প্রাথমিক শিক্ষকদের অনশন। —ফাইল চিত্র
ঠিক উত্তর শিখাইবার পাশাপাশি, উত্তরে যে সকল ভুল হইতে পারে, তাহার একটি তালিকাও ছাত্রদের দিয়া থাকেন শিক্ষকরা। সম্প্রতি এ রাজ্যে নীতি প্রণয়নের পর পর যে সকল ঘটনা ঘটিতেছে, তাহা যেন তেমনই ভ্রান্তির তালিকা। বেতন বাড়াইবার দাবিতে প্রাথমিক শিক্ষকদের একটি সংগঠনের সদস্যরা অনশন করিলেন। রাজ্য সরকার প্রথমে অনড় মনোভাব দেখাইল। ক্রমশ শোরগোল বাড়িল, অতঃপর শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ঘোষণা, বেতন বাড়িল। তাঁহার আক্ষেপ, প্রাথমিক শিক্ষকরা অধিক বেতনের দাবিতে আন্দোলন করিয়াছেন, পড়াশোনার পরিকাঠামোর জন্য সরব হন নাই কেন? শিক্ষকদের আরও দায়িত্বশীল হইবার উপদেশ তিনি দিয়াছেন। পড়ুয়ারা যাহাতে সরকারি স্কুল ছাড়িয়া অন্যত্র না যায়, তাহা দেখিতে বলিয়াছেন। এমন কথা শুনিয়া চমৎকৃত হইতে হয়। শিক্ষকদের গাফিলতিতেই যদি ছাত্রেরা স্কুল ছাড়িতেছে, তবে শিক্ষামন্ত্রী বেতন বাড়াইলেন কেন? অধিক বেতনের বিনিময়ে অধিক দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করিবার দায় তো শিক্ষা দফতরেরই। স্কুলগুলির পরিকাঠামোর দুর্বলতার জন্য যদি শিক্ষার মান যথেষ্ট ভাল না হইতে পারে, তবে শিক্ষকদের বেতন বাড়াইলে ছাত্রদের কী লাভ হইবে? সরকারি বিদ্যালয়ের ছাত্র কিংবা তাহাদের অভিভাবকেরা উন্নত পরিকাঠামোর দাবিতে, শিক্ষকের নিয়মিত উপস্থিতি, যথাযথ শিক্ষাদান এবং পুষ্টিকর মধ্যাহ্নভোজনের দাবিতে অনশনে বসেন নাই বলিয়াই কি সেই সকল অত্যাবশ্যক কাজগুলি বাকি রহিয়া গেল? রাজ্য সরকার করদাতার অর্থে শিক্ষা-সহ সকল বিষয়ে খরচ করে। রাজ্যের শিশুদের স্বার্থরক্ষা লইয়া সংশয় থাকিয়া গেলে অধিক বরাদ্দ করিবার কী অধিকার তাহাদের আছে? রাজ্যবাসীর নিকট এই সত্যই ধরা দিল যে, প্রাথমিক শিক্ষকরা অনশন করিয়াছেন বলিয়া তাঁহাদের বেতন বাড়িল। নীতি নির্ধারণে, অর্থ বরাদ্দের বিষয়ে সিদ্ধান্তে ইহার চাহিতে দুঃখজনক আর কী হইতে পারে?
অনশন এবং তাহার সামনে রাজ্য সরকারের নতিস্বীকার, ইহা ইদানীং নিয়ম হইয়া উঠিয়াছে। অনশনকারীদের অবস্থা সঙ্কটজনক হইলে নাগরিক সমাজে শোরগোল উঠিলে দাবি মানিয়া রফা করিতেছে সরকার। চিকিৎসকরা নিরাপত্তার দাবিতে ধর্মঘট করিলেন, মুখ্যমন্ত্রী প্রথমে অনমনীয় থাকিবার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিলেন, আন্দোলন আরও শক্তিশালী হইতেই তাঁহার সরকার পিছু হটিল, সকল দাবি মানা হইল। এই ভাবেই কি সরকারি নীতি ধার্য করিবার কথা? চিকিৎসকদের নিরাপত্তার কী ব্যবস্থা হওয়া প্রয়োজন, তাহার কতটুকু বাকি রহিয়াছে, তাহার কোনও মূল্যায়ন কি স্বাস্থ্য দফতরের আধিকারিকরা কখনও করেন নাই? চিকিৎসকরা কাজ বন্ধ করিলেন বলিয়াই কি নিরাপত্তার অভাবের বোধ জন্মাইল? অথচ নিরাপত্তার যে সকল আশ্বাস কর্তারা দিয়াছিলেন, কার্যক্ষেত্রে তাহার অনেকগুলিই রূপায়িত হয় নাই।
সুতরাং এই বার্তাই পৌঁছাইতেছে যে, রাজ্য সরকার নাগরিকের প্রয়োজন এবং অর্থের জোগান বুঝিয়া স্বয়ং নীতি প্রণয়ন করিতে ভুলিয়াছে। সরকারের সহিত যুদ্ধ করিয়া তাহাকে পরাস্ত করিলে, অথবা তাহার সহিত দর কষাকষিতে সফল হইলে, তবেই ন্যায্য প্রাপ্তি মিলিবে। অধিকার যে নেতা-নাগরিকের দরদস্তুরের বিষয় নহে, সে শিক্ষাটি এ রাজ্য যেন ভুলিয়াছে।