বক্তৃতায় যা ঢাকা পড়বে না
RSS

স্বাধীনতা সংগ্রামের তীব্র বিরোধিতা করেছিল সঙ্ঘ পরিবার

ঐতিহাসিক তথ্য থেকে এটা পরিষ্কার যে, আরএসএস ১৯৪২ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, গাঁধীজির ডাকা ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের তীব্র বিরোধিতা করেছিল।

Advertisement

জহর সরকার

শেষ আপডেট: ১৫ অগস্ট ২০২০ ০০:৪৪
Share:

প্রতীকী ছবি।

এই স্বাধীনতা দিবসেও আমরা নিশ্চয় দিল্লির লালকেল্লা থেকে প্রচুর ছাতি ফোলানো গর্বের কথা শুনব আর জাতিপ্রেমের ফোয়ারার আবেগে নিজেদের ভাসিয়ে দেওয়ার বাণীও পাব। কিন্তু যখন ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী স্বাধীনতা সংগ্রামের অমর শহিদদের স্মরণ করবেন, তিনি কি এই ইতিহাসের সম্পূর্ণ সত্য ঘটনাগুলি বলবেন? তিনি ভুলেও আমাদের বলবেন না যে, তাঁর দলের নিয়ন্ত্রণকারী ও প্রেরণাদায়ক সংগঠন ওই সংগ্রামে অংশগ্রহণ তো করেনি বটেই, উপরন্তু কয়েক স্থানে বাধাও দিয়েছে? রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ বা আরএসএস-এর ভূমিকা বুঝতে গেলে তার দ্বিতীয় সরসঙ্ঘ-চালক এম এস গোলওয়ালকরের প্রবন্ধ ‘এক বীর্যবান জাতীয়তার দিকে’ পড়তে হবে। সেখানে তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ইংরেজ রাজশক্তির বিরুদ্ধে সরাসরি আন্দোলন করাকে তাঁরা জাতীয়তাবাদ বলে মনে করেন না।

Advertisement

ঐতিহাসিক তথ্য থেকে এটা পরিষ্কার যে, আরএসএস ১৯৪২ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, গাঁধীজির ডাকা ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের তীব্র বিরোধিতা করেছিল। দিল্লির জাতীয় সংরক্ষণাগারে রাখা নথি ও কাগজ থেকে অনুমান করা যায় যে, ব্রিটিশ পুলিশ আরএসএসের এই আচরণে যথেষ্ট সন্তোষ প্রকাশ করেছিল। ইতিহাস আরও জানায়, হিন্দু মহাসভার নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ১৯৪২ সালের বিপ্লবকে ব্যর্থ করার জন্যে উঠেপড়ে লেগেছিলেন। তিনি তখন ফজলুল হক মন্ত্রিসভার সদস্য। পরবর্তী কালে তিনি আজকের ভারতীয় জনতা পার্টির পূর্বসূরি ভারতীয় জনসঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তাদের পরম পূজনীয় পুরুষ। ১৯৪২-এর ২৬ জুলাই শ্যামাপ্রসাদ বাংলার গভর্নর জন হার্বার্টকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন: “আপনাদের এক জন মন্ত্রী হিসেবে, আমি পূর্ণ সহযোগিতা জানাচ্ছি।” শুধু তা-ই নয়, তিনি আরও খুলে বললেন, “যুদ্ধ চলার সময়ে যদি কেউ জনতার আবেগ উস্কে দেওয়ার চেষ্টা করে, অভ্যন্তরীণ শান্তি ও নিরাপত্তায় বিঘ্ন ঘটায়, সরকার যেন তার প্রতিরোধ করে।” এবং সাম্রাজ্যবাদী সরকারকে পূর্ণ সমর্থনের আশ্বাস দিয়ে শ্যামাপ্রসাদ তাঁর এই মত জানালেন যে, সংগ্রামের আর কোনও প্রয়োজন নেই। তিনি বললেন, “যে স্বাধীনতার জন্য কংগ্রেসের এই আন্দোলন, তা ইতিমধ্যে জনপ্রতিনিধিদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে”— ইংরেজ সরকারের দাক্ষিণ্যে। বাংলার যে হিন্দু চরমপন্থী নেতা স্বাধীনতার আন্দোলনকে ব্যর্থ করার জন্যে লেগেছিলেন, তাঁকেই সর্বোচ্চ স্থান দিচ্ছে কেন্দ্রের শাসক দল। প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি ঘটা করে কলকাতা বন্দরকে তাঁর নামে উৎসর্গ করলেন।

