কাব্যগ্রন্থের প্রচ্ছদ। নিজস্ব চিত্র
কবি গঙ্গানারায়ণ প্রধান উনিশ শতকের এক কবি। কিন্তু তাঁর নাম খুব বেশি শোনা যায়নি। সাহিত্যের ইতিহাসের তন্নিষ্ঠ পাঠককুলের আলোচনাতেও কবির নাম আলোচিত হতে শোনা যায়নি। স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর ‘কাব্য কদম্ব’ গ্রন্থটিও আলোচনার বাইরে রয়ে গিয়েছে। কিন্তু এই কাব্যগ্রন্থটির প্রকাশ নানা দিক থেকেই উল্লেখযোগ্য হওয়ার দাবি রাখে।
প্রথমে প্রকাশকাল। আজ থেকে প্রায় দেড়শ বছর আগে প্রকাশিত হয়েছিল ‘কাব্য কদম্ব’। বাংলার সন-তারিখ ১২৭৮ বঙ্গাব্দের ১ আষাঢ়। ইংরেজি ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দ। ‘কাব্য কদম্ব’ প্রকাশের আট বছর পরে প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘কবি-কাহিনী’। বয়সেও কবি গঙ্গানারায়ণ রবীন্দ্রনাথের থেকে ১৪ বছরের বড় ছিলেন। তবে বঙ্গাব্দ অনুসারে দুই কবিরই জন্ম ২৫ বৈশাখ। গঙ্গানারায়ণ ছিলেন মেদিনীপুরের ভূমিপুত্র। দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ব্যক্তির যোগ। যাঁদের কয়েকজন উনিশ শতকের বাংলার বিদ্বজ্জন মহলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন। এঁদের একজন হলেন প্রসন্নকুমার সর্বাধিকারী। দ্বিতীয় জন মহেশচন্দ্র ন্যায়রত্ন।
১৯৯০ সাল নাগাদ খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল ‘কাব্য কদম্ব’। হলদিয়া সংগ্রহশালার ‘বিষয় ও বস্তুসংগ্রহ’-এর উদ্যোগে। বইটি পাওয়া যায় হলদিয়া অঞ্চলের দক্ষিণ বৈষ্ণবচক গ্রামের পিনাকী প্রধানের বাড়ি থেকে। বইয়ে উল্লিখিত তথ্য অনুযায়ী, কবির জন্ম ১২৫৪ সালের ২৫ বৈশাখ। দোর দুবনান পরগনার দোর-দেভোগ নামে এক অখ্যাত গ্রামে। যা বর্তমানে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার হলদিয়া ব্লকের অন্তর্গত। ‘কাব্য কদম্ব’-এ মোট ২২টি কবিতা সংকলিত হয়েছে। কাব্যগ্রন্থটি মোট আটচল্লিশ পাতার, ছোট ওয়ান/এইট ডিমাই (সাত ইঞ্চি বাই সাড়ে চার ইঞ্চি) সাইজের। মুদ্রিত হয়েছিল ‘কলিকাতা, পাতরিয়াঘাটা’র ‘সাহিত্যযন্ত্র’ থেকে। মুদ্রক ছিলেন শ্রী কার্ত্তিকচন্দ্র চৌধুরি।
