কলেজ স্ট্রিটের বইয়ের দোকান। ফাইল চিত্র।
দুই মাস হইতে চলল, বইপাড়া বন্ধ। কলেজ স্ট্রিট ও সংলগ্ন এলাকায় প্রায় পাঁচ লক্ষ লোকের জীবন-জীবিকা বই-নির্ভর। শুধু ছোটবড় বইয়ের দোকান ও প্রকাশনা সংস্থার কর্মীরাই নহে, মুদ্রক, বাঁধাইকর্মী, বই পরিবহণকারী ও আনুষঙ্গিক ক্ষেত্রগুলিতে কর্মরত প্রত্যেকের জীবন লকডাউনে থমকাইয়া গিয়াছে। পরিযায়ী শ্রমিক হইতে অটোচালক, নির্মাণকর্মী, এমনকি ভিক্ষুকের কর্মহীনতা লইয়াও জনমানসে উদ্বেগ ঘনাইয়াছে, কিন্তু বইকে ঘিরিয়া যাঁহাদের জীবন, তাঁহাদের লইয়া কেহ তেমন ভাবিত নহে। অথচ বাঙালি বইপ্রেমী জাতি, এই দুঃসময়ে হাতে বই না পাইবার দুঃখে তালাবন্ধ কলেজ স্ট্রিটের জন্য কিঞ্চিৎ মায়ামমতা অসঙ্গত ছিল না। একটু খোঁজ লইলে জানা যাইত, ছোটবড় বই-বিপণিগুলিতে লক্ষ লক্ষ টাকার বই, গুদামগুলিতে কাগজ ও অন্যান্য সামগ্রী পড়িয়া আছে। গ্রীষ্ম আপনমনে বহিয়া যাইতেছে, ঝড়বৃষ্টিরও অভাব নাই, কিন্তু উষ্ণতা ও আর্দ্রতার হেরফেরে আলোবাতাসহীন অপরিসর প্রকোষ্ঠে বইয়ের কী পরিমাণ ক্ষতি হইতে পারে, কাহারও ধারণা নাই। উই ধরিলে, পোকা বা ইঁদুরে কাটিলে সর্বনাশ, এবং সেই আশঙ্কা অমূলক নহে। লকডাউন এক দিন উঠিবে, কলেজ স্ট্রিটের ঝাঁপ উঠিলে রাশি রাশি কীটদষ্ট কাগজের স্তূপ দেখিতে না হয়, সেই প্রার্থনায় কিছু মানুষের দিন যাইতেছে নিশ্চিত।
বইকে অত্যাবশ্যক ও জরুরি পণ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করিলে হয়তো চিত্রটি ভিন্ন হইত। কেরল সরকার তাহাই করিয়াছে, অতিমারির আবহে নাগরিকের মানসিক স্বাস্থ্যরক্ষায় বইকে কেবল জরুরি নহে, সর্বাপেক্ষা জরুরি ঘোষণা করিয়াছে। কেন্দ্রীয় সরকার আপত্তি জানাইলে প্রত্যুত্তরে এই ক্রান্তিকালে বই পড়া ও কেনার গুরুত্ব বুঝাইয়াছে। সপ্তাহে দুই দিন সমস্ত পুর-অঞ্চলে বইয়ের দোকান খোলা রাখিয়াছে। ইহা শুধু একটি রাজ্য সরকারের সিদ্ধান্ত নহে, সমগ্র রাজ্যবাসীরও সমর্থিত মত। পশ্চিমবঙ্গ পারিল না, তাহার কারণ শুধু সরকার নহে, বই লইয়া বঙ্গবাসীরও ঔদাসীন্য। বঙ্গ-নাগরিকগণ বাজার খোলা থাকিলেই খুশি, সুরার বিপণি খুলিয়াছে বলিয়া আরও খুশি, চা-দোকান খুলিবার প্রতীক্ষায় চাতকের ন্যায় প্রতীক্ষারত। কেহ বলিতে পারেন, চাল ডাল নুন তেলের ন্যায় বইকেও অত্যাবশ্যক বলা নিতান্ত বাড়াবাড়ি। বাড়িতে বই রহিয়াছেই, তদুপরি প্রকাশনা সংস্থা হইতে শুরু করিয়া সাহিত্যপ্রেমী সাধারণ মানুষের উদ্যোগে বই পড়িবার ভিডিয়োয় সমাজমাধ্যম ভরিয়া গিয়াছে, তাহা কম কী! সাহিত্যচর্চা হইতেছে তো! প্রিয় কবির স্বকণ্ঠে কবিতা শুনিবার অভিজ্ঞতা, বা সাধারণ নাগরিকটির সন্ধ্যাকালে ধোপদুরস্ত সাজিয়া ফেসবুক লাইভে কম্বুকণ্ঠে মহাকাব্য পাঠ নিশ্চয়ই সুখদ, তবে তাহা জনসংযোগ স্থাপন বা বন্ধুবৃত্তে নিজ নান্দনিক মুখটি দেখাইয়া সাময়িক আত্মসুখ লাভের অধিক কিছু দিতে পারে কি না বলা দুরূহ। তাহাতে বই ও লেখককে পাঠকসম্মুখে পরিচিত করা যাইতে পারে, কিন্তু লকডাউনে বিক্রয়ের বন্দোবস্ত করা যাইবে কি? আমেরিকায় আঠারো শতেরও অধিক একক বা স্বাধীন বই-বিপণি আছে, এই দুঃসময়ে তাহাদের সিংহভাগ কর্মীই কর্মহীন। তাহা বলিয়া বই বিক্রি হইতেছে না তাহা নহে। ক্রেতা ফোনে বইয়ের বরাত দিয়া দোকানে গিয়া স্বাস্থ্যবিধি মানিয়া বই লইয়া আসিতে পারেন, বাড়িতে পৌঁছাইয়া দেওয়ার ব্যবস্থাও চালু। স্বাধীন বই-বিপণিগুলি সরকারের পাশাপাশি পাঠকের অনুদান পাইতেছে, এক-এক জায়গায় বইপ্রেমী গোষ্ঠী চাঁদা তুলিয়া প্রিয় বই-দোকানটির বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করিতেছেন। এই সমস্তই হইতেছে বইকে ভালবাসিয়া।
বহির্বিশ্বে, ভারতেও ই-বুক, অডিয়ো-বুকের ন্যায় বিকল্পগুলি বাড়িতেছে। প্রকাশনা সংস্থাগুলি ডিজিটাল পরিসরে ঝুঁকিতেছে, জনপ্রিয় কয়েকজন লেখকের বইয়ের ই-সংস্করণ ইহার মধ্যেই প্রকাশিত। কিন্তু ভারতীয় তথা বঙ্গীয় পাঠক এখনও এই ধরনের বই পাঠে অভ্যস্ত নহেন। এই বই কিনিতে ও পড়িতে স্মার্টফোন বা ই-বুক রিডার, ইন্টারনেট সংযোগ প্রয়োজন, ভারত স্মার্টফোনের বৃহত্তম বাজার হইলেও এই সকল বন্দোবস্তে এখনও বহু পথ পিছাইয়া আছে। হাতে ধরিয়া গন্ধ লইয়া বই পড়িবার সুখ ইহাতে নাই। করোনা-উত্তর বিশ্বে হয়তো বই পড়িবার অভ্যাসও বদলাইবে, বইয়ের কারবারিরা কাগজের বইয়ের বদলে প্রযুক্তিপুষ্ট বইয়ের শরণ লইবেন। কোনও এক করোনা-কালে বঙ্গপাঠকের বই-বৈরাগ্যও তাহার জন্য কিঞ্চিৎ দায়ী ছিল কি না, সেই প্রশ্ন ও তজ্জনিত অস্বস্তি তাহাতে ঢাকা পড়িবে তো?
যৎকিঞ্চিত
উত্তর কোরিয়ায় যিনি প্রকাশ্যে এলেন তিনি শাসক কিম জং উন, না কি তাঁর ডামি— এই গোছের তর্ক আর ক’দিনের মধ্যে বাতিল, কারণ সকলের মুখেই ঢাউস মাস্ক। প্রেমও কঠিন হয়ে পড়বে, কারণ ছেলেটিকে দেখে মেয়েটি ঝলমলে হাসল না মুখ বেঁকাল, বোঝা অসম্ভব। অভিনয়ও অন্য দিগন্তে, মুখের অভিব্যক্তি বলে প্রায় কিছু নেই, নাক দিয়ে দুরন্ত অভিনয় শুরু। তবে নৈতিক শুদ্ধতাবাদীরা যে ভাবছেন, মুখের রূপের জয়গান বন্ধ হল, ভুল। সুন্দর মাস্কের জয় সর্বত্র।
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)