সলিল চৌধুরী এ দেশের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালকদের মধ্যে এক জন। গানের কথা, সুর, চলচ্চিত্রের নেপথ্য সঙ্গীত, সবেতেই তিনি এমন উদাহরণ সৃষ্টি করে গিয়েছেন, যা যুগ-যুগ ধরে বেঁচে থাকবে বলে আমার বিশ্বাস। আজ তাঁর জন্মদিন।
সলিল চৌধুরীর জনপ্রিয়তা বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। সব বড় শিল্পীই যে বেঁচে থাকতে প্রভূত জনপ্রিয় হন বা সারা জীবন সমান ভাবে জনপ্রিয় থাকেন, তা নয়। চড়াই-উতরাই সময় ও জীবনের ধর্ম, কেউ তা এড়াতে পারেন না। কিন্তু, অপরিমিত এবং অপরিচিত সৃষ্টিশীলতার অধিকারী মানুষেরা নতুন প্রজন্মকে, ভবিষ্যৎকে উদ্বুদ্ধ করেন নতুন নতুন সৃষ্টির পথে যেতে। এই যে নতুন নতুন রাস্তার দিক নির্দেশ করা, নিজের একটা স্টাইল, একটা ব্র্যান্ড, একটা ছাপ, অন্য একটা পথের সন্ধান— এ সব এক জনকে মহত্তর প্রতিভা বলে প্রমাণ করে। শচীন দেব বর্মন মহাশয় নিজের সন্তান রাহুল দেব বর্মনের ব্যাপারে খানিকটা আক্ষেপ করে সলিলবাবুকে চিঠি লিখেছিলেন বলে শুনেছি। কারণ, রাহুল দেবের পাশ্চাত্য সঙ্গীতের প্রতি আকর্ষণ। তাঁর ছেলেকে যেন সলিলবাবু একটু বোঝান— রাহুল সলিলবাবুর কথা বেশি শোনে, তাঁর কথা শুনতে চায় না। শোনা যায়, সলিল উত্তরে বলেছিলেন যে, রাহুল তার নিজের রাস্তা খুঁজে বার করে নেবে, নতুন করে ভাবনাচিন্তার এটাই পথ, আর বলেছিলেন যে, যদি এক জন মহান সুরকার অর্থাৎ শচীন দেব বর্মন নিজে ভাটিয়ালি গানের সুরে হিন্দি ফিল্মের জগৎকে তোলপাড় করতে পারেন, রাহুলও তার সুর দিয়ে চেষ্টা করবে।
একই সা রে গা মা পা ধা নি দিয়ে কত রকমের ম্যাজিক করে ফেলা যায়। মনে হয় সবটাই নতুন। আর সেই সৃষ্টি যখন ভবিষ্যতে অনেক সৃষ্টিশীল মানুষের জন্ম দেয়, তখনই তার আসল সার্থকতা। অন্য দিকে, জনপ্রিয়তা বলতে আমরা যা বুঝি, সেটা সময়ের দাস। আজ আছে কাল নেই। খানিকটা সচেতন প্রায় সবটাই অচেতন মনের ভাল লাগার প্রকাশ। তাই ‘গণ’ আর ‘কৃষ্টি’, দুটো কথা একসঙ্গে উচ্চারণ করা শক্ত। সময়কে পেরিয়ে যাওয়াটা সৃষ্টির আসল ক্ষমতা। আর সে পেরিয়ে যাওয়াটা হয় নিঃশব্দে, কোনও হাততালি বাজে না। নতুন সৃষ্টিকর্তা তাঁর সময়ে সশব্দ করতালির উত্তাপ উপভোগ করেন সত্যি, কিন্তু তাঁর সৃষ্টি কালজয়ী হবে কি না, সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ হতে পারেন না।
ভীমসেন জোশী যখন সুযোগ পেতেন, তখন গান গাইতে যাওয়ার আগে আমির খাঁ-এর গানের রেকর্ডিং শুনতেন। এক বার একটি ঘরোয়া আসরে তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, কার গান তাঁকে সবচেয়ে প্রভাবিত করে, তিনি বলেছিলেন, “কেন, আপনারা বুঝতে পারেন না, আমি আমির খাঁর গান দিয়ে কতটা প্রভাবিত?” সত্যি শ্রোতারা বুঝতে পারেননি, অর্থাৎ এই যে প্রভাবিত হওয়ার ব্যাপারটা, সেটা ভীষণ ব্যক্তিগত, সুগভীর এবং সাধারণ বুদ্ধিতে তার ব্যাখ্যা চলে না। রাহুল দেব বর্মন সলিল চৌধুরীর সঙ্গীতে প্রভাবিত হয়েছিলেন, সেটা শচীন দেবের আপাত আক্ষেপ থেকে বোঝা যায়। নিশ্চয়ই পরবর্তী প্রজন্মের অনেকের সুরে সলিলবাবুর সুরের ছোঁয়া, স্টাইলের ছোঁয়া থেকে গিয়েছে।
আশির দশকে সলিল চৌধুরীর সঙ্গে আলাপ হয় আমার গানের মাস্টারমশাই কৃষ্ণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে। মাস্টারমশাইয়ের স্নেহধন্য ছিলেন তিনি। কিছু সময় সরকারের বিরাগভাজন হওয়ার সময় মাস্টারমশাই তাঁকে সাহায্য করেছিলেন আর আইপিটিএ-ও বোধ হয় একটা সম্পর্কের সূত্র ছিল। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁর সঙ্গে কথা বলার। অন্তরা আমাদের সঙ্গেই মাস্টারমশাইয়ের কাছে গান শিখত। অত্যন্ত সুন্দর ব্যবহার ছিল গোটা পরিবারের, আমাদের মতো ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে। সে কথার কিছু ছিটেফোঁটা মাঝে মাঝে মনে পড়ে। তখন অনেক কিছুই বুঝতাম না। তিনি যে কত বড় শিল্পী ছিলেন, সেটা এখনও বুঝে চলেছি।
ইংরেজিতে ‘পাথব্রেকিং’ কথাটার উদাহরণ মানেই যুগান্তকারী গানের মানুষ, গীতিকার, সুরকার গাইয়ে এঁরা সব। একটা ব্যাপারে এঁরা এক রকম। যেমন ছিলেন সলিল চৌধুরী। গানের সুর ঠিক কী ভাবে এগোবে, সেটা আগে থেকে বলা যাবে না। অর্থাৎ, যা আন্দাজ করা যায় না সেটাই হবে। আর সেটাই কালজয়ী সৃষ্টির একটা আবশ্যিক শর্ত। আর এক অসাধারণ বাঙালি, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, একটি অনুষ্ঠানে অপূর্ব গান করলেন। বললেন, রাগ জয়জয়ন্তী। সঙ্গের হারমোনিয়াম বাদক জিজ্ঞেস করলেন জয়জয়ন্তীর চেহারাটা বোঝা গেল কি? তিনি হাসতে হাসতে বললেন, “সে কী, আমি তো ওই রাগেরই সব পর্দা লাগিয়েছি, অথচ রাগটা লুকিয়ে রইল।” যা আশা করছি তা হবে না। ‘না মনে লাগে না’ গানটিতে লতা মঙ্গেশকর জাদু সৃষ্টি করে গিয়েছেন। প্রথম লাইনে একেবারে নিপাট মার্গ সঙ্গীতের ছোঁয়া, দ্বিতীয় লাইনটি পাশ্চাত্য সঙ্গীতের ঢঙে তৈরি একেবারে অন্য রকম। ওই প্রথম লাইনটি ধরেই গানটি যেতে পারত, কিন্তু ধূমকেতুর মতো একটা ঝটকা দিয়ে গেলেন, অথচ সে মেলডি সবার কানে লেগে থাকবে চিরকাল। পুরোপুরি মোৎজ়ার্টের থেকে নেওয়া সুরে ‘ইতনা না মুঝ সে তু’ গানটির স্থায়ী সুর করলেন সলিল। অন্তরা একেবারে অন্য রকম আবার ফিরে এলেন। যা ভাবছি তা হচ্ছে না, সব গানে এক অপূর্ব অনিশ্চয়তা, তার সপ্তক থেকে এক লাফে মন্দ্র সপ্তক ঘুরে আবার উঁচুতে, কিন্তু কোথাও ছন্দপতন নেই। মেলডির একটা অখণ্ড চেহারা গড়ে উঠছে। ধান কাটার গান, সাত ভাই চম্পা, রানার, গাঁয়ের বধূ— এক একটা এক এক রকম বাঁধনভাঙা গান। বৈচিত্রে গায়ে কাঁটা দেয়।
এক একটা গান যেন এক একটা মহাকাব্য। দৈর্ঘ্যে নয়, প্রস্থে নয়, চিন্তার ব্যাপ্তিতে। যখন বেঁচে থাকার জন্য মারপিট অবান্তর, সময় পেরিয়ে গিয়েছে অনেক ধাপ, নতুন সমাজ, নতুন যুগ, নতুন প্রযুক্তি, নতুন মানসিকতা, নতুন বোধ বা নির্বুদ্ধি, পুরনোকে না জেনে, বুঝে অনেক মেকি নতুন নিয়ে ব্যবসা--- সব পেরিয়ে নিঃশব্দ সৃষ্টির ছলাকলার রসাস্বাদ করার জন্য উপাদান হাতড়ে বেড়ানোর সময় বুঝতে পারি, সলিলবাবুর গান এখনও বিস্ময়কর।
প্রবন্ধের বক্তব্য লেখকের নিজস্ব।
প্রবন্ধ পাঠানোর ঠিকানা: editpage@abp.in
অনুগ্রহ করে সঙ্গে ফোন নম্বর জানাবেন।