আপনার অভিমত

‘কোত্থাও যাব না আমি’ বলে চলে গেলেন নীরেন্দ্রনাথ

যত বার কথা হয়েছে, শুধু একটা কথাই বলতেন, ‘‘কবিতার জন্য সময় বার করে নিতে হবে।’’ সদ্যপ্রয়াত কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীকে নিয়ে লিখছেন দেবজ্যোতি কর্মকারযত বার কথা হয়েছে, শুধু একটা কথাই বলতেন, ‘‘কবিতার জন্য সময় বার করে নিতে হবে।’’ সদ্যপ্রয়াত কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীকে নিয়ে লিখছেন দেবজ্যোতি কর্মকার

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০১৮ ০০:৫১
Share:

প্রতিটি নক্ষত্রেরই নিজস্ব অহঙ্কার থাকে। যার চিরকালীন রৌদ্র আমাদের শুধু পোড়ায় না, ঋদ্ধ করে। সেই নক্ষত্র বলে যাঁকে এত দিন মেনে এসেছি, তাঁর চলে যাওয়া দেখলাম। নক্ষত্রপতনের শব্দ কেমন, তা-ও অনুভব করলাম যেন!

Advertisement

কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী আমার কাছে একটি নক্ষত্র, যাঁর সৃজনগন্ধে বড় হয়েছি। অনুভব করেছি, ‘কবিতা আসলে সাংসারিক বিষয় ছাড়া আর কিছুই নয়’ কিংবা ‘কবিতাকে আয়ত্ত করবার জন্য, মুনি ঋষিদের মতো, নির্জন পাহাড়ে-পর্বতে কিংবা বনে-জঙ্গলে গিয়ে তপস্যা করতে হয়, আমি তা মনে করি না’।

প্রথমেই বলেছি, প্রতিটি নক্ষত্রেরই অহঙ্কার থাকে। থাকে নিজস্বতা। আর থাকে এক অপরিসীম মহাকর্ষীয় বল। আমরা সেই মহাকর্ষীয় টানে আটকে থাকি। মন্ত্রমুগ্ধের মতো আবর্তিত হই। আসলে সেই অহঙ্কার সৃজনের গন্ধমাখা, শিল্পের মহান এক আকাশ। প্রকৃত মহৎ কেউ সৃজনের বিপুল রশ্মি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন সমগ্র উত্তরকালের জন্য। আমরা ভাগ্যবান সেই রশ্মিগুলো আমাদের গায়ে এসে লাগছে।

Advertisement

একটি ছোট্ট অভিজ্ঞতার কথা লিখি। ২০১৩ সালে আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। বইটি আমি পাঠিয়েছিলাম কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর বাড়িতে। পাঠানোর আগে বেশ কয়েক বার ভেবেছিলাম। অত বড় এক জন কবির কাছে কাব্যগ্রন্থ পাঠানো কি ঠিক হবে? দুঃসাহসে ভর করেই পাঠিয়ে দিলাম। তবে সঙ্গে পাঠালাম আমাদের পত্রিকার একটি কপিও। এপ্রিলের এক সন্ধ্যায় হঠাৎ একটি ফোন এল। আমি ‘হ্যালো’ বলতেই ও পার থেকে— ‘‘নমস্কার, আমি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বলছি। আপনার কবিতার বই আমি পড়েছি। প্রতিটি কবিতাই আমি পড়েছি...।’’

সেই সন্ধ্যায় আমি কতক্ষণ বিস্ময়ে ছিলাম, জানি না। এটা আমার কাছে বিরাট প্রাপ্তি। আমি নিশ্চিত, এ রকম প্রাপ্তিযোগ আমার মতো অনেক তরুণের হয়েছে। তার পরে একাধিক বার কথা হয়েছে। কখনও কোনও দিন এতটুকু বিরক্ত হতে শুনিনি। এমনকি তিনি নিজে ফোন ধরতে পারছেন না, অন্য কেউ তাঁর কানে মোবাইল ধরে আছেন আর তিনি বেশ কিছুক্ষণ আমার সঙ্গে কথা বলেছেন। এক বারও বলেননি যে, তিনি এতটাই অসুস্থ। পরে জানতে পেরেছি যখন, ভীষণ খারাপ লেগেছে। যত বার কথা হয়েছে শুধু একটা কথাই বলতেন, ‘‘কবিতার জন্য সময় বার করে নিতে হবে। কাগজ কলম তো আছেই, তাই না?’’

ইচ্ছে ছিল, এক বার আমার ঈশ্বরকে সামনে থেকে দেখব। তাঁর কাছেই সময় চেয়ে নিলাম। ঠিক বিকেল ৫টায় উনি যেতে বললেন। সঙ্গে নিলাম বহরমপুরের কবিবন্ধু ও সম্পাদক সুব্রত হাজরাকে। বাঙুর অ্যাভিনিউয়ের নির্জন বাড়িটি খুঁজে নিলাম দু’জনে। পৌঁছতেই এক মহিলা বৃদ্ধ কবিকে ধরে-ধরে এনে আমাদের সামনে বসিয়ে দিলেন। পা ছুঁয়ে বললাম, ‘‘আপনাকে এক বার প্রাণ ভরে দেখতে এলাম।’’ পত্রিকা দিলাম। বেশ কিছু কথাও হল। শেষে বললেন, ‘‘আমার তো যাওয়ার সময় হয়ে এল। এ বার তোমাদের কাজ করার সময়। এগিয়ে যেতে হবে। বিশ্বাস করি, তোমরা পারবে।’’

কথাগুলো এখনও কাঁধে চেপে আছে। ভারে আক্রান্ত হইনি। তবে স্পর্ধা বেড়েছে অনেকখানি। সে দিন ঈশ্বরের দেখা পেয়ে ভেবেছিলাম, তিনি সত্যিই নক্ষত্র। আজ লিখলাম নক্ষত্রেরও অহঙ্কার আছে। এক জন মহান কবিরই এই অহঙ্কার সাজে। যিনি পরম আদরে ছোটদের কাছে টেনে নেন। কবিতা লেখার স্পর্ধা দেখান। অথচ এমন অনেকেই আছেন, যাঁরা নক্ষত্রের পোশাক গায়ে দিয়ে অহেতুক অহঙ্কার দেখান। তরুণ কবিরা তাঁদের স্পর্শলাভের জন্য ইতস্তত ভাবে ছোটেন। শেষে নিরাশ হন। এখানেই নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর সঙ্গে অন্যের তফাত। তরুণদের সাহস দেওয়া, স্বপ্ন দেখানোর কাণ্ডারী তিনি।

বড়দিনে আমাদের ছেড়ে গেলেন সেই কাণ্ডারী। আর কেউ আমাদের ‘ভিতর বাড়ির’ সন্ধান দেবেন না। আর কেউ বলবেন না, ‘রৌদ্র যে মুখোশ নয়, ঈশ্বরের মুখ’। আমরা সেই ঈশ্বরকে হারালাম। প্রতি রাতে আকাশে খুঁজব তাঁকে। কেননা, ‘রাত্রি হলে একা-একা পৃথিবীর ভিতর-বাড়িতে যেতে হয়।/ ... ভিতর-বাড়ির রাস্তা এখনও রহস্যময় যেন’।

শেষ দিকে চোখে ভাল দেখতেন না। চিকিৎসক তাঁকে ভাবতেও নিষেধ করেছিলেন। লেখা তো পরের কথা। তবুও লিখেছেন। ভীষণ কষ্টে। অনেক আগেই লিখেছিলেন— ‘পিতামহ, আমি এক নিষ্ঠুর মৃত্যুর কাছাকাছি/ নিয়েছি আশ্রয়। আমি ভিতরে বাহিরে যেদিকে তাকাই,/ —শুধু অন্ধকার, শুধু অন্ধকার।’

এমনি করেই তিনি ভয়ের কাছে পৃথিবীর মৌলিক নিষাদ দেখেছিলেন। সহজ সরল এক কাব্যিক আলো তিনি। অথচ প্রতিটি কবিতায় কী ভার! যাঁর কাব্যের উপাদানের রহস্য তিনি নিজেই দিয়েছেন, ‘আমি খুব বেশি কল্পনায় ভর করে লিখতে পারি না। আশপাশের যা কিছু ঘটনা সে সবই আমার কবিতায় উঠে আসে’। এ সব কথাই আমাদের প্রাণিত করে। দেখার চোখটাকে আরও উন্মুক্ত করে। নক্ষত্রপতনের এই শব্দ আমাদের অপেক্ষায় দাঁড় করিয়ে রাখে— ‘তবু ডাকি। আজও ডাকি। আসবে না জেনেও তাকে ডাকি।’ যদিও তিনিই বলে গিয়েছেন, ‘কোত্থাও যাব না আমি, এইখানে তোমার পাশে-পাশে/ থাকব চিরকাল’।

জীবনানন্দ দাশ বলেছিলেন, নক্ষত্রও এক দিন ঘুমিয়ে পড়ে, শুধু জেগে থাকে সহিষ্ণু মানুষ। আমরা কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীকে খুঁজতে থাকব ‘জ্যোৎস্নায় ডানার শব্দে’ কিংবা ‘মন খারাপের দুপুরে’।

সঙ্গের ছবিতে আনন্দবাজার অফিসে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী।

শিক্ষক

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement