যাঁরা ব্যাঙ্কেই টাকা রাখতে পারেন না, তাঁরা কি শেয়ার কিনতে পারবেন
nirmala sitaraman

টাকা জমাতেও আলস্য

‘যে দেশে বেশির ভাগ মানুষই অসংগঠিত ক্ষেত্রে, বেশির ভাগ মানুষের রোজগারের নিশ্চয়তা নেই, সেখানে মানুষকে সঞ্চয়ের থেকে আরও দূরে ঠেলা ক্রিমিনাল অফেন্স।’

Advertisement

অমিতাভ গুপ্ত

শেষ আপডেট: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০০:২৭
Share:

মেরি আঁতোয়ানেতের মতো শোনাচ্ছে, বুঝলেন’, শিবুদাকে উদ্দেশ করে কথা ভাসিয়ে দিল শিশির, ‘ব্যাঙ্ক-পোস্ট অফিসে টাকা রাখতে না পারে, বন্ড-শেয়ারে লগ্নি করলেই তো হয়!’ নির্মলা সীতারামনের বাজেটের পর থেকেই চটে আছে শিশির। তাতে ঘি ঢালল অর্থমন্ত্রীর গত রবিবারের মন্তব্য। গোপালের দোকানে এসে ইস্তক গজগজ করেই চলেছে শিশির। ‘ভাবুন, যে দেশে অর্ধেক লোক এখনও ব্যাঙ্কের পাসবই বুঝতে পারে না ঠিক করে, তারা শেয়ারে লগ্নি করবে?’

Advertisement

‘করবে। এবং, তাকেই বলে ডিপেনিং অব ফাইনানশিয়াল মার্কেট। অর্থাৎ, আর্থিক বাজার নামক গাড্ডাটিকে আরও গভীর করে তোলা, যাতে কেউ সেই গাড্ডা থেকে উঠে আসতে না পারে!’ তপেশের কথায় শেষ অবধি হাসে শিশির।

শিবুদা কিন্তু চুপ। গোপাল আজও তাঁর টোস্টে চিনি দিয়েছে। শিবুদা টোস্ট থেকে একটা একটা করে চিনির দানা খুঁটে প্লেটের পাশে ফেলছেন। ডায়াবিটিস হওয়ার পর ডাক্তার টোস্টে চিনি খেতে বারণ করে দিয়েছে। পাঁউরুটিটা প্লেটে এক বার ঠুকে শেষ কয়েক দানা চিনি ঝরিয়ে একটা কামড় বসালেন। চায়ে চুমুক দিলেন। তার পর বললেন, ‘শেয়ারে টাকা লাগিয়ে সর্বনাশ হবে কত জনের, সেটা প্রশ্নই নয়। কথাটা হল, টাকা জমাবে ক’জন?’

Advertisement

‘সে কথাই তো বলছিলাম...’ শিবুদার সঙ্গে সুর মেলায় শিশির।

‘না, বলছিলি না।’ প্লেট থেকে চিনিটুকু হাতে ঢালেন শিবুদা, মায়াভরা চোখে একটু তাকিয়ে থাকেন সে দিকে। তার পর, চিনিটা মুখে পুরে দিয়ে মুখশুদ্ধির মতো চিবোতে চিবোতে বললেন, ‘আসল সমস্যাটা হল টাকা জমানোর। লোকে জানে টাকা জমানো দরকার, কিন্তু জমিয়ে উঠতে পারে না। জমানোর মতো টাকা রোজগার করলেও নয়। এটা শুধু ভারতের নয়, গোটা দুনিয়ার সমস্যা। কিন্তু, ভারতে তারও আগের সমস্যা হল রোজগারের। ভারতে জমানোর মতো রোজগার ক’জন করে?’

‘পুরোটাই ঘেঁটে দিলেন’, তপেশ আপত্তি করে। ‘সমস্যা তা হলে কী— জমানোর মতো রোজগার করতে না পারা, রোজগার করেও জমাতে না পারা, না কি শেয়ারে টাকা রেখে ঝুঁকির মুখে পড়া?’

‘সব ক’টাই, এবং আরও কয়েকটা। যেমন, সরকারি খাতের বদলে যদি শেয়ার বাজারে টাকা চলে যায়, তা হলে সরকারের হাতে উন্নয়নের জন্য টাকা কম পড়বে, আর তার প্রভাব পড়বে সাধারণ মানুষের রোজগারের উপর’, চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে বললেন শিবুদা। ‘বেশির ভাগ লোকের রোজগারই টাকা জমানোর মতো নয়, এটা নিয়ে নতুন করে কথা বলার মানে হয় না। কিন্তু, যারা টাকা জমাতে পারে— জমানোর মতো রোজগার যাদের আছে— তারাও টাকা জমায় না কেন বল দিকি?’

এই প্রশ্নের উত্তর শিবুদাই দেবেন, তপেশরা জানে। শিবুদা পিঠটাকে টান করতে গিয়ে উফ্ বলে মুখ কোঁচকালেন এক বার। বয়স হচ্ছে, শরীর জানান দেয় হরেক ভাবে। শিশিরের প্যাকেট থেকে আলগোছে একটা সিগারেট নিলেন, তবে ধরালেন না। বললেন, ‘সাধ্য থাকলেও অনেকেই কেন টাকা জমায় না, বা জমাতে পারে না, বিহেভিয়রাল ইকনমিকস-এ তার অন্তত দুটো ব্যাখ্যা সম্ভব। আমার মতে, দুটোই ঠিক— একটা অন্যটার পরিপূরক।’ এই অবধি বলে থামলেন শিবুদা। সিগারেটটা ধরালেন। তার পর বললেন, ‘একটা ব্যাখ্যা হল, যদিও মানুষ জানে যে টাকা জমানো প্রয়োজন— ভবিষ্যতের কথা ভেবেই প্রয়োজন— কিন্তু, এটাও জানে যে কাজটা আজ না করে কাল করলেও চলে। ফলে, আজ হাতে যে টাকাটা আছে, সেটা অন্য কোনও তাৎক্ষণিক প্রয়োজনে খরচ করে মানুষ। এই ব্যাখ্যাটা সেন্ধিল মুলাইনাথনদের। রিচার্ড থেলার আবার বলবেন, টাকা জমাতে না পারার কারণ দুটো— এক, মানুষ আসলে জানেই না যে কত টাকা জমানো প্রয়োজন; আর দুই, জানলেও সেটা করে উঠতে পারে না এক আশ্চর্য আলস্যের কারণে।’

‘টাকা জমাতেও আলস্য!’ তিন শ্রোতাই অবাক।

‘ওরে, থেলার নোবেল পেলেন এই আলস্যের রহস্য ভেদ করে’, জানালেন শিবুদা। ‘কিন্তু, তোদের দেখে আশ্চর্য হই। নিজেকে কত টাকা জমাতে হবে, লোকে এটা জানে না শুনে অবাক হলি না তোরা?’

‘হয়েছি, কিন্তু গালি খাওয়ার ভয়ে বলিনি’, মিচকি হেসে উত্তর দেয় তপেশ।

‘যত বাজে কথা! ভেবে দেখ, যাদের পেনশন নেই, মানে চাকরিজীবন শেষ হওয়ার পর যাদের আর রোজগারের পথ নেই, বেঁচে থাকার জন্য তাদের ভরসা জমা টাকার উপর সুদ। যে দিন রিটায়ার করবি, সে দিন থেকে মোটামুটি আশি-পঁচাশি বছর বাঁচতে প্রতি মাসে কত খরচ হবে, সেটাও হিসেব করে ফেলা যায়— বছরে মোটামুটি ৫ পার্সেন্ট ইনফ্লেশন ধরে। আবার, কত টাকা জমালে মাসে সেই টাকা সুদ পাওয়া যাবে, সেটা হিসেব করাও সম্ভব। এখন গাদাগুচ্ছের ওয়েবসাইট আছে, অ্যাপ আছে— তোকে অঙ্কও কষতে হবে না, অ্যাপেই সব হিসেব পেয়ে যাবি। তার পরও কেন বেশির ভাগ লোকই জানে না যে রিটায়ার করার সময় হাতে কত টাকা থাকতে হবে?’ শিবুদা দম নিতে থামেন। আর একটা সিগারেট ধরান, তার পর বলেন, ‘তার কারণ, বেশির ভাগ মানুষই এই সব জটিল হিসেবকে ভয় পায়, এড়িয়ে চলতে চায়। সম্পূর্ণ ইর‌্যাশনাল একটা ভয়, কিন্তু মানুষ তো যুক্তিহীনই। ভাব, ভবিষ্যতের খরচ চড়চড়িয়ে বাড়ছে, আর মানুষের সঞ্চয়ের পরিমাণ পাল্লা দিয়ে কমছে। গত পাঁচ-ছ’বছরে ভারতে গৃহস্থালির সঞ্চয় কমেছে প্রায় সাত পার্সেন্টেজ-পয়েন্ট।’

‘আলস্যের কথাটা বললেন না...’, মনে করিয়ে দেয় সূর্য।

‘বলছি। থেলারের নাজ-এর কথা তো অনেক বার বলেছি— যেটা মানুষের পক্ষে ভাল, সেটার দিকে আলতো করে ঠেলে দেওয়া। নাজ-এর দরকার হয় কেন? মানুষ নিজে জানে না যে ট্রান্স ফ্যাটের বদলে আপেল খাওয়া স্বাস্থ্যের পক্ষে ভাল, বা বুড়ো বয়সে হাতে টাকা থাকা দরকার? তার পরও তাকে নিজের ভালর দিকে ঠেলতে হয় কেন, জানিস? কারণ, যেটা করে চলেছে, সেটাই করতে থাকার অভ্যাস— নিজেকে পাল্টে নিতে আলস্য— ভয়ঙ্কর শক্তিশালী। শুনে যতটা মনে হচ্ছে, তার চেয়েও ঢের বেশি।’ শিবুদা থামলেন।

শিশিরের চোখে অবিশ্বাস স্পষ্ট। তবে, শিবুদা যে বাজে কথা বলার লোক নন, সেটাও ওরা বিলক্ষণ জানে। দিনরাত এত বকুনি খেয়েও ওরা গোপালের দোকানে শিবুদাকে ঘিরে বসে এই টানেই। শিবুদা শিশিরের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কয়েক সপ্তাহ আগে থেলার এসেছিলেন কলকাতায়। যাব ভাবলুম, তার পর মনে হল, জোকায় যেতে গেলে মাঝেরহাট ব্রিজ পেরোতে হবে, তার চেয়ে শিকাগো গিয়ে দেখা করে আসা সোজা— অতএব, থাক। তুই তো নিশ্চয়ই খবরও রাখিস না। থেলারদের নাজ-এর মূল কথাটাই তো হল এই আপাত-অবিশ্বাস্য মানসিক আলস্যগুলোকে ভাঙার উপায় তৈরি করা। লোকে যাতে বেশি টাকা জমাতে পারে, তার দু’খানা পথ বলেছেন থেলার। অবিশ্যি, সেই পথ দুটোই চাকরিজীবীদের জন্য। প্রথমটা হল নিয়ম করে দেওয়া যে মাইনের একটা অংশ সঞ্চয়ে যাবে, সেটাই ডিফল্ট অপশন— কেউ টাকা জমাতে না চাইলে তাকে আলাদা করে জানাতে হবে; দ্বিতীয়টা হল সেভ মোর টুমরো— প্রতি বছর একটু একটু করে সঞ্চয় বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি আদায় করে নেওয়া। ভারতে সেগুলো কপি-পেস্ট করা সম্ভব কি না, সেটা অন্য প্রশ্ন— কিন্তু, মানুষকে তার নিজের ভালর জন্যই টাকা জমানোর দিকে ঠেলা প্রয়োজন, এই কথাটা অন্তত নির্মলা ভাবতে পারতেন।’

‘শিবু সেনকে অ্যাডভাইসার করতে হত তা হলে!’ তপেশ অদম্য।

‘তার প্রয়োজন পড়ত না।’ গম্ভীর গলায় উত্তর দেন শিবুদা। ‘যে দেশে বেশির ভাগ মানুষই অসংগঠিত ক্ষেত্রে, বেশির ভাগ মানুষের রোজগারের নিশ্চয়তা নেই, সেখানে মানুষকে সঞ্চয়ের থেকে আরও দূরে ঠেলা যে ক্রিমিনাল অফেন্স, এটা বোঝার জন্য একটু মানবিকতা থাকাই যথেষ্ট। শেয়ার বাজারে টাকা রাখতে হবে, এটা বলার সহজ অর্থ, মানুষ টাকা জমাবে না। জমানোর সাধ্য থাকলেও না— ভয়ে, আলস্যে, না জানার ফলে। হাতের টাকা না জমিয়ে খরচ করে ফেললে বাজার অর্থনীতির কী লাভ-ক্ষতি, সে কথা অন্য সময় ভাবব— কিন্তু, আজ টাকা না জমালে কাল যে আমি বিপদে পড়ব, এর চেয়ে সহজ সত্যি আর নেই।

‘নিশ্চয়ই প্রশ্ন করবি, কী করতে পারতেন নির্মলা? শিবু সেনকে অ্যাডভাইসার করলে বলতাম, যে কারণগুলোয় সাধারণ মানুষের পক্ষে সঞ্চয় করে ওঠা হয় না, সেগুলো দূর করুন। এখন তো সরকার অনেক টাকাই ক্যাশ ট্রান্সফার করে। বলতাম, তার মধ্যে একটা সঞ্চয়ের কমপোনেন্ট তৈরি করতে, যাতে সরকারি টাকা এলেই তার একটা অংশ সঞ্চয়ের খাতে চলে যায়। অথবা, একটা ইউনিভার্সাল বেসিক পেনশন প্ল্যান তৈরি করতে বলতাম। নিয়ম হত, ভর্তুকিবাবদ মাথাপিছু যে খরচ হয়, তার একটা অংশের ডিফল্ট সেটিং হবে সরাসরি এই ফান্ডে চলে যাওয়া— কেউ নগদ চাইলে তাকে আলাদা করে জানাতে হবে। যাদের টাকা জমবে, তাদের ৬০ বছর বয়স হলেই সেই ফান্ড থেকে পেনশন আসবে।’

শিবুদা উঠে পড়লেন। চেয়ারে ঝোলানো মাফলার গলায় জড়াতে জড়াতে বললেন, ‘অবিশ্যি, এই সব করার আগে মানুষের কথা ভাবা প্র্যাকটিস করতে হবে। সেটায় নির্মলাদের বড্ড ঘাটতি।’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement