ওয়াটার্লু, বেলজিয়াম। সে দিনের যুদ্ধের অভিনয়। ১৯ জুন, ২০১৫। ছবি: গেটি ইমেজেস।
দুশো বছর তিন দিন আগে যুদ্ধটা যদি না হত, আমরা কি সারা জীবন নিশ্চিন্তে ক্যাডবেরি খেতে পারতাম?
প্রেমেন মিত্তিরের গল্পের মতো শোনাচ্ছে? ঘনাদার গল্পের শুরুতেই থাকত এই রকম উৎপটাং একটা লাইন। অথচ আমাদের কার্যকারণটা কিন্তু একদম সহজ, সিধে রাস্তা, দুশো বছর তিন দিনের পথ। ১৮১৫ সালের ১৮ জুন যদি ওয়াটার্লুর যুদ্ধে নেপোলিয়নকে গোহারা হারিয়ে ইংরেজরা এই দুনিয়ার মাথায় চড়ে না বসত, তা হলে হয়তো ফরাসিদের অসীম প্রতিপত্তি আর অশ্বমেধ সাম্রাজ্য বাড়তে বা়ড়তে বিশ্বজোড়া ফাঁদ হয়ে যেত। ভারতও হয়তো ফরাসি হত। এবং সে ক্ষেত্রে ভারতের একটা গোটা প্রজন্মের জন্য ক্যাডবেরি বস্তুটা অধরা থেকে যেত। যেতই। কেননা, ষাটের দশক থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ফ্রান্সের সর্বত্র ক্যাডবেরি ছিল নিষিদ্ধ! সম্ভ্রান্ত ‘কোকো বাটার’-এর বদলে তাতে গরিবগুর্বোদের ভেজিটেবল অয়েল ব্যবহার হয়েছে বলে!
নাক-উঁচুপনায় ফরাসিরা চিরকালই বিখ্যাত। চকলেট-এর নাকটা ওদের আরওই উঁচু। ফলে ওরা মুখ বাঁকিয়ে আমাদের স্বপ্নের বেগুনি মোড়কের ক্যাডবেরির নাম দিয়েছিল ‘ভেজিলেট’ বা ‘সারোগেট চকলেট’। ২০০০ সালে অবশ্য নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়, ক্যাডবেরি কোম্পানি মোড়কের গায়ে লিখে দিতে রাজি হয় যে তার মধ্যে ভেজিটেবল অয়েল নামক কিছু অর্বাচীনতা আছে।
ভাগ্যিস, এই হৃদয়বিদারক নিষেধাজ্ঞার পাল্লায় আমাদের প়ড়তে হয়নি! ভাগ্যিস, আমরা ইংরেজ সভ্যতার খপ্পরে থাকার সৌভাগ্য লাভ করেছি! আমাদের পৃথিবীটা ইংরেজির বদলে ফরাসি হলে কী কাণ্ডটাই হত। চেয়ার টেবিল ব্যাগ পেন— এ সব বাংলা শব্দ পেতামই না মোটে। দিবারাত্রি ফরাসি বলতে গিয়ে জিভ যেত জড়িয়ে, তালু যেত শুকিয়ে! ‘উইক-এন্ড’ এলে ডিপ্রেশন হত: ‘ল্য ফ্যাঁ দ সম্যাঁ’ বলা কি মুখের কথা? মিস্টার-এর বদলে ‘মঁসিয়ে’, গুড মর্নিং-এর বদলে ‘বঁ জ্যুর্’ বলতে হত। ‘ইন্ডিয়া’ না হয়ে হত ‘ল্যন্দ্’! তিলোত্তমা কলকাতার বদলে বাংলার রাজধানী হত চন্দননগর! তাই বলছিলাম, লং লিভ ওয়াটার্লু। ইংল্যান্ড জুড়ে আজ যেমন মহাসমারোহে ২০০ বছর পূর্তি হচ্ছে, আমাদেরও কি কিছুু করা উচিত ছিল না? প্রিন্স চার্লস-এর পদাঙ্ক ধরে প্রণব মুখুজ্জেও কলকাতায় একটা স্মারক স্তম্ভের উদ্বোধন করতে পারতেন!
এঁড়ে তর্কে ইতিহাসবিদরা ওস্তাদ। ওয়াটার্লু নিয়েও বহু প্রশ্ন। এই যুদ্ধটাকেই কি নেপোলিয়নের শেষ বলে ধরা যায়? তিনি কি আগে থেকেই পিছু হটছিলেন না? ১৮০৫-এর ট্রাফালগারেই কি বোঝা যায়নি যে, চার দিকে অটল সমুদ্র-প্রহরা আর বাজখাঁই ইংরেজ নৌবাহিনী পেরিয়ে নেপোলিয়ন দ্বীপটিকে কব্জা করতে পারবেন না?
সন্দেহবাতিকগ্রস্তদের উত্তর অবশ্য ইতিহাসেই রেডি। আধ লাখ মানুষ আর সাত হাজার ঘোড়ার শবের স্তূপ নিয়ে যে চার দিনের যুদ্ধ শেষ হল, লন্ডনের ওয়াটার্লু স্টেশন থেকে কলকাতার ওয়াটার্লু স্ট্রিট— আপামর বিলিতি ভাবাপন্নের গায়ে জয়ের কাঁটা দেওয়া যে নাম দিকে দিকে ছড়িয়ে, তার মহামহিম সেনাপতি ডিউক অব ওয়েলিংটন নিজেই পরে বলেছিলেন: ‘এর থেকে কঠিন ঘটনা জীবনে ঘটেনি।’ সামরিক ইতিহাসকাররা বলেছেন, ওয়াটার্লু ছিল, যাকে বলে, ‘আ ক্লোজ থিং’। নেপোলিয়নের হার সে দিন মোটেই নিয়তির বিধিলিপি ছিল না। সে দিন না হারলে তাঁকে হয়তো সেন্ট হেলেনা দ্বীপে নির্বাসনেও যেতে হত না। অর্থাৎ সে দিন থেকে আজ এই দুশো বছর জুড়ে যে অ্যাংলো-স্যাক্সন রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-পারমার্থিক বিশ্ববীক্ষা লাগামহীন ভাবে ছুটছে, নেপোলিয়নই ছিলেন তার পথের শেষ বাধা। তিনি অস্তমিত হওয়ার শতাধিক বছর পর আর এক ইউরোপীয় নেতা বাজপাখির মতো উঠে এসেছিলেন। তবে ইতিহাসের পাতায় নেপোলিয়ন যে বিস্ময় আর শ্রদ্ধা উদ্রেক করেন, পরের ভদ্রলোক তার ধারকাছও মাড়াতে পারেননি! আমাদের সভ্যতা আক্ষরিক ভাবেই নেপোলিয়নের পতন থেকে সঞ্জাত। যদি কোনও একটি ঘটনাকে সেই পতনের প্রতীক বলতে হয়, তবে সেটা ওয়াটার্লুই।
ইতিহাস-রথীরা প্যাঁচ কষবেন: ওয়াটার্লু হঠাৎ কেন ইংরেজের জয় হতে যাবে, কেবল ইংরেজরাই কি যুদ্ধ করেছিল? প্রাশিয়া? হল্যান্ড? বেলজিয়াম?— কী মুশকিল! সে তো পলাশীর যুদ্ধেও জগৎশেঠ সেনা পাঠিয়েছিলেন, তাই বলে কি সেটা তাঁর যুদ্ধ? অধিনায়কত্বটা দেখতে হবে না? অন্যরা সবাই এলেবেলে, ফুটনোট! আজকের রকমসকমও সেটাই বলছে। ইংল্যান্ডে এত ধুমধাম, জার্মানি বেলজিয়াম চুপচাপ। অবশ্য তাদের বিধি বাম, চুপ না থেকে উপায় কী। ইউরোপীয় ইউনিয়নে তাদের রোজ ফ্রান্সের সঙ্গে গলা জড়িয়ে থাকতে হয়, ওয়াটার্লু নিয়ে আদিখ্যেতা করলে ফ্রান্স যাবে চটে। এর মধ্যেই বেলজিয়ামে ওয়াটার্লু-ছাপ দেওয়া ‘কয়েন’ চালু করার কথা শুনে ক্রুদ্ধ ফ্রান্স সেটা আটকে দিয়েছে। কয়েন বার হয়েছে শুধু স্মারক হিসেবে!
ফরাসিদের দোষ নেই। ইংরেজের সঙ্গে তো তাদের ঠুনকো শত্রুতা নয়, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ইংলিশ চ্যানেলের তলা দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বিদ্বেষ ও ঈর্ষার স্রোত। ভুলবে কী করে তারা, সে দিন ওয়াটার্লুতে হাজার বছরের শত্রুতার শেষ ওভারের খেলায় তাদের পরাজয়ের পিছনে পিছনে এই ছোটখাটো দেশের ভূমিকা কম ছিল না। যুদ্ধক্ষেত্রে তারা প্রবল কনফিউশন তৈরি করেছিল। সব বাহিনীরই পোশাক রংচঙে। মেঘলা দিনে প্রাশিয়ার সেনাদের কালচে পোশাক দেখে দূর থেকে নেপোলিয়ন ভুল করে েভবেছিলেন, ওরা নীল-পোশাকের ফরাসি সেনা। ধুলোর ঝ়ড় তুলে তাদের ধেয়ে আসতে দেখেও তিনি আশ্বস্ত হয়ে বসে ছিলেন। এই এক ভুলেই নাকি তাঁর সাড়ে সর্বনাশ ঘটে। ভুলভাল করে ইংরেজরাও, নেহাত জিতে যাওয়ায় ডিউক অব ওয়েলিংটন-এর মুখটি সে দিন পোড়েনি।
ওয়াটার্লুর হিরো-টিকে নিয়ে ইংরেজদের জাতীয় গৌরবের শেষ নেই। পরে তিনি প্রধানমন্ত্রীও হয়েছেন! তবে এই জন্য ভারতেও কিন্তু একটা উৎসব হতে পারত! ভারত না থাকলে কি ডিউক অব ওয়েলিংটনকে পেত ইংল্যান্ড? আবারও ঘনাদার মতো শোনাচ্ছে, কিন্তু ওয়াটার্লুর কয়েক বছর আগে ভারতেই এ ভদ্রলোকের উত্থান। কোম্পানির মহাশত্রু টিপু সুলতান তখন খুব বেগ দিচ্ছেন, এমন সময় এলেন লর্ড ওয়েলেসলির ভাই আর্থার ওয়েলেসলি। শ্রীরঙ্গপতনমের যুদ্ধে টিপু সুলতানকে পর্যুদস্ত করলেন তিনি। আজও বন্দুকের গোলায় ফুটিফাটা টিপুর দুর্গ দেখে তাজ্জব বনতে হয়। এই আর্থার ওয়েলেসলি তখন অবধি উঠতি ট্যালেন্ট। টিপু-জয়ের পরই নেকনজরে পড়লেন তিনি। দেশে ফিরে পর পর নাইটহুড আর ডিউক অব ওয়েলিংটন উপাধি। এঁর ভারতীয় কেরিয়ার মনে করেই নেপোলিয়ন এঁকে ‘সিপয় জেনারেল’ ভেবেছিলেন। ভুল করেছিলেন। বাজে ভুল।
১৮১৫ সালের পর যখন ডিউক অব ওয়েলিংটনের জয়গৌরব দিকে দিকে ধ্বনিত হচ্ছে, কোম্পানির কর্মকেন্দ্র কলকাতাও বাদ পড়ল না। ১৮২১ সালে কলকাতার ধর্মতলার কাছে একটা সুন্দর বাগানকে ঘিরে তৈরি হল ওয়েলিংটন স্কোয়্যার। কলকাতা গেজেট লিখল, ‘একটি নতুন টগবগে স্কোয়্যার এ বার, ধর্মতলায়’।
এর পরও ধর্মতলায়, নিদেনপক্ষে কলকাতায়, একটা ওয়াটার্লু উৎসব দাবি করা ভুল?