দুপুরের দিকে মেট্রোয় উঠলে মাঝেমাঝেই সেই বাচ্চা মেয়েগুলোর সঙ্গে দেখা হয়। নামী স্কুলের নার্সারি-কেজি, বড় জোর ক্লাস ওয়ান। স্কুল শেষ করে বাড়ি ফিরছে, কিন্তু ফুর্তির কোনও অভাব নেই। কামরা জুড়ে দাপিয়ে খেলে। আর তাদের মা-রা সিটে বসে, এমনকী বসার জায়গা না পেলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই স্কুলব্যাগ খুলে খাতা বের করে দেখেন— ক্লাসের খাতায় কোনও কাটা দাগ পড়ল কি না। লাল কালির দাগ থাকা মানেই অবধারিত হুমকি, ‘দাঁড়া আজ তোর হচ্ছে, বা়ড়ি চল।’ খুব চিন্তা হয়, ক্লাস টেনের পরীক্ষার সময় এই মা-রা ঠিক কী কী করবেন।
আইসিএসই বোর্ডের ছেলেমেয়েদের অতঃপর ক্লাস টেন অবধি অপেক্ষা করার আর দরকার নেই। সামনের বছর থেকে ক্লাস ফাইভেই বোর্ডের পরীক্ষা। কর্তারা জানিয়েছেন, ফাইভের শেষে এক বার, আর এইটের শেষে এক বার বোর্ডের পরীক্ষা দিতে হবে ছেলেমেয়েদের। তবে, ভয়ের কিচ্ছুটি নেই। কেউ ফেল করবে না, ক্লাসের পড়াশোনা কেমন তৈরি হল, তা-ও যাচাই করা হবে না। ক্লাস অনুযায়ী স্কুলে যতটুকু শেখার কথা, তার ভিত্তিতেই দেখা হবে, বুদ্ধি খাটিয়ে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে কি না তারা।
একটা ‘কিন্তু’ অবশ্য আছে। ছেলেমেয়েদের পরীক্ষাটা ঠিক ‘পরীক্ষা’ নয় বটে, মাস্টারমশাইদের বিলক্ষণ পাশ-ফেল আছে। স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা ফল খারাপ করলে শিক্ষক-শিক্ষিকার নম্বর কমবে। আইসিএসই বোর্ডের সব স্কুলই বেসরকারি, ফলে স্কুলই শিক্ষক নিয়োগ করে। কম নম্বর পাওয়া শিক্ষকদের স্কুল চাকরিতে রাখবে কি না, অথবা কম নম্বর পাওয়া শিক্ষক থাকলে সেই স্কুল বোর্ডের কোপে পড়বে কি না, এখনও অবধি কিছুই স্পষ্ট নয়। কিন্তু, এই পরীক্ষা চালু হলে শিক্ষকদের ওপর ‘ভাল ফল’ করার চাপ বাড়বে, তাতে সন্দেহ নেই।
জল যেখান থেকেই গড়াক, শেষ অবধি তা এসে জমে তলানিতে। চাপও ঠিক তেমন। বোর্ড স্কুলের ওপর চাপ দিলে স্কুল তা চালান করবে শিক্ষকদের ঘাড়ে, আর শিক্ষকরা? তাঁরা ছেলেমেয়েদের ‘তৈরি’ করবেন বোর্ডের পরীক্ষার জন্য। ক্লাসের পড়ার সঙ্গে হোমওয়ার্কের বহর বাড়বে। খামতি থাকলে স্কুলে ডাক পড়বে অভিভাবকের। উদ্বিগ্ন মুখে শিক্ষক বলবেন, ‘বোর্ডের জন্য আর একটু তৈরি হতে হবে তো।’ অর্থাৎ, বোর্ড যতই ‘ভয় পেয়ো না, ভয় পেয়ো না’ বলে ছেলে ভোলাক, ক্লাস ফাইভে বোর্ডের পরীক্ষা মানেই ছাত্রছাত্রীদের ওপর চাপ।
সে চাপ আইসিএসই-র সমান, বা তার চেয়েও বেশি। কারণ, পঞ্চম আর দশম শ্রেণির মধ্যে যে পাঁচ বছরের ফারাক, তাকে হিসেবে রেখে চাপের পরিমাণ স্থির করার কোনও পথ সম্ভবত নেই। ক্লাস ফাইভের বাচ্চাগুলোর জন্য একটা বাড়তি অসুবিধাও থাকছে। আইসিএসই-তে অন্তত স্কুলের পড়া অনুসারেই পরীক্ষা দিতে হয়। বোর্ড জানিয়ে দিয়েছে, পঞ্চম শ্রেণির পরীক্ষায় ক্লাসের পড়া মুখস্থ করার দরকার নেই, এখানে বুদ্ধি যাচাই করা হবে। সহজ বাংলায় যার মানে দাঁড়ায়, সম্পূর্ণ নতুন ধরনের একটা পরীক্ষার জন্য আলাদা ভাবে তৈরি হতে হবে। সেই পরীক্ষা, যার ফলাফলের দিকে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে থাকবে স্কুল। এবং, তাকিয়ে থাকবেন অভিভাবকরা। প্লে গ্রুপে সন্তান ‘সার্টিফিকেট অব এক্সেলেন্স’ পাবে কি না, সেই চিন্তায় যাঁদের রাতের ঘুম উড়ে যায়, বোর্ডের পরীক্ষায় তাঁরা ঠিক কী কী করতে পারেন, সে কথা ভাবলে মনে হয় বাচ্চাগুলোকে বলি, সময় থাকতে পালা!
উদ্বেগের চেয়ে ছোঁয়াচে রোগ দুনিয়ায় আর একটা নেই। মা-বাবারা এমনিতেই সদা-উদ্বিগ্ন— অবশ্য, যখন নামী কলেজে কাট-অফ নম্বর সটান একশো শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে, তখন চব্বিশ ঘণ্টা টেনশন না করে উপায়ই বা কী? এক মায়ের কথা জানি, ক্লাস ওয়ানের মেয়ের পড়ার ক্ষতি হবে বলে তিনি মেয়েকে কোথাও নিয়ে যেতেন না। এমনকী, তার বন্ধুদের জন্মদিনের পার্টিতেও না। কারণ, ক্লাসে পড়ায় ভুলচুক হলেই ক্লাসটিচার ডেকে পাঠান তাঁকে। শিক্ষিকার উদ্বেগ চারিয়ে যায় মায়ের মধ্যে। আর, মাকে উদ্বিগ্ন দেখতে দেখতে মেয়েও অপরাধবোধে ভোগে। ভাবে, তার জন্যই মায়ের এই হেনস্থা। এই বাচ্চাটার ওপরই যখন ক্লাস ফাইভের বোর্ডের পরীক্ষা চেপে বসবে, তার নিঃশ্বাস ফেলার অবকাশ থাকবে তো?
সেই বাঁদরটার গল্প মনে পড়ছে। রাজার প্রিয় বাঁদর, যে ঘুমন্ত রাজার নাকের ওপর বার বার এসে বসা মাছিটাকে মারতে সপাট তলোয়ার চালিয়ে দিয়েছিল। মাছিটাকে মারা জরুরি ছিল। ঠিক যেমন জরুরি শিক্ষকদের কুশলতা পরীক্ষা করে দেখা। তাঁদের পড়ানোয় ছেলেমেয়েদের লাভ হচ্ছে কি না, তারা আদৌ কিছু শিখছে কি না, যাচাই করে দেখতে হবে বইকি। কিন্তু, তার জন্য বাচ্চাগুলোর ওপর তলোয়ার চালিয়ে দিলে মাছিটা মরল কি না, সেই প্রশ্নটারই কি আর কোনও মানে থাকে? চাপ কি কম পড়িয়াছে যে ক্লাস ফাইভেই বোর্ডের পরীক্ষা না নিলে নয়?
পুনশ্চ: পরীক্ষা যদি নিতেই হয়, তবে অন্তত কোন ছাত্র কেমন রেজাল্ট করল, সে খবরটা অভিভাবকদের কাছে, এবং স্কুলের কাছেও গোপন রাখা হোক। শিক্ষকদেরই যদি মাপতে হয়, তার জন্য তো সার্বিক ফলাফলই যথেষ্ট। বাচ্চাগুলোর ওপর রেজাল্টের বোঝা না হয় না-ই চাপানো হল। তার জন্য তো ক্লাস টেন আছেই।