ততক্ষণে ত্রিপুরা বিধানসভা নির্বাচনের ফল স্পষ্ট। ৩ মার্চ দুপুরে আগরতলার মেলার মাঠ এলাকায় রাজ্য সিপিএমের সদর দফতর ‘দশরথ দেব স্মৃতি ভবন’-এ কম্পিউটার রুমে সম্পূর্ণ একা বসে ছিলেন সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য গৌতম দাশ। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কী করে এ-রকম হল?’ গৌতমবাবুর জবাব ছিল, ‘মেজর সেটব্যাক, বিশেষ করে জনজাতীয় এলাকায়। আমাদের গভীরভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে কেন এমন হল।’
সিপিএম সূত্রে জেনেছি, ১৮ ফেব্রুয়ারি, বিধানসভা নির্বাচনের রাতেই পার্টি অফিসে রাজ্য নেতৃত্বের উপলব্ধি হয়েছিল, জনজাতি এলাকায় দলীয় সংগঠন ঢেলে সাজতে হবে। অর্থাৎ, তাঁরা সে-দিনই অন্য কিছুর আঁচ পেয়েছিলেন। কিন্তু গত শতাব্দীর চল্লিশের দশক থেকে ত্রিপুরার পাহাড়ি অঞ্চলে যারা বামপন্থার মশাল জ্বালিয়ে রেখেছিল, তারাই এ বার মুখ ফিরিয়ে নিল কেন?
ভোটে বিজেপি-আইপিএফটি জোট পেয়েছে ৪৪টি আসন। সিপিএমের ঝুলিতে মাত্র ১৬টি। আগরতলা শহর সে-অর্থে আগেও সিপিএমের দখলে ছিল না। তার সঙ্গে জনজাতি এলাকাতেও ধসে পড়েছে সিপিএম। এত দিনে উত্তর-পূর্বের এই রাজ্যের নির্বাচনের সবিস্তার ফল ও এই ফলের নানা ব্যাখ্যা আমরা পেয়েছি। তাই তার পুনরাবৃত্তি না করে আমরা এখানে দৃষ্টিপাত করব শুধুমাত্র ত্রিপুরার জনজাতি এলাকার দিকে। কীভাবে সেখানে সিপিএমের ভিত এত নড়বড়ে হয়ে গেল?
শহরাঞ্চলের মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে মোটামুটিভাবে খুশি রেখে জনজাতি প্রভাবিত অঞ্চলে ত্রিপুরা জনজাতি এলাকা স্বশাসিত জেলা পরিষদ (অটোনমাস ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিল বা এডিসি) গঠন করেছিল বাম সরকার। এডিসি-র আসনসংখ্যা ২৮। ২০০৫, ২০১০, ২০১৫— পর-পর তিন বারই এডিসি-র নির্বাচনে বামফ্রন্ট ২৮টি আসনের সব ক’টিই দখল করে।
কার্যত বিরোধীশূন্য তফসিলি জনজাতি (এসটি) এলাকায় ‘উন্নয়ন’-এর যে সংজ্ঞা সিপিএম নেতৃত্ব নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন, সেই সংজ্ঞা মেনেই ওই সব এলাকায় এডিসি-র কাজকর্ম চলতে থাকে। মুশকিলটা হল, দীর্ঘ পঁচিশ বছর একটানা কোনও সরকার ক্ষমতায় থাকলে তার ‘উন্নয়ন’-এর ধারা ও গতির সঙ্গে যে ভূমিপুত্রেরা একমত হবেন, এমনটা নয়। ধীরে-ধীরে চড়তে থাকে ‘অ্যান্টি ইনকাম্বেনসি’ বা প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার সুর। জনজাতি এলাকাতেও শিক্ষাদীক্ষা ও রোজগারের মানের উপরে নির্ভর করে তৈরি হয় মধ্যবিত্ত শ্রেণি, যারা এক অর্থে সুবিধাভোগী শ্রেণি। সর্বত্রই এই শ্রেণি ভুবনায়ন ও ভোগবাদের দুনিয়ায় চটজলদি সব কিছু পেতে চান।
ত্রিপুরার বামফ্রন্ট সরকারের একটা বড় কৃতিত্ব ছিল জনজাতি ও বাঙালি সম্প্রদায়ের মধ্যে সৌহার্দ্যের বাতাবরণ সৃষ্টি করা। সন্ত্রাসবাদী কাজকর্ম বন্ধ করা। সশস্ত্র বাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইন (আফস্পা) রাজ্য থেকে তুলে দেওয়া। মহিলাদের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা করা। এত বছর পরেও সিপিএমকে এহেন পরাজয় মেনে নিতে হয় কেন?
জনজাতি এলাকার বাম মনোভাবাপন্ন মানুষজনই জানিয়েছেন, দশরথ দেবের পরে তাঁর মাপের সর্বজনগ্রাহ্য জনজাতীয় নেতা আর আসেননি সিপিএমে। ১৯৪৩-এ ত্রিপুরার পাহাড়ে জনশিক্ষার দাবিতে আন্দোলন হয়। গঠিত হয় জনশিক্ষা সমিতি। আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন দশরথ দেব, হেমন্ত দেববর্মা, বিদ্যা দেববর্মা, সুধন্য দেববর্মা, নীলমণি দেববর্মারা। ১৯৪৫-এ গঠিত হয় গণমুক্তি পরিষদ। পরবর্তী সময়ে গণমুক্তি পরিষদের অনেক নেতাই কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন। গণমুক্তি পরিষদ এখনও পার্বত্য ত্রিপুরায় কাজ করে। কিন্তু দশরথ দেবের অভাব আর পূর্ণ হয়নি।
ফল প্রকাশের পর থেকেই বাম নেতৃত্ব বলে আসছেন, ত্রিপুরায় অর্থ ও পেশিশক্তির জয় হয়েছে। বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তির (আইপিএফটি) সঙ্গে হাত মিলিয়ে বিজেপি বাঙালি ও জনজাতির মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে চায়। তারা আইপিএফটি-র মাধ্যমে জনজাতিদের মধ্যে প্রচার চালিয়েছে যে তাদের জন্য পৃথক ‘টিপ্রাল্যান্ড’ রাজ্য গঠন করা হবে। এই প্রচারে জনজাতি প্রভাবিত হয়েছে। বিভ্রান্ত হয়েছে।
জনজাতির মধ্যে সিপিএমের প্রভাব যে তলানিতে ঠেকেছে তার সব থেকে বড় প্রমাণ সাম্প্রতিক ফল। বিধানসভার ৬০টি আসনের মধ্যে ২০টি আসনই তফসিলি জনজাতিদের জন্য সংরক্ষিত। তার মধ্যে সিপিএম পেয়েছে মাত্র দুটি আসন। বিজেপি জোট পেয়েছে ১৮টি। অর্থাৎ, উন্নয়নের যে ঢক্কানিনাদ বাইরে থেকে শোনা যায়, বাস্তব তাতে সায় দেয়নি। নির্বাচনের আগে জনজাতি প্রভাবিত নানা এলাকায় ঘুরে যত অভাব-অভিযোগের কথা শুনেছি, তাতে ভিন্ন সুরই কানে বেজেছে। মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারের পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির কথা সিপিএম নেতৃত্ব ক্রমাগত তুলে ধরলেও স্থানীয় স্তরে দলীয় নেতা-কর্মীদের একাংশের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ ও পাল্টে যাওয়া জীবনযাত্রা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে জনজাতি এলাকা। সরকারি চাকরি না পাওয়ার পাশাপাশি শিল্প না আসায় বেকারত্ব বেড়েই চলেছে। এখন ত্রিপুরায় বেকারের সংখ্যা প্রায় সাত লক্ষ। রাজ্যে ‘স্বর্ণযুগ’ এলেও তার সুফল জনজাতীয়রা পেলেন না কেন, সে প্রশ্নের উত্তরও তাঁরা দিয়েছেন ইভিএম-এ।
এটা ঘটনা যে, বিজেপির জোটসঙ্গী আইপিএফটি পৃথক রাজ্যের দাবি থেকে সরেনি। নির্বাচনী প্রচারের সময় জনজাতীয় এলাকায় সুকৌশলে সে বার্তাও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু প্রশ্নটা হল, সিপিএমের পাল্টা রাজনৈতিক প্রচার তাকে রুখতে পারল না কেন? সিপিএম নেতৃত্ব শুধু সৌহার্দ্যের বার্তা শুনিয়েছেন। কেন্দ্রে বিজেপির ‘অপশাসন’-এর কথা বলার পাশাপাশি জনজাতি এলাকায় উন্নয়নের ফিরিস্তি দিয়েছেন। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। বিজেপি-আইপিএফটি বুথস্তরে ঢুকে পড়েছে। স্মার্টফোন দেওয়ার প্রতিশ্রুতির পাশাপাশি প্রতি ঘরে চাকরি দেওয়ার কথা বলে পালের হাওয়া ঘুরিয়ে দিয়েছে বিজেপি।
মহারাষ্ট্রের কৃষক মিছিলের লাল রং বামপন্থীদের মনে নতুন আশার সঞ্চার করেছে। কিন্তু প্রকাশ কারাটরা কি দেখছেন, গোটা দেশে লাল পতাকা বিবর্ণ হতে-হতে আজ কার্যত অবলুপ্তির পথে? বিপন্ন পার্টির রাজনৈতিক লাইন না-হয় কিছু দিন পরে ঠিক হোক! আপাতত রাস্তায় নামুন কমরেড!