কবি কাব্যটি উৎসর্গ করেছিলেন তাঁর অগ্রজ ইন্দ্রনারায়ণ প্রধানকে। প্রাক-কথন হিসাবে রয়েছে ‘বিজ্ঞাপন’! যা কবির ভাবনা এবং সেই সময়কালকে ধরেছে। ‘বিজ্ঞাপন’ অংশটি এরকম, ‘বহু দিবস অতীত হইল, এই পুস্তকের রচনা কার্য্য সমাধা হইয়াছে...সম্প্রতি কতিপয় পরমাত্মীয় বন্ধুর অলঙ্ঘনীয় প্ররোচনায়, বিশেষতঃ বর্দ্ধমানস্থ মিশনারি বিদ্যালয়ের ভূতপূর্ব্ব পণ্ডিত মৃত দুর্গানন্দ কবিরত্ন মহাশয়ের নিরপেক্ষ উৎসাহে উৎসাহিত হইয়া ইহা জন সমাজে প্রচার করিতে উদ্যত হইয়াছি’। প্রচারের একটি উদ্দেশ্য, যদি বিদ্যালয়গুলোতে কাব্যগ্রন্থটি পাঠ্যপুস্তক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয় তাহলে ‘সমূহ-শ্রমের ভূয়সী সফলতা’ পাবেন কবি। তিনি জানিয়েছেন, বইয়ে স্থান পাওয়া কয়েকটি প্রবন্ধ ইংরেজি থেকে অনুবাদ করা হয়েছে।
কবি গঙ্গানারায়ণ কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেছেন ‘প্রিয় সুহৃদ’ দেভোগ বঙ্গ বিদ্যালয়ের পণ্ডিত ভগবতীচরণ প্রধানের। তিনি রচনাকাজে সাহায্য করেছেন। কোনও কোনও ‘পদ্য স্বয়ং রচনাও করিয়া দিয়াছেন’। বর্ধমানের মহারাজার সংস্কৃত বিদ্যালয়ের অধ্যাপক অঘোরনাথ তত্ত্বনিধি বইয়ের আদ্যোপান্ত দেখে দিয়েছেন। এক বন্ধু বইটি কলকাতার সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ প্রসন্নকুমার সর্ব্বাধিকারীকে পাঠিয়েছিলেন। প্রসন্নকুমার গ্রন্থের কাব্যগুণের প্রশংসাও করে একটি চিঠিও দিয়েছিলেন। কবির বন্ধু ভোলানাথ সেনকে ইংরেজিতে লেখা সেই চিঠিও বইয়ে স্থান পেয়েছে। তিনি কাব্যগ্রন্থটিকে ‘অসাধারণ’ বলেছেন। কিছু সংশোধন করেও দিয়েছিলেন প্রসন্নকুমার। তাঁর পরামর্শ ছিল, সংশোধনগুলো করা হলে বইটি দেশীয় এবং ‘অ্যাংলো-ভার্নাকুলার’ স্কুলে ভাল পাঠ্যবই হয়ে উঠবে। সংস্কৃত কলেজের আরেক অধ্যাপক মহেশচন্দ্র ন্যায়রত্ন পড়ে উৎসাহ দেন।
প্রসন্নকুমার এবং মহেশচন্দ্র দু’জনেই উনিশ শতকের বিদ্বজ্জন মহলে সম্মানিত ব্যক্তি। প্রসন্নকুমারের জন্ম রাজা রামমোহন রায়ের গ্রাম হুগলির রাধানগরে। তিনি সেই সময়ে সাহিত্য এবং বিজ্ঞানচর্চা বিষয়ে বেশ কিছু প্রবন্ধ লিখেছিলেন। আর মহেশচন্দ্র ন্যায়রত্ন ছিলেন হাওড়ার নারিটের বাসিন্দা। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের পরে তিনি সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ হন। পেয়েছিলেন মহামহোপাধ্যায় উপাধি। সুবলচন্দ্র মিত্রের ‘সরল বাঙ্গালা অভিধান’এ মহেশচন্দ্রের সংক্ষিপ্ত জীবনী রয়েছে।
গঙ্গানারায়ণ হঠাৎ কবি ছিলেন না। নিয়মিত সাহিত্যচর্চা করতেন তিনি। এবং কবি ছিলেন অভিজাত বংশের সন্তান। ‘প্রধান গোষ্ঠীর আদি বিবরণ’ থেকে জানা যায়, এই গোষ্ঠী ওড়িশার কটক জেলার বালিবিশ পরগণার বাসিন্দা। পরে ‘গোবর্দ্ধনানন্দ’ নামে এক রাজার আমলে ময়নায় এসে মাসুমচকে বসবাস শুরু করে। প্রধানদের একটি গোষ্ঠী হিজলির পাইক খারিজা জলামুঠায়, বর্তমানে মহম্মদপুরে বসতি গড়ে তোলে। মহম্মদপুরের মধুসূদন প্রধান ছিলেন বহু গুণের অধিকারী। হিজলি রাজার দেওয়ান ভীমসেন মধুসূদনকে ‘নানকর’ পদে নিয়োগ করেছিলেন।
এরও কয়েক যুগ পরে মাজনা মুঠার জমিদার যাদবরাম চৌধুরী, মধুসূদনের বংশধর উদ্ধবচন্দ্রকে দোর-দুবনান পরগনার কর সংগ্রহের দায়িত্ব দেন। উদ্ধবচন্দ্রের বংশধর বিক্রমচন্দ্রের পৌত্র সুরথরামের চার ছেলের মধ্যে কনিষ্ঠ গঙ্গানারায়ণ প্রধান। ইন্দ্রনারায়ণ ভাই গঙ্গানারায়ণকে দোর-দুবনান পরগনার ‘নায়েব’ করে অন্যত্র চলে যান। গঙ্গানারায়ণের লেখাপড়ার হাতে খড়ি হয়েছিল হুগলির নর্মাল স্কুলে। ছোটবেলা থেকে বাংলা ইংরেজি সাহিত্যে তাঁর ব্যুৎপত্তি ছিল। এলাকায় সাহিত্যচর্চা উৎসাহিত করার জন্য তিনি সেই সময়ে পত্রপত্রিকা ও প্রাচীন পুস্তিকার একটি গ্রন্থাগার স্থাপন করেছিলেন। মাঝেমধ্যেই বসাতেন সাহিত্যের আড্ডা। এরপর প্রকাশিত হল ‘কাব্য কদম্ব’। হইচই পড়ে গেল।
‘কাব্য কদম্ব’র সূচিপত্রে পৃষ্ঠা নম্বর-সহ মোট ২২টি কবিতার নাম রয়েছে। প্রথম কবিতাটি ‘১’ নম্বর চিহ্নিত পৃষ্ঠা থেকেই শুরু হয়েছে। কবিতাগুলি হল, প্রাভাতিক সঙ্গীত, প্রভাত, দিবা, শশী, দিবাভাগে দৃশ্যমান চন্দ্র, পাতার পতন, ভূপতিত কুসুম, মানব জীবন, সুখী মনুষ্য, ধার্মিক লোক পৃথিবীর অলঙ্কার, তারা, একটা জলচর পক্ষী, সৈনিকের স্বপ্ন, শৌচ কি?, অসুখী কে?, শোভা পায় কি?, সন্ধ্যা, শুষ্ক সরোবর, জীবন, ভ্রাতৃ বিলাপ, রিপু বর্ণনা এবং তুষ্টি। কবিতাগুলির নামকরণ থেকেই স্পষ্ট কবি তাঁর কলমে শুধু কাব্য করেননি, তিনি কবিতার মাধ্যমে সামাজিক দায়-দায়িত্বও পালন করতে চেয়েছেন।
কেমন ছিল গঙ্গানারায়ণের কাব্য প্রতিভা? তাঁর ‘শশী’ নামক কবিতাটি থেকে কয়েকটি পঙক্তি, ‘আহা কী! সুচারু শশী হাসিয়া হাসিয়া,/সুনীল-অম্বরে যান ভাসিয়া ভাসিয়া’। কবি বিজ্ঞাপন অংশে লিখেছিলেন, তিনি পুস্তকটি অতি ক্ষুদ্র অবয়বে প্রকাশ করছেন। যদি ‘আদৃত হয়’ তাহলে ‘ইহার নাম প্রথম ভাগ দিয়া দ্বিতীয় ভাগ’ লিখবেন। দ্বিতীয় ভাগ কি লিখেছিলেন? জানা যায় না। ‘কাব্য কদম্ব’ মুদ্রিত হয়েছিল পাতরিয়াঘাটা’ থেকে। এই পাতরিয়াঘাটা তো পাথুরিয়াঘাটা। সেই সময়ে শিল্প-সাহিত্য চর্চার অন্যতম পীঠস্থান ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে গঙ্গানারায়ণের কোনও যোগ ছিল? জানা যায় না।
লেখক প্রাবন্ধিক