বিদ্যালয়ে কেমন শিক্ষা পাইবার কথা, আর কী শিক্ষা পাইতেছে শিশুরা? গত দুই সপ্তাহে কলিকাতার বিভিন্ন স্কুলের দিকে তাকাইলে প্রশ্নটি পীড়া দিবে। পূর্ব সিঁথির একটি বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রীরা শিক্ষিকাদের প্রবেশ করিতে দেয় নাই। অভিযোগ, বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন, শৌচাগারে জল নাই। বাগুইআটির একটি বালিকা বিদ্যালয়ে ছাত্রী ও অভিভাবকদের অভিযোগ, মিড-ডে মিল খাইয়া অসুস্থ হইয়াছে শিশুরা। দমদমের একটি স্কুলে মস্ত বিজ্ঞাপন টাঙানো হইয়াছে, রাজ্যসভায় এক ব্যক্তিকে মনোনীত করিবার জন্য মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাইয়া। এগুলি কেবল শৃঙ্খলাহীনতার পরিচয় নহে। অনুসন্ধানে প্রকাশ দুইটি বিষয়। এক, অনেক ক্ষেত্রে সমস্যা ও তাহা লইয়া অভিযোগ দীর্ঘ দিনের। যথাসময়ে প্রতিকার না করিবার জন্য তাহা আরও জটিল এবং দুঃসাধ্য হইয়াছে। দুই, তিনটি ঘটনাতেই স্কুল কর্তৃপক্ষের সহিত, বিশেষত প্রধান শিক্ষকদের সহিত অপর শিক্ষকদের, অথবা স্কুল ম্যানেজমেন্ট কমিটির সদস্যদের দূরত্ব বা সংঘাত সম্মুখে আসিয়াছে। স্কুলে শৃঙ্খলা বজায় রাখিবার চেষ্টা করিবার জন্যই অপরাপর শিক্ষকেরা প্রধান শিক্ষকের বিরোধিতা করিতেছেন, বিশৃঙ্খলা বাধাইতেছেন, এমন অভিযোগ উঠিয়াছে। ইহা অতি ভয়ানক পরিস্থিতি। ইহাতে ইঙ্গিত মেলে, খাস কলিকাতায় স্কুল পরিদর্শনে বিস্তর শিথিলতা রহিয়াছে। প্রশাসকের সহিত স্কুল কর্তৃপক্ষ, এবং স্কুল কর্তৃপক্ষের সহিত শিক্ষকদের দূরত্ব বাড়িতেছে। পরস্পর অনাস্থা এবং ভীতিপ্রদর্শন বিদ্যালয়ের পরিবেশ দূষিত করিতেছে।
স্কুল কর্তৃপক্ষ এবং শিক্ষকদের উপর এমন অনাস্থা, এবং তজ্জনিত অশ্রদ্ধার বিষবৃক্ষে নিত্যনূতন বিষফল জন্মাইতেছে। অভিভাবক এবং পড়ুয়াদের একাংশ বেপরোয়া হইয়া উঠিয়াছেন। কয়েকটি বেসরকারি স্কুলে ছাত্রীদের যৌন হেনস্তার অভিযোগ তুলিয়া অভিভাবকরা ভাঙচুর, মারধর করিতেছেন। অভিযুক্তের শাস্তির দাবি করা অন্যায় নহে, কিন্তু নিজেরাই বিচার করিয়া তৎক্ষণাৎ দৈহিক শাস্তি দিবার কাজটি অন্যায়। বাবা-মায়েদের এই কাজ, এবং তাহার সম্মুখে স্কুল কর্তৃপক্ষের নতিস্বীকার দেখিয়া নাবালক সন্তানগুলি কী শিক্ষা লইল, তাহা চিন্তা করিলে শিহরিত হইতে হয়। তাহাদের নিকট এমনই বার্তা পৌঁছাইতেছে যে, জোট বাঁধিয়া কোনও একটি দাবি তুলিয়া প্রায় যে-কোনও অন্যায় করিয়া ফেলা যায়। স্কুলে ঢুকিয়া মারধর, শিক্ষকদের গেটের বাহিরে আটকাইয়া রাখার মাধ্যমে সংবাদমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ না করিলে বিচার হইবে না, চাহিদা মিটিবে না, এমন ধারণাও সম্ভবত কচি মনগুলিতে শিকড় গাঁথিয়া বসিতেছে। শৃঙ্খলা না মানিলেই লাভ অধিক, এই শিক্ষাই তবে দিবে কি স্কুল?
এই সমস্যার মূল দলীয় রাজনীতি। প্রধান শিক্ষকের মতামত তুচ্ছ করিয়া বিদ্যালয়ের প্রধান দরজায় নেতাদের মুখের ছবি দিয়া টাঙানো ব্যানারে তাহারই নির্লজ্জ ঘোষণা। ইতিমধ্যে হাসপাতালে সরকারি চিকিৎসক, সুপাররা গুরুত্ব হারাইয়াছেন। ক্রমশ সরকারি স্কুলে প্রধান শিক্ষক, এমনকী স্কুলের পরিচালকমণ্ডলীর দশাও তথৈবচ। এই দুর্বিনীত, অপরিণামদর্শী নেতারাই কি তবে শিশুদের আদর্শ? শিক্ষা দফতরের পদস্থ ব্যক্তিরা যদি ক্ষুদ্র স্বার্থের উপরে উঠিয়া স্কুলের স্বাতন্ত্র্য ও মর্যাদা রক্ষা না করিতে পারেন, তাহার ক্ষতি সকল বাঙালিকে বহন করিতে হইবে।