শিউলি এখনও ফুটছে, কাশের গুচ্ছ যথারীতি মাথা দোলাচ্ছে নির্জনে নদীর ধারে বা ইতি-উতি। আকাশের রং ঘন নীল। শরৎ পেরিয়ে হেমন্ত এসে গিয়েছে। বরাবরের মতো আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা, ধনী-দরিদ্র, বাঙালি-অবাঙালি সকলেই বছরের এই সময়টাতে মাতৃশক্তি আরাধনায় নিবিষ্টচিত্ত। মনুষ্যজাতির শক্তি আরাধনার ইতিহাস অতি প্রাচীন। ইতিহাস, সাহিত্য, লোকসংস্কৃতি—শক্তি উপাসনার সাক্ষ্য বহন করে আসছে বহু যুগ ধরে। প্রথমেই আসি মনুষ্যরূপী দেবতাদের কথায়। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধক্ষেত্রে কৃষ্ণ এবং অর্জুন দু’জনে নতজানু হয়ে প্রার্থনা করেছিলেন, ‘‘হ্রীং নমস্তে সিদ্ধসেনানী আর্য্যেমন্দরবাসিনী/ কুমারী কালী কাপালী কপিলে কৃষ্ণ পিঙ্গলে…।’’ ঈশ্বরবিশ্বাসী মানুষ মাত্রেই স্বীকার করেন— যে দুর্গা, সেই কালী।
এই ধরাধামে শক্তির আরাধনা শুরু হয় শরৎকাল থেকেই, দেবী দুর্গার অসুরনাশিনী মূর্তি পূজার মধ্যে দিয়ে। অন্য দিকে, মরাঠা বীর ছত্রপতি শিবাজীর আরাধ্যা দেবী ভবানী। শিবাজীর তরবারির নামও ছিল ভবানী । মহাশক্তি ভবানী রূপে উদয় হয়ে শ্রী রামদাসের কৃপায় শিবাজীকে শক্তিপূত অসি দিয়েছিলেন এবং স্বাধীন মহারাষ্ট্র গঠনে নিয়োগ করেছিলেন।
এ দিকে, স্বদেশি আন্দোলন যখন প্রায় তুঙ্গে, সেই সময়ে ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় তাঁর সম্পাদিত ‘সন্ধ্যা’ পত্রিকায় এক দিন লিখলেন— নতুন এক ধরনের বোমা তৈরি হচ্ছে, তার নাম ‘কালী মায়ের বোমা’। প্রত্যেক পরিবার থেকে যুবক প্রয়োজন কালী মায়ের বোমা নিয়ে খেলার জন্য। তখন মানুষের মনে একটা ধারণা গড়ে উঠেছিল যে, এই শক্তিরূপা মা কালীই হলেন মহাবিশ্ব। তিনিই পরমাশক্তি। তাঁকে ছাড়া শিব পর্যন্ত ক্ষমতাহীন। ভারতবর্ষের মতো দেশকে স্বাধীনতা এনে দিতে আশ্রয় নিতে হয়েছিল এই অলৌকিক দৈবশক্তির কাছেই। কারণ, এই পোড়া দেশের মানুষ তখনও উপলব্ধি করতে পারত না স্বাধীনতার প্রকৃত মানে আসলে কী!
ভারতবর্ষকে স্বাধীন করার জন্য অরবিন্দ সহিংস-অহিংস, প্রভৃতি পথ অবলম্বন করা ছাড়াও লৌকিক- অলৌকিক নানাবিধ প্রচেষ্টাও করেছিলেন। সেগুলির মধ্যে একটি ছিল, ‘ভবানী মন্দির’ পুস্তিকা রচনা করা। গুপ্ত সমিতির মধ্যে বিতরণ করে দেওয়া হয়েছিল এই বিস্ফোরক রচনা। অরবিন্দ এই সমস্ত পথ অবলম্বন করেছিলেন, কারণ তিনি জানতেন, ধর্ম এ দেশের মানুষের জীবনযাপনের এক পাথেয়।
বঙ্কিমচন্দ্রের ধর্মতত্ত্ব: অনুশীলন-এ আমরা এই মতের সমর্থন পাই। অরবিন্দের লক্ষ্য ছিল ধর্মীয় ভাবাবেগের মধ্যে দিয়ে দেশের মানুষের মনে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে জাগিয়ে তোলা। তিনি ধর্মের সঙ্গে কর্মকে মিলিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। তাই তিনি লিখেছেন, ‘‘আমাদের মধ্যে অনেকে ধর্ম শব্দের বিকৃত অর্থ করেন। সাধু সন্ন্যাসীর কথা, ভগবানের কথা, দেব-দেবীর কথা, সংসারবর্জ্জনের কথাকে তাঁহারা ধর্ম নামে অভিহিত করেন কিন্তু আর কোন প্রসঙ্গ উত্থাপন করিলে, তাহারা বলেন, ইহা সংসারের কথা, ধর্মের কথা নহে। তাঁহাদের মনে পাশ্চাত্য religion-এর ভাব সন্নিবিষ্ট হইয়াছে, ধর্ম শব্দ শ্রবণ করিবামাত্র religion-এর কথা মনে উদয় হয়। নিজের অজ্ঞাতসারেও সেই অর্থে ধর্ম শব্দ ব্যবহার করেন। কিন্তু আমাদের স্বদেশী কথায় এইরূপ বিদেশী ভাব প্রকাশ করাইলে আমরা উদার ও সনাতন আর্য্যাভাব ও শিক্ষা থেকে ভ্রষ্ট হই। সমস্ত জীবন ধর্মক্ষেত্র, সংসারও ধর্ম। কেবল আধ্যাত্মিক জ্ঞানালোচনা ও ভক্তির ভাব ধর্ম নহে। কর্মও ধর্ম।’’
তবে একটা সময় ছিল, তখন কালীপুজো করতেন তান্ত্রিক সম্প্রদায়ের লোকজন ও ডাকাতেরা। সাধারণ মানুষ তান্ত্রিকদের ভয় করতেন। মহাশ্মশানে ভয় উদ্রেককারী ভয়াল কালী মূর্তি গড়ে তান্ত্রিক বা কাপালিকেরা পুজোয় নরবলি দিয়ে মারণ-উচাটন, বশীকরণের মতো সাঙ্ঘাতিক সব অশুভ শক্তির চর্চা করতেন। সেই সঙ্গে চলত ব্যাভিচার। আর ডাকাতেরা দুর্ভেদ্য গভীর জঙ্গলের মধ্যে আস্তানা গেঁড়ে কালীপুজো করত। এদের কালী মূর্তিকে ডাকাতে কালী বলা হত।
কথিত আছে, কালীপুজো সম্পন্ন করে মায়ের কাছে কার্যসিদ্ধির জন্য শক্তি ও সাহস প্রার্থনা করে ডাকাত সর্দার তার দলবল নিয়ে ডাকাতি করতে বেরিয়ে যেত গৃহস্থ বাড়ির উদ্দেশে। সুতরাং, সাধারণ মানুষের কাছ থেকে শক্তিপুজো অনেক দূরে ছিল। অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল তাদের এই শক্তিসাধনাকে ঘিরে। রানি রাসমণি স্বপ্নাদেশ পেয়ে কালীপুজো করতে গেলে অনেক বড় বিতর্কের ঝড় উঠেছিল তাঁর জানবাজারের শ্বশুরবাড়িতে। সেই সব ঝড় ঝাপটা সামলে কী করে তিনি পরে দক্ষিণেশ্বরে ভবতারিণীকে মন্দির স্থাপন করে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেই ইতিহাস সকলেরই জানা।
তবে সাধারণ মানুষের মনে শক্তিসাধনাকে ঘিরে যে ভয় ছিল, তা দূর করে ভালবাসায় রূপান্তরিত করতে পেরেছিলেন কয়েক জন কালীসাধক। কমলাকান্ত, রামপ্রসাদ, রামকৃষ্ণ ও তন্ত্রাচার্য কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ। তাঁদের পূজিত কালীমায়ের কল্যাণময়ী প্রসন্ন দেবীমূর্তি এই বঙ্গে আজও স্বমহিমায় ভাস্বর হয়ে আছে। আর সেই দেবীকে ঘিরেই অন্ধকারের অমানিশা দূর করতে পালিত হল দীপাবলি উৎসব।
কালীপুজোর রাত্রে দীপান্বিতা লক্ষ্মীপুজোর রেওয়াজ আছে অনেক বাড়িতেই। অলক্ষ্মীর কৃষ্ণবর্ণা এলোকেশি মূর্তি গড়ে ঘরের বাইরে রেখে পুজো করে, ছোট-ছোট ছেলেমেয়েরা সেই অলক্ষ্মীর মূর্তি মাথায় করে কুলো পিটিয়ে কাঁসর-ঘণ্টা বাজিয়ে গ্রামের বাইরে ফেলে দেওয়ায় সময়ে মুখে বলতে থাকে— ‘‘অলক্ষ্মী যাও ছারেখারে/ এস মা লক্ষ্মী ঘরে।’’ তার পর লক্ষ্মীর প্রতিষ্ঠা করা হয়।
দীপাবলীর রাত্রে মাতৃশক্তির আরাধনা তাই প্রার্থনা— শুভশক্তির কাছে অশুভ শক্তির পরাজয় ঘটার।
(উদ্ধৃতির মধ্যে বানান অপরিবর্তিত)
লেখক সাহিত্যিক