রাম নয়, সীতাই স্পর্শ করেছিলেন নবনীতা দেব সেনকে। রামভক্তদের এই দেশে সীতার কথা, সীতাদের কথা যে কৌশলে চাপা দেওয়া হয়, তা তিনি টের পেয়েছিলেন। পড়াশোনা থেকে রাজনীতি সর্বত্রই রামভক্ত পুরুষের ছড়াছড়ি। কেউ অতি উগ্র, কেউ নাতি উগ্র, কেউ ধীরস্থির— তবে মিল ওই এক পুরুষতান্ত্রিক রামভক্তিতে। বিশেষ করে, গত শতকের নব্বইয়ের দশক থেকে সঙ্কীর্ণ ও উগ্র রামভক্তির আত্মপ্রকাশ সামাজিক-রাজনৈতিক পরিসরে সুযোগ-সুবিধে মতো কখনও প্রবল, কখনও বা মৃদু। ভক্তি সাহিত্যের রামলালা বা বিনত রাম নয়, তিরন্দাজ মারমুখী রাম নিয়েই এঁদের কারবার। এই রাম বড় বড় যুদ্ধ করেন, ছোট ছোট মানুষী মুহূর্তগুলির খবরও রাখেন না। এই রাম যন্ত্রবৎ, সাফল্যকামী— সাফল্যের জন্য ইনি নির্মম ভাবে সব বিসর্জন দিতে পারেন। এই রামের নামে যাঁরা রাজনীতি করেন, তাঁরাও নির্মমতার পূজারি। সামাজিক পুরুষতন্ত্র আর রাজনৈতিক পুরুষতন্ত্রের সম্পর্ক গভীর। এ নিয়ে সৃষ্টিশীল সাহিত্যে, গভীর প্রবন্ধে যে বাঙালিনি সরব ছিলেন তিনি ‘নটী নবনীতা’। ‘নটী’ শব্দটি সচেতন ভাবেই প্রয়োগ করছি। মেয়েদের জীবনের নানা অন্তরঙ্গ মুহূর্ত রামতন্ত্র টেরই পায় না, সে সব কথা জানেন শুধু সীতা। সীতাকে ঘিরে অন্য রকম পারফরম্যান্স ভারতে মেয়েদের মধ্যে সুপ্রচলিত। সেগুলিকে তুলে আনছিলেন নবনীতা। বুঝতে পারছিলেন পুরুষতান্ত্রিক অনমনীয় রামকথা মায়াহীন। এই মায়াহীন যুদ্ধবাদী রামকথার বিরুদ্ধে সরব হওয়ার অন্যতম অস্ত্র সীতাকথা।
১৯৯৭ সাল। প্রকাশিত হল ‘বামাবোধিনী’। নবনীতার এই উপন্যাসের একটি ‘ভণিতা’ ছিল। লিখেছিলেন তাতে, ‘বেশির ভাগ সময়ে আমরা চোখ বুজে থাকতে চাই।’ অর্থাৎ সমস্যার স্বরূপ চিনতে চাই না। তখন মুখের সামনে আয়না ধরতে হয়। ‘আয়নাটাও তো কাজে দেয়।’ নবনীতার ‘বামাবোধিনী’ তেমনই একটি আয়না। সেই আয়নায় উঠে আসছে সীতার গান— সীতাজন্মের, সীতাবিবাহের, সীতাগর্ভের, সীতার বাচ্চা হওয়ার গান, রজস্বলা হওয়ার গান। পেটে বাচ্চা এসেছে। সীতার গা বমি, খেতে ইচ্ছে করছে না। এই অভিজ্ঞতাগুলি অন্ধ্রপ্রদেশে সীতাম্মার গানে ধরা পড়ছে। এমন গান সারা ভারতে নানা ভাষায় ছড়িয়ে আছে, আছে বাংলাতেও। ‘বামাবোধিনী’ উপন্যাসের মুখ্য-চরিত্র অংশুমালা এই গানগুলি সংগ্রহ করতে থাকে। তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ চন্দ্রাবতীর রামায়ণ। বাঙালিনির এই রামায়ণ সাহিত্যের ইতিহাসের পুরুষ সমালোচকদের মনে হয়েছিল কাঁচা লেখা, অসম্পূর্ণ। অংশুমালার তা কিন্তু মনে হয় না। অংশুমালার স্বামী অবশ্য স্ত্রী-র কাণ্ডকারখানায় রেগে আগুন। ‘তুমি একটা উচ্চশিক্ষিত কালচার্ড পার্সন কী করে যে ওই ঝি-আয়াদের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করো অংশু, আমি বুঝতে পারি না।’— মলয় ঝাঁজিয়ে ওঠে। উচ্চশিক্ষিত ভদ্রলোকের সমাজ আর রাজনীতিই তো সীতার কথাকে গুরুত্ব দিতে চায় না। মলয়ের রেগে যাওয়ার আর একটি কারণ ভয়। সেই ভয় ২০১৯’এ আরও গভীর ভাবে আমাদের সঙ্গ নিয়েছে। ‘যখন সারাটা দেশ রাম রাম করে খেপে রয়েছে, ঠিক তক্ষুণি তোমাকে প্রবন্ধ লিখতে হল কোন দেশের রামায়ণে রাম সীতার দাদা, আর কোন দেশের রামায়ণে সীতা রাবণের মেয়ে, আর কোন দেশের রামায়ণে বাল্মীকি সীতার প্রেমিক-কাম-পালকপিতা, আবার কোথায় যেন রাম-লক্ষ্মণ দুই ভাই-ই সীতাকে নিয়ে সুখে ঘরকন্না করেন— দ্রৌপদী স্টাইলে— রামভক্তরা এসব নোংরা কথায় খেপে উঠবে না ভেবেছ?’ মলয় ভয় পেলেও, অংশুমালার ভয়-ডর নেই।
ভয় ছিল না নবনীতারও। নবনীতার মা রাধারাণী দেবী ‘অপরাজিতা’ নামেও কবিতা লিখতেন, নবনীতা তো মাতৃপরম্পরাধারী। রামায়ণ এক নয় অনেক, ভারতবর্ষের ভেতরেও আছে অনেকগুলো ভারতবর্ষ— নানা রামায়ণে সেই নানা ভারতের প্রতিফলন। এক দেশ এক রামের নামে সেই অন্য কথাগুলোকে কচুকাটা করলে চলবে কেন? তা ছাড়া সীতার পাঁচালিও তো এক জায়গায় থেমে নেই— প্রতিনিয়ত এক রকম করে মেয়েরা তা প্রকাশ্যে অথবা মনে মনে লিখে চলেছেন। সে দিনও লিখতেন, এখনও লেখেন। চন্দ্রাবতীর রামায়ণ সম্বন্ধে নিজের নোট-খাতায় অংশুমালা লেখে, চন্দ্রাবতীর গান যারা আসরে পরিবেশন করত তাদের ‘আপন জীবনের অভিজ্ঞতা’ এর মধ্যে মিশে আছে। এই উপন্যাসে অংশু কমলাম্মা নামে একটি অসহায় মেয়েকে তার বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছে, কমলাম্মার কথা নবনীতা উপন্যাসে পাঁচালির আকারে লেখেন, ‘অভাগী জীবনকথা কী শুনাব আর/ জনম জনম গেল খাটিয়া বেগার।’ গদ্যের কাঠামোয় ঢুকে পড়ে পদ্য— রামের সাফল্যের মধ্যে জেগে ওঠে সীতার কান্না।
নবনীতা বুঝতে পারছিলেন রাজনৈতিক রামতন্ত্রের মুখোমুখি হওয়ার আগে সামাজিক রামতন্ত্রটিকে চিহ্নিত করা চাই। তা সব সময় রামের চেহারায় আসে না, যৌথ পরিবারের সংস্কারের মধ্যে ঘাঁটি গেড়ে বসে, মেয়েরাও তার অংশ। ‘মায়া রয়ে গেল’ (২০০১) উপন্যাসে প্রসেনজিৎ নামে উচ্চশিক্ষিত এক ডাক্তারবাবুর মুখ-মনের ছবি আছে। ডাক্তারবাবুর বাবা ছিলেন হিন্দু মহাসভার কর্মী। তার স্ত্রী সুষমা স্বামীর দাপট ক্রমে অতিক্রম করে। ‘হিন্দুনারী সুরক্ষা সমিতি’ প্রসেনজিতের নির্মাণ। স্ত্রী সুষমা সেটি ভেঙে গড়ে তোলে ‘বালিকা সুরক্ষাশ্রয়’। প্রসেনজিৎ বলে, ‘যত রাজ্যের ভিকিরি আর বেশ্যাদের নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি। সাধু-সন্ন্যাসিনীদের সঙ্গ তোমার তো মোটে ভালই লাগল না।’ এই প্রসেনজিৎ আজীবন তার মায়ের হাতের পুতুল, শাশুড়ি লীলাবতী সুষমাকে এক সময় বাঁজা বলে কথা শোনাতেন। যখন সে সন্তানসম্ভবা হল তখন বলেছিলেন, ‘আমাদের কোনও ভাবনা নেই আপনার মেয়েকে নিয়ে। হবে তো মায়ের মতনই যমজ মেয়ে— ও থাকল কি গেল, আমাদের এসে যাবে না।’ পড়তে পড়তে মনে হয় সন্তানসম্ভবা পুত্রবধূ সম্বন্ধে শাশুড়ি যতটা নির্মম, রামও সীতা সম্বন্ধে ততটাই নির্মম। না-হলে গর্ভে রামের সন্তানকে ধারণ করে বাল্মীকি আশ্রমে সীতাকে দিন কাটাতে হয়! রামায়ণের সীতা নীরব, সুষমা নয়। ক্রমশই নিজেকে বদলে নিয়েছে সে, সংগঠনের মাধ্যমে নিরুপায় মেয়েদের জন্য নানা কাজ করে। প্রসেনজিৎ ঘরে বসে চোখ রাঙায় আর স্ত্রী-র চরিত্র নিয়ে সন্দেহ করে। এমন সন্দেহই তো রামরাজত্বের রীতি, আর প্রজানুরঞ্জনের জন্য সন্দেহের কথা প্রকাশ পাওয়া মাত্র অগ্নিপরীক্ষা দেওয়া স্ত্রীকে বিসর্জন দিতে হয়।
এই যে ক্রমাগত রামকথার অদরদি অংশগুলিকে প্রশ্ন করছিলেন নবনীতা, তা কিন্তু সব সময় গম্ভীর মুখে করছিলেন না। তাঁর ভাষার মধ্যে এক রকম আটপৌরে রকমসকম। নিজেকে নিয়ে অসম্ভব মজা করতে ভালবাসতেন, নিজের না-পারা নিয়ে কত রকম রঙ্গ। এখানেই আসলে রামের সঙ্গে সীতার পার্থক্য, যন্ত্রের সঙ্গে মানুষের পার্থক্য। যন্ত্র নিজের দুর্বলতাকে প্রকাশ করলেই খারিজ, তার বদলে নতুন যন্ত্র তৈরি করা হবে। আর মানুষ জানে, তার পারা যেমন আছে তেমনই না-পারাও আছে। নবনীতার গৃহকোণ তাঁর লেখায় যখন উঁকি দিত, তখন এই পারা আর না-পারা সমান তালে পাঠকের সামনে হাজির। এই রান্না ভুল করছেন, গোছাতে গিয়ে হিমশিম, পরক্ষণেই প্লেনবাহনে বিদেশপানে। এই যে নিজেকে না-ছেঁটে-কেটে পুরোটা নিয়ে হাজির হতে পারা, এটা রঘুপতি রাঘব রাজা রামের ধর্ম নয়, তাঁকে সর্বদা ফিটফাট, নির্মম ও সফল পুরুষ হিসেবে দেখানো চাই। ভক্তিধর্মের রামের যে সামগ্রিকতা আছে, মানবিকতা আছে, হিন্দুত্বের কাটছাঁট রামে তা নেই। ভক্ত রামের জন্য এঁটো ফল রাখতে পারেন, শুদ্ধাচারী হিন্দুত্ববাদীরা তা ভাবতেও পারেন না।
নবনীতা যখন রামকথা নিয়ে গবেষণা শুরু করেন, তখন তাঁর চোখ আটকে ছিল বাল্মীকি রামায়ণে, ক্রমে বুঝলেন সীতা থেকে শুরু করা চাই। সে আর গবেষণার কাজমাত্র রইল না, ব্যক্তিগত আবেগ পড়ল ঢুকে। গবেষণা আর সৃষ্টিধর্মী লেখা একাকার। এই তাঁর সীতাকথা, সব কিছু নিয়ে। হাসি-কান্না, সাফল্য-অসাফল্য কিছুই লুকোন না।