এই ট্র্যাক ধরে এক আইএএস দম্পতি তাঁদের কুকুরকে হাঁটান দৈনিক প্রায় আধ ঘণ্টা। —ফাইল চিত্র।
কয়েক দিন ধরে নেট দুনিয়ায় তোলপাড় হচ্ছিল আইএএস দম্পতির খেলার মাঠ অধিকার করে নেওয়া নিয়ে। ঘটনাটি শুনেই বিরক্ত লাগছিল। কিন্তু বিশদ জানা ছিল না বলে কিছু লিখতে চাইনি। তার পরে কিছু জায়গায় বিষয়টা পড়লাম। সবটা জেনে আর চুপ করে থাকা গেল না।
সরকারি চাকরিতে ঢুকেছিলাম ঠিক ৫০ বছর আগে। অবসরও নিয়েছি অনেক দিন। তবু স্পষ্ট মনে পড়ে, জেনেছিলাম, সরকারি সম্পত্তি কখনও নিজের মনে করে ব্যবহার করতে নেই। সেই সঙ্গে জেনেছিলাম, সরকারি অর্থ ব্যয় করবার সময়ে নিজের পয়সা খরচ করার মতো সতর্ক থাকতে হবে। চাকরিজীবনেও অনেক মানুষকে দেখেছি তা বেদবাক্যের মতন পালন করতে। কিন্তু এখন কী দেখছি?
ঘটনাটি দিল্লির। দক্ষিণ দিল্লিতে যে ত্যাগরাজ নামে একটি স্টেডিয়াম আছে, আমার জানাই ছিল না। কিন্তু কমনওয়েল্থ গেমসের সময় নির্মিত কয়েকটি স্টেডিয়ামের মধ্যে এটিও একটি। চমৎকার আলোর ব্যবস্থা আছে এবং মাঠ ঘিরে ট্র্যাক আছে অ্যাথলিটদের জন্য। শুনলাম রাত ১০টা পর্যন্ত স্টেডিয়াম খোলা থাকত, আলো জ্বলত, স্বাস্থ্যসন্ধানীরা তার পূর্ণ সুযোগ নিতেন। তাঁদের মধ্যে বহু বয়স্ক মানুষ যেমন যেতেন, তেমনই যেত ছোটরা এবং অবশ্যই অ্যাথলিটরা। নিয়মিত অনুশীলনের জন্য। গ্রীষ্মকালে দিল্লিতে খুব গরম। তাই সন্ধ্যাবেলায় এই সুযোগটি অনেকেই ব্যবহার করতেন।
কিন্তু হঠাৎ দেখা গেল স্টেডিয়াম ব্যবহারের সময়সীমা সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, সশস্ত্র পুলিশ নিয়মিত ৭টা বাজার আগেই মাঠ ফাঁকা করে দিচ্ছে। গত কয়েক মাস এমনই চলছিল।
এ বারে উৎসাহী মানুষ বার করে ফেললেন অনেক কিছু। জানা গেল, ৭টায় মাঠ ফাঁকা করে দেওয়ার পর সেখানে ওই ট্র্যাক ধরে এক আইএএস দম্পতি তাঁদের কুকুরকে হাঁটান দৈনিক প্রায় আধ ঘণ্টা। এই দম্পতির নাম আমি করছি না। তবে এখন সকলেই সব জানেন। এঁরা চাকরিতে ঢুকেছেন ১৯৯৪ সালে এবং দু’জনেই আছেন এজিএমইউটি ক্যাডারে। যাঁরা সরকারি পরিভাষায় অনভ্যস্ত, তাঁদের জন্য বলি, এই সাঙ্কেতিক শব্দের অর্থ অরুণাচল, গোয়া, মিজোরাম এই তিনটি রাজ্য এবং সব ক’টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল নিয়ে একটি কল্পিত এলাকা, যেখানে আইএএস এবং আইপিএস অফিসারদের বদলি হতে পারে।
অবশ্যই অধিকাংশ সাহেব-মেমরা ক্ষমতা ও আরামের কেন্দ্রবিন্দু থেকে বেশি দূরে যেতে চান না। দিল্লি ছেড়ে বড়জোর চণ্ডীগড় বা গোয়া পর্যন্ত তাঁদের দৌড়। শুনেছি আমাদের আলোচ্য দম্পতিটিও সেই গোত্রের। এই ঘটনা নিয়ে যখন শোরগোল বাধল, তখন কেন্দ্রের বিজেপি সরকার স্থির করল কিছু একটা করা দরকার। তাই রাতারাতি শ্রী ‘খে’-কে বদলি করা হল লাদাখে আর শ্রীমতী ‘রি’-কে অরুণাচলে। এখন অবধি ঘটনাটি এখানেই দাঁড়িয়ে আছে। কেউ স্থান ত্যাগ করেননি। তবে আলোচনা চলছে সজোরে।
এক, কেউ বলছেন দিল্লি সরকার চালায় আম আদমি পার্টি। তাদের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত ছিল। অবশ্য সরকারি সে রকম বিধান নেই। আবার আম আদমির সরকার এই ঘটনা জেনে বিশেষ বিচলিত হয়েছিল বলেও জানা যাচ্ছে না।
দুই, অনেকে বলছেন, উচিত শাস্তি! অথচ সরকারি বিধানে বদলি শাস্তি নয়। বদলি করার আগে কারণ দর্শাবার প্রয়োজন নেই।
তিন, অনেকে বলছেন, বদলি যথেষ্ট নয়। উচিত ছিল কারণ দর্শাতে বলে সরকারি নিয়ম অনুসারে শাস্তিবিধান।
চার, কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে স্বামী-স্ত্রীর এক জায়গায় বা কাছাকাছি বদলি হওয়ার কথা। এ ক্ষেত্রে তার অন্যথা হওয়া ঠিক নয়। বিশেষত দম্পতির সন্তানদের উপর এর খারাপ প্রভাব পড়তে পারে (সন্তান আছে কি না, তা অবশ্য আমার জানা নেই) ।
পাঁচ, পশুপ্রেমীরা চিন্তিত। কুকুরটির কী হবে? তার মানসিক সমস্যা দেখা দেবে না তো?
ছয়, পরিবেশবান্ধবরা চিন্তিত। যখন এঁরা মাঠে কুকুর হাঁটাতেন, তখন কুকুরের বর্জ্য কে সাফ করত? সত্যিই, কুকুর সমেত হাঁটার অনেক ছবি আছে ফেসবুকে। বর্জ্য সাফ করার কোনও ছবি নেই তো! শ্রী ‘খে’ আবার দিল্লির পরিবেশ বিভাগের ভারপ্রাপ্ত!
প্রশ্ন অনেক, উত্তর মেলে না। এই প্রশ্নগুলো সবই ফেসবুকে কেউ না কেউ তুলেছেন। কিন্তু আমার আরও দুটো প্রশ্ন আছে।
এক, স্টেডিয়াম ফাঁকা করে দেওয়ার আদেশ কে দিয়েছিলেন? তাঁর কি এই আদেশ দেওয়ার অধিকার ছিল? লিখিত আদেশ না থাকলে পুলিশ কেন মাঠ ফাঁকা করে দিত?
দুই, যে সময়টা (গড়ে দৈনিক আধ ঘণ্টা, অন্তত তিন মাস) এই দম্পতি একাই স্টেডিয়াম ব্যবহার করেছেন, সেই সময়ের বৈদ্যুতিক বিল মেটানোর দায়িত্ব কি এই দম্পতির উপর বর্তানো উচিত নয়?
এই সব প্রশ্নের উত্তর কে দেবে আমি জানি না। ভবিষ্যতে অবশ্য এর থেকে কেস স্টাডি তৈরি হতে পারে। কিন্তু আমার অজানা সহকর্মীদের ব্যবহার এর জন্য একটু বদলাবে কি?
(লেখক পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত মুখ্যসচিব। মতামত নিজস্ব)