (চয়েস বেসড ক্রেডিট সিস্টেম) আবশ্যিক করা হয়েছে। এতে করে শিক্ষার্থীর পরীক্ষার বোঝা যে আগের তুলনায় আরও কমিয়ে দেওয়া হল, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এমন ভাবে বোঝা হালকা করে নম্বর বেশি পাওয়ার সুযোগ করে দিলে তা যে সামগ্রিক শিক্ষামানের অবনমন ঘটাবে, সেদিকটা একেবারে উপেক্ষিত থেকে গেল।
শিক্ষা ব্যবস্থার প্রকৃত লক্ষ্য নম্বর পাওয়া নয়। প্রকৃত লক্ষ্য হল এমন জ্ঞান অর্জন করা যা সারা জীবন ধরে শিক্ষার্থীকে তার অভিজ্ঞতার পুনর্গঠনে সাহায্য করবে। উচ্চশিক্ষায় প্রবেশের পূর্ববর্তী স্তরের শিক্ষা সংস্কার উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করে। উপযুক্ত পরিকাঠামো সৃষ্টি না করে কমিটি বা কমিশনের সুপারিশ কার্যকর করার মধ্যে দিয়ে আদতে ছাত্রছাত্রীদেরকে গিনিপিগ বানানো হচ্ছে। যার ফল ছাত্রসমাজকেই ভুগতে হচ্ছে এবং হবে।
সেমিস্টার পদ্ধতিতে গৃহীত নতুন সিবিসিএস (চয়েস বেসড ক্রেডিট সিস্টেম) এক দিকে যেমন পরীক্ষার বোঝা কমিয়েছে, অন্য দিকে তেমনই উপযুক্ত পরিকাঠামোর অভাবে ছাত্রছাত্রীদের কাছে খুব সীমিত চয়েস ওপেন রাখতে পেরেছে। ফলে, সিবিসিএস-এর প্রকৃত উদ্দেশ্য সিদ্ধ হচ্ছে না। বস্তুতপক্ষে যা ঘটছে তা হল— ওল্ড ওয়াইন ইন নিউ বটল। বিভিন্ন সময়ে গঠিত কমিশনগুলির অধিকাংশই বিদেশে সফল ভাবে প্রচলিত পদ্ধতির প্রতি প্রগাঢ মোহান্ধতাবশত সেগুলিকে আমাদের দেশে প্রয়োগ করার সুপারিশ করেছেন। আর সরকার অন্ধ ভাবে সেগুলিকে আমাদের দেশে প্রয়োগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তার জন্যে যে পরিকাঠামো প্রয়োজন, সে দিকে নজর দেয়নি বা দিলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। পরে যখন সেই সিদ্ধান্ত উপযুক্ত ছিল কিনা তা বিশ্লেষণ করা হয়েছে, তখন দেখা গিয়েছে যে ওই সিদ্ধান্তের ফলে শিক্ষার মানের উন্নয়ন তো ঘটেইনি, বরং মানের অবনমন ঘটেছে। ততক্ষণে উপলব্ধি করা গেল যে এক প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীরা ইতিমধ্যেই গিনিপিগ হয়ে গিয়েছে।
সংস্কার অবশ্যই প্রয়োজন। একটি প্রচলিত ব্যবস্থা আবহমানকাল ধরে চলতে পারে না। তবে তার সংস্কারের জন্য চাই উপযুক্ত পরিকাঠামো প্রদান করে সুপরিকল্পিত যুক্তিনির্ভর প্রস্তাবের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন। অন্যথায় তা হয়ে ওঠে ভীষণ রকম আত্মঘাতী। যার ফল ভুগতে হয় ছাত্রসমাজকে।
কৃষ্ণনগর উইমেন্স কলেজের অর্থনীতির অধ্যাপক