আত্মঘাতী চিকিৎসক পায়েল তাদভি। ছবি: সংগৃহীত
এক আদিবাসী তরুণীর চিকিৎসাবিদ্যায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের স্বপ্নটি অপূর্ণ রহিল। পায়েল তাদভির আত্মহত্যা এক গভীর সঙ্কটের বার্তা। ২০১৬ সালে হায়দরাবাদে রোহিত ভেমুলার আত্মহত্যা হইতে ২০১৯ সালে মুম্বইয়ের এক সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের স্নাতকোত্তর ছাত্রী পায়েল তাদভির আত্মহনন, উচ্চশিক্ষায় দলিত-আদিবাসী ছাত্রছাত্রীদের ধারাবাহিক বিপন্নতার দুইটি দৃষ্টান্তমাত্র। রোহিতের পূর্বে তাঁহার বিশ্ববিদ্যালয়েই সাত জন দলিত ছাত্র আত্মহত্যা করিয়াছিলেন। ২০০৬ হইতে এমস, আইআইটি-র মতো বিবিধ শীর্ষস্থানীয় শিক্ষায়তনে বাইশ জন ছাত্রছাত্রী আত্মহত্যা করিয়াছেন। আরও কত পায়েল তাদভি, রোহিত ভেমুলা নিজেদের জীবন শেষ করিয়া অপমানের জ্বালা জুড়াইয়াছেন, কে বলিতে পারে? তাঁহাদের অপমান করিবার সহজ উপায়, সংরক্ষিত আসনের সুযোগ গ্রহণ করিবার জন্য ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ। সংরক্ষণ তাঁহাদের অধিকার। কিন্তু তাঁহারা যে বস্তুত উচ্চশিক্ষার অধিকারী নহেন, ‘পিছনের দরজা’ দিয়া প্রবেশ করিয়াছেন, এমন একটি তত্ত্ব নির্মাণ করা হইয়া থাকে। এবং ‘অনধিকার প্রবেশ’ করিবার জন্য নানা ‘শাস্তি’ বর্ষিত হইতে থাকে। অপমানিত, ব্যর্থতার সম্ভাবনায় শঙ্কিত ছাত্রছাত্রীরা নীরবে সরিয়া যান উচ্চশিক্ষা হইতে, কেহ আত্মহননের পথ বাছিয়া লইতেছেন।
আক্ষেপ, এই জঘন্য অপরাধ যাঁহারা করিতেছেন, তাঁহারা তথাকথিত ‘শিক্ষিত,’ এমনকি অনেকে শিক্ষক। শিক্ষা যে তাঁহাদের ক্ষুদ্রতা হইতে মুক্তি দেয় নাই, সাম্য ও যুক্তিবাদে উন্নীত করে নাই, আবারও তাহার প্রমাণ মিলিল পায়েলের আত্মহত্যায়। অপমান ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে পায়েল এবং তাঁহার বাবা-মা অভিযোগ করিয়াছিলেন মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষের নিকট, কিন্তু তাঁহারা বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেন নাই। অভিযুক্ত তিন ডাক্তারের শাস্তিও হয় নাই। কলেজের ডিন জানাইয়াছেন, তিনি জানিতে পারিলে এর প্রতিকার করিতেন। অর্থাৎ বিষয়টি উচ্চতর কর্তৃপক্ষকে জানাইবার প্রয়োজনও বোধ করেন নাই বিভাগীয় প্রধান। স্কুল হইতেই দলিত ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষকদের এই অবিচারের শিকার হইয়া থাকে। কখনও দলিতদের পৃথক বসিবার জায়গা নির্দিষ্ট করিয়া থাকেন শিক্ষকেরা, কখনও স্কুলের পূজায় তাহারা অংশগ্রহণ করিতে চাহিলে তিরস্কার করেন। কর্নাটকে একটি সমীক্ষায় প্রকাশ পাইয়াছে, ব্রিটিশ শাসনকালে ‘অপরাধপ্রবণ’ বলিয়া চিহ্নিত জনজাতির শিশুদের প্রতি আজও স্কুলগুলি নিতান্ত নিষ্করুণ। দলিত-আদিবাসীদের বিরুদ্ধে বৈষম্য ও হিংসার জন্য কঠোরতর শাস্তি নির্দিষ্ট করিয়া আইন হইয়াছে। কিন্তু তাহাতেও তথাকথিত শিক্ষিত শ্রেণির চেতনা হয় নাই।
শিক্ষাক্ষেত্রে এখনও তথাকথিত উচ্চবর্ণেরই দাপট। নিম্নবর্গের প্রতি তাহাদের বিদ্বেষ এবং ক্ষেত্রবিশেষে ঘৃণা সুবিদিত। শুধু আইন করিয়ে সেই বিদ্বেষ মোছা অসম্ভব। তাহার জন্য যে পরিবেশের প্রয়োজন, রাজনৈতিক সদিচ্ছা ভিন্ন তাহা সৃষ্টি হয় না। দায়িত্ব মূলত সরকারের। নিম্নবর্গের প্রতি যে কোনও অবিচারে কঠোরতম ব্যবস্থা করিয়া দ্ব্যর্থহীন বার্তা পৌঁছাইয়া দেওয়া প্রয়োজন। গত দফায় নরেন্দ্র মোদীর সরকার সেই কাজটিতে ব্যর্থ হইয়াছিল। বস্তুত, বারে বারেই ভুল বার্তা প্রেরিত হইয়াছিল। এই দফায় কি তাঁহারা ভুলটি শুধরাইয়া লইতে পারিবেন?