প্রতি বছর মহান ৯ অগস্ট এলে তিনি ও তাঁর দল যথেষ্ট বিপাকে পড়েন। এই বছর প্রধানমন্ত্রী এই ঐতিহাসিক দিনকে ভারতকে আবর্জনামুক্ত সপ্তাহের প্রথম দিন বলে আমাদের মানতে বললেন। তিনি আরও ঘোষণা করলেন যে, স্বাধীনতা দিবস অবধি আমরা এই সাফাই সপ্তাহ উদ্‌যাপন করব এই করোনার আতঙ্কের মধ্যেও। মোদী যত কায়দা করে বিষয়টিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করুন, বা আখ্যানটি নির্মূল করার প্রয়াস চালান, ততই আমাদের এই সত্যগুলিকে তুলে ধরতে বাধ্য করছেন।

Advertisement

এত অপচেষ্টার পরেও যখন ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হল, আরএসএস আর হিন্দু মহাসভা গোসাঘরে ঢুকে গেল— আর পাকিস্তান, জিন্না, এবং গাঁধীকে তীব্র সমালোচনা করল। বিশেষ করে সঙ্ঘ ক্রমাগত ত্রিরঙা পতাকাকে গালমন্দ করে এক বিষাক্ত প্রচার শুরু করল। আরএসএসের মুখপত্র ‘অর্গানাইজ়ার’-এর ১৭ ও ২২ জুলাই সংখ্যাতে স্বাধীন ভারতের এই পতাকাকে খোলাখুলি আক্রমণ করা হয়। সঙ্ঘের কর্ণধার গোলওয়ালকর অকপট ভাষায় বললেন ও লিখলেন যে, হিন্দুরা কোনও দিনই তিন রঙের পতাকা মানবেন না, কেননা তাঁরা তিনকে অশুভ মনে করেন। ভুলে গেলেন, প্রাচীন কাল থেকে হিন্দুরা ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর ত্রয়ীর পূজা করে এসেছেন, ত্রিমূর্তি ত্রিগুণ ইত্যাদি তাঁদের শ্রদ্ধার্হ।

লাগাতার প্রায় দু’বছর আরএসএস এই বিরোধ চালিয়ে গেল। এবং, ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি মহাত্মা গাঁধীর হত্যার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই পটেল এই সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে নেতাদের কারারুদ্ধ করলেন। পটেলই এই বাহিনীকে শক্ত হাতে জব্দ করতে সফল হলেন। প্রধানমন্ত্রী নেহরু বলা সত্ত্বেও তিনি জুলাই ১৯৪৯ অবধি নিষেধাজ্ঞা শিথিল করলেন না এবং কাউকে জেল থেকে ছাড়লেন না। তিনি গোলওয়ালকরের প্রচুর ক্ষমাপ্রার্থনা অগ্রাহ্য করেন। যত ক্ষণ না সঙ্ঘ পরিবার মুচলেকা দিয়ে ভারতের জাতীয় পতাকার প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে, তত ক্ষণ সর্দার পটেল অনড় রইলেন।

এই ইতিহাস স্মরণ না করলে আমরা ঠিক বুঝতে পারব না, কেন সব সিনেমা হলে জাতীয় পতাকা দেখানো নিয়ে এত তৎপরতা। এই অতিভক্তির পিছনে লুকিয়ে আছে আরএসএসের এক কলঙ্কিত অধ্যায়, যা স্বাধীনতা দিবসেই সবচেয়ে বেশি মনে পড়ার কথা। পটেলের দেওয়া শাস্তি যাতে লোকে মনে না রাখতে পারে, তাই মোদী সরকার পটেলকে আত্মসাৎ করার কৌশল চালিয়ে যাচ্ছে। মোদী কোটি কোটি টাকা খরচ করে সর্দার পটেলের এক বিশাল মূর্তিও বানিয়ে ফেললেন। এতে সত্যকে কিছুটা আবৃত করা তো গেলই, উপরন্তু উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের একটা সুযোগ দেওয়া গেল স্বাধীনতা সংগ্রামের এক বীর সেনাপতিকে নিজেদের শূন্য আসনে বসাবার।

স্বাধীনতা তো শুধু নির্দিষ্ট কয়েকটি দিনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে আবেগময় রাষ্ট্রীয় সঙ্গীত গাওয়া বা টিভির সামনে বসে কথার জাদুকরের সম্মোহিত ভাষণে মুগ্ধ হওয়া নয়! শিক্ষিত বিচারশীল মানুষরা ইতিহাসকে এত সহজে ভোলে না। যে কথাটা আমাদের সবচেয়ে বেশি মনে রাখতে হবে হবে তা হল, স্বাধীনতা সংগ্রাম এক লম্বা লড়াইয়ে শেষ হয়ে যায় না। টমাস জেফারসন বলেছেন, স্বাধীন চেতনার বৃক্ষের গোড়ায় প্রতি যুগে শহিদদের ও অত্যাচারীদের রক্ত দিয়ে নিষিক্ত করতে হয়। এই দুঃখদায়ক সত্যকে আমরা অস্বীকার করলে বিপদ অনিবার্য। যাঁরা আমাদের স্বাধীনতার লড়াইয়ে এত ঘৃণ্য ভূমিকা পালন করেছেন, তাঁরাই হঠাৎ ২০১৪ সালের পর থেকে নিজেদের সাচ্চা দেশপ্রেমী বলে জাহির করছেন। শুধু তা-ই নয়, তাঁরা আজ অন্য নাগরিকদের বাধ্য করছেন তাঁদের মেকি দেশভক্তিতে শামিল হতে; না হলে তাঁদের বলপ্রয়োগের শিকার হতে। আমাদের মুক্ত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোকে পূর্বপরিকল্পিত আঘাতের মাধ্যমে বিনষ্ট করা হচ্ছে।

সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার কথা হল, আমাদের পূর্বজদের দেওয়া উপহার আমরা বা বর্তমান প্রজন্ম কতখানি ধরে রাখতে পারব। লক্ষণগুলি মোটেই উৎসাহদায়ক নয়। চার দশকের বেশি রাজ্য ও কেন্দ্রের প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে আমায় বেশ কিছু বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হয়েছে। কিন্তু মৌলিক গণতান্ত্রিক কাঠামোকে এই ভাবে ভিতর থেকে ভাঙতে দেখিনি। প্রতিটি জাতীয় সংস্থার হয় মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া হয়েছে বা অনুগত কিন্তু ক্ষতিকর ব্যক্তির হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে তাদের।

দুর্ভাগ্যের বিষয়, গণতন্ত্রের স্তম্ভগুলিকে নিয়ে যে প্রশ্ন উঠছে, তার সদুত্তর নেই। কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের এমন লজ্জাজনক সম্পূর্ণ একতরফা আচরণ এর আগে কখনও দেখিনি। আমলাতন্ত্র ও পুলিশের কথা বলে সময় নষ্ট করব না; কিন্তু সিবিআই, আয়কর দফতর বা ইডি-ও যে এমন ভাবে একেবারে পোষা নেকড়ে হয়ে যাবে, আমরা কখনও ভাবতে পারিনি। বিচারব্যবস্থা বিষয়েও অনেকের মনে অতি দুর্ভাগ্যজনক কিছু প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে।

স্বচ্ছ প্রশাসনকে পুরোপুরি ধংস করার জন্য এক সপ্তাহ আগে মোদী নির্বিকার ভাবে তাঁর ব্যক্তিগত সচিব এবং অতি অনুগত এক আমলাকে বসিয়ে দিলেন কন্ট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল বা সিএজির শীর্ষ পদে। সিএজি একটি অতি শক্তিমান ও তাৎপর্যপূর্ণ সাংবিধানিক পদ। তাঁকে নজর রাখতে হয় কেন্দ্রীয় ও রাজ্যগুলির খরচের ওপর। অনেকেরই মনে হচ্ছে, এই রেফারিকে এখন থেকে মোদীর টিমের সেন্টার ফরওয়ার্ড হিসেবে খেলতে হবে! আর অনুমান করা যাচ্ছে যে, বিরোধী দলের রাজ্য সরকারগুলির পিছনে উঠেপড়ে লাগতে হবে তাঁকে। বিরোধী নেতারা এই বিপদের চরিত্র পুরোটা উপলব্ধি করতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। সিএজি বাহাদুর যখন তাঁর স্বরূপ দেখাবেন, তখন টের পাওয়া যাবে। আর, এই দফতর যদি ক্রমাগত মোদী সরকারের লক্ষ লক্ষ কোটি টাকার সব ব্যয়কে ক্লিন চিট দিতে থাকে, কেউ অবাক হবেন কি?

এই স্বাধীনতা দিবসে এই ব্যাপারগুলি আমাদের মনে রাখা ভাল। কত দিন আমরা স্বাধীন বহুত্ববাদী গণতন্ত্র বজায় রাখতে পারব, সেটা এখন আর একেবারেই পরিষ্কার নয়।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement