প্রতীকী ছবি।
লোকসভা নির্বাচন আসন্ন, অতএব কেন্দ্রীয় সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর হইতেছে। শুধু টাকাপয়সার লেনদেন নহে, ‘দুর্নীতি নিরোধক (সংশোধনী) আইন ২০১৮’-তে ব্যবস্থা করা হইতেছে, অতঃপর যৌন সুবিধা দেওয়া-নেওয়াও ঘুষ হিসাবেই বিবেচিত হইবে। এবং, ঘুষ যে লহে এবং ঘুষ যে দেয়, আইন উভয়কেই অপরাধীসম দহন করিবে। দুর্নীতির ময়দানে যৌন সুবিধা যে অতি প্রচলিত মুদ্রা, তাহাতে সংশয়ের অবকাশ নাই। ‘মি টু’ নামক যে আন্দোলনটি সাম্প্রতিক অতীতে গোটা দুনিয়াকে কাঁপাইয়া দিয়াছিল, তাহার প্রতিবাদটিই ছিল যৌনতার মুদ্রায় ঘুষ চাওয়ার বিরুদ্ধে। অতএব, দুর্নীতির সংজ্ঞায় যৌন সুবিধা চাওয়াকে অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি পদক্ষেপ। এই দুর্নীতির অস্তিত্ব এবং অগ্রহণযোগ্যতা রাষ্ট্রীয় স্তরে স্বীকার করা হইলে তবেই না তাহাকে নির্মূল করিবার পথে পদক্ষেপ করা সম্ভব হইবে। এত দিনে যে এই পদক্ষেপ সম্ভব হইল, তাহা দেখাইয়া দেয় সচেতনতা প্রসার ও প্রতিবাদ সংগঠনের প্রত্যক্ষ প্রভাবে দেশের আইনেও কতখানি সংবেদনশীলতা আনা সম্ভব।
গোলমাল অন্যত্র। কয়েক বৎসর পূর্বে, দেশের মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা থাকাকালীন, কৌশিক বসু ঘুষের প্রকারভেদ করিয়া বলেন, অন্যায্য সুবিধা পাওয়ার জন্য ঘুষ এক গোত্রের, আর প্রাপ্যটুকু আদায় করিতে বাধ্য হইয়া ঘুষ দেওয়া আর এক গোত্রের। তাঁহার যুক্তিধারা প্রসারিত করিয়া বলা যায়, যাঁহারা প্রথম গোত্রের ঘুষ দিয়া থাকেন, তাঁহারা যৌন সুবিধার মুদ্রায় ঘুষ দিলেও— অনুমান করা চলে, তাহা দিবেন বাণিজ্যিক পথে। অন্য দিকে, যাঁহারা দ্বিতীয় গোত্রের ঘুষ দিতে বাধ্য হইবেন, যৌন সুবিধার মুদ্রায় ঘুষ দিবার ক্ষেত্রে তাঁহারা হয়তো নিজেরাই সরাসরি দুষ্টবৃত্তে জড়াইয়া পড়িবেন। ঘুষের অন্যায় নির্মূল করিতে গিয়া এই দুই গোত্রকে গুলাইয়া ফেলিলে মুশকিল।
আসল কথা, বাধ্য হইয়া ঘুষ দেওয়ার মধ্যে সর্ব ক্ষেত্রেই এক তীব্র অসহায়তা আছে। তাহার উপর, বাধ্য হইয়া যদি যৌন সুবিধার মুদ্রায় সেই ঘুষ দিতে হয়, তবে অসহায়তাটি যে তীব্রতর হইয়া ওঠে, বুঝিতে কষ্ট হয় না। স্পষ্টতই, এই ক্ষেত্রে ক্ষমতার উচ্চাবচতা দুই প্রকার। প্রথমত, সরকারি কর্তা ও সুবিধাপ্রার্থীর মধ্যে, এবং দ্বিতীয়ত, পুরুষ ও নারীর মধ্যেও। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এই দ্বিতীয় উচ্চাবচতাটিকে দেখিতে অস্বীকার করিলে খণ্ডদর্শন হইবে। টাকায় ঘুষ দিতে বাধ্য হওয়া কোনও পুরুষ, আর যৌন সুবিধার মুদ্রায় ঘুষ দিতে বাধ্য হওয়া কোনও মহিলাকে সমান ‘অপরাধী’ হিসাবে বিবেচনা করা তাই ন্যায্য হইতে পারে না। পুরুষতন্ত্রের দর্শন অর্থ, মদ্য ও নারীকে এক গোত্রে ফেলিতে চাহিলেও তৃতীয়টি যে প্রথম দুইটির অপেক্ষা অনেক আলাদা, পুরুষতন্ত্র-পরিহারী আইনকে এই কথাটি প্রথমেই স্বীকার করিতে হইবে। পার্থক্যটি স্পষ্ট করিতে না পারিলে শেষ পর্যন্ত খাপ পঞ্চায়েতের দর্শনে পৌঁছাইতে হইবে, যেখানে সমাজের জ্যাঠামহাশয়রা দাবি তোলেন, ধর্ষণের ক্ষেত্রে নারীরও নাকি সমান দায়। সুতরাং, যৌন মুদ্রায় ঘুষকে অন্যান্য ঘুষের সহিত সমগোত্রীয় করিয়া দেখিতে গিয়া ঘুষ আদায়কারী ও ঘুষ প্রদানকারীকে একই রকম অপরাধী করিয়া দেখা অন্যায় হইবে— এই সূক্ষ্ম নৈতিকতার কথাটি ভুলিলে চলিবে